স্টাফ রিপোর্টার: কিছুদিনের জন্য স্বাদ গন্ধ ছিনিয়ে নিয়েছিল কোভিড। তৃতীয় ঢেউ চলে যাওয়ার প্রাক্কালে উঠে এল আরও আশঙ্কার তথ্য। স্কুল (School) বন্ধ থাকায় বাড়িতে বসে চলে গিয়েছে বর্ণ চেনার ক্ষমতা। রাজ্যের পঞ্চম শ্রেণির ৮৫ শতাংশ শিশু শব্দ চিনতে পারছে না। বানান করে পড়তে পারছে না, ‘আম’, ‘আপেল’-এর মতো সাধারণ শব্দ।
এক বেসরকারি সংস্থার করা এই রিপোর্টের নাম অ্যানুয়াল স্টেটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট (এএসইআর) (ASER)। যেখানে দেখা গিয়েছে, শুধু বাংলা কিংবা বিজ্ঞানই নয়। সাধারণ বিয়োগ অঙ্ক ভুলে গিয়েছে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারা। কোভিড পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ স্কুল। সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন স্কুল বন্ধ ছিল বাংলাতেই। ১৭টি জেলার ৫১০টি গ্রামের ১১ হাজার বেশি শিশুর পরীক্ষা নিয়ে তাই হতবাক সমীক্ষকরা। ওই বেসরকারি সংস্থার বার্ষিক রিপোর্টের দাবি, অবস্থা এতটাই খারাপ যে বানান করে শব্দ এবং শব্দ পাশাপাশি জুড়ে বাক্যও পড়তে পারা তো দূর, তাদের অনেকে বর্ণও চিনতে পারছে না!
রাজ্যের প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারা এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে তার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থাটি। দেখা গিয়েছে, কোভিড আসার আগে, ২০১৮ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের ‘গল্প’ পড়তে পারত ৩৬.৬ শতাংশ শিশু। কোভিড আবহে স্কুল বন্ধ থাকায় এই মুহূর্তে মৌলিক শিক্ষণ নেমে দাঁড়িয়েছে ২৭ শতাংশ। এই সমীক্ষা দেখে চিন্তিত রাজ্য সরকারের গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি বোর্ডের সদস্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, সমীক্ষায় রাজ্যের পড়ুয়াদের শিক্ষার যে অবস্থা ফুটে উঠেছে তা সন্তোষজনক নয়। রাজ্যের শিক্ষার বার্ষিক মানের এই রিপোর্ট নতুন নয়।
[আরও পড়ুন: বঙ্গে ফের লাফিয়ে বাড়ল করোনা সংক্রমণ, কলকাতা-সহ ২ জেলায় একদিনে আক্রান্ত শতাধিক]
২০১৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে এ রিপোর্ট বেরলেও শেষ দুই বছরে অর্থাৎ ২০২০ এবং ২০২১ সালে তা প্রকাশ হয়নি। কোভিড পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর এ বছর আবার সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালের সঙ্গে ২০২১ সালের শিক্ষার মানের ফারাক অনেক। এবং তা নিম্নগামী। গত তিন বছরে রাজ্যের শিক্ষার মান আরও নিম্নমুখী হয়েছে।
কী আছে ওই রিপোর্টে? রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ছাত্র ছাত্রীদের বুনিয়াদি শিক্ষা অর্থাৎ প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞান, বানান করে শব্দ পড়া বা একটা গোটা বাক্য পড়ার মতো শিক্ষায় চোখে পড়ার মতো অবনতি হয়েছে। ২০১৮ সাল যেখানে প্রথম শ্রেণির স্তরের সরল বাক্য, যেমন ‘গরমে আম পাওয়া যায়’ বানান করে পড়তে পারত ৭৩.২ শতাংশ পড়ুয়া। ২০২১ সালে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬৬.৩ শতাংশে। যুক্তাক্ষরহীন কিছুটা বড় বাক্য, যা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ানো হয় তা পড়তে পেরেছে ৫৩ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী। যেখানে তিন বছর আগে এই ধরনের বাক্য পড়তে পারত ৬৬.২ শতাংশ পড়ুয়া।
কিছুটা একই অবস্থা অঙ্ক কষার ক্ষেত্রেও। প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণির পর্যন্ত এমন অনেকেই রয়েছে, যারা এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাও চিনতে পারে না। ২০১৮ সালেও এমন ছাত্রছাত্রী ছিল না তা নয়। সপ্তম শ্রেণিতে যেমন এক শতাংশ পড়ুয়া ১-৯ সংখ্যা চিনত না। তবে ২০২১ সালে এই অজ্ঞানতার হার বেড়ে আড়াই শতাংশ হয়েছে। একইভাবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৫.৩ শতাংশ, পঞ্চম শ্রেণিতে ৫.২ শতাংশ, চতুর্থ ৬.৭ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণিতে ৯.২ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১২.৬ শতাংশ এবং প্রথম শ্রেণিতে ৩০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা চিনতে পারে না।
এএসইআর রিপোর্ট বলছে ২০১৮ সালে ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যা চিনতে পারত ৭৭.৮ শতাংশ পড়ুয়া। ২০২১ সালে ৬৮.৫ শতাংশের সেই ক্ষমতা রয়েছে। বিয়োগ, ভাগ করতে পারে না অষ্টম শ্রেণির ৩৬.৯ শতাংশ পড়ুয়া। সমীক্ষায় গণনা পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যা, দুই অঙ্কের সংখ্যা, বিয়োগ এবং ভাগের অঙ্ক। ওই পরীক্ষার যে ফলাফল প্রকাশ্যে এসেছে, তার ভিত্তিতেই তৈরি করা হয়েছে রিপোর্ট।
রাজ্যের সার্বিক শিক্ষার মানের অবনতির কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি রিপোর্টে। আশার কথা একটাই পড়াশোনা না করতে পারলেও স্কুলছুট হয়নি বেশি ছাত্রছাত্রী।
