সুনীপা চক্রবর্তী, ঝাড়গ্রাম: ভোরের আলো তখন সদ্য ফুটেছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা। আর সেই নিস্তব্ধতাই হঠাৎ ছিন্নভিন্ন করে প্রবল শব্দে ধেয়ে এল পাঁচটি হাতি—তিনটি পূর্ণবয়স্ক ও দুটি শাবক। যেন মৃত্যুর দূত এসে হাজির! গড় শালবনির সরকারি অনাথ আশ্রমে তখন শুরু হল চরম ধ্বংসযজ্ঞ। আর আশ্রমের ৫৭ জন শিশু-কিশোর আতঙ্কে গুটিয়ে নিজেদের ঘরে। কাঁপতে কাঁপতে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে—কখন যেন প্রাণ নিয়ে পালাতে হয়!
খাবারের লোভে অনাথ আশ্রম ঘিরে তাণ্ডব। নিজস্ব চিত্র
এই অনাথ আশ্রমটি পরিচালিত হয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে। ছয় থেকে আঠারো বছর বয়সি শিশু-কিশোররা এখানে থাকে, লেখাপড়া করে, বড় হয় একে অপরের সাহচর্যে। আশ্রমে থাকেন হাউস ফাদার দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁরা মা-বাবার অভাব পূরণ করেন।
এদিন ভোরে আচমকা দরজা ভেঙে, গ্রিল উপড়ে, দেওয়াল ধসিয়ে পাঁচটি হাতি ঢুকে পড়ে আশ্রম চত্বরে। এক হাতি নিজের বিশাল দেহ সঙ্কুচিত করে ঢুকে পড়ে স্টোর রুমে, টেনে বার করে আনে তিন বস্তা মুড়ি ও আলুর বস্তা। খেয়ে, মাড়িয়ে, তছনছ করে দেয় সবকিছু। রান্নাঘরের প্রাচীর ভেঙে, অফিস ঘরের লোহার গ্রিল খুলে, ডাইনিং হলের কলাপসিবল গেট বাঁকিয়ে দেয় তারা। সবজি বাগান তো চুরমার করেই ছাড়ল।
খাবারের লোভে অনাথ আশ্রম ঘিরে তাণ্ডব। নিজস্ব চিত্র
সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল সেই মুহূর্ত, যখন শিশুরা বুঝতে পারল, তারা ঘেরাও হয়ে গিয়েছে। কারও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছিল না, কেউ কেঁদে ফেলেছিল, কেউ দৌড়ে লুকিয়েছিল খাটের নিচে। দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বাচ্চাদের জানালার পাশে দাঁড়াতেও দিইনি। একঘণ্টারও বেশি সময় ধরে হাতিরা দাপিয়ে বেড়িয়েছে। একসময় আমরা টিন, থালা-বাটি, ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিকট শব্দে হাতিগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করি। বাচ্চারাও আওয়াজ তুলে আমাদের সাহায্য করে। তারপর ধীরে ধীরে হাতির দলটি সরে যায়।” তবু আতঙ্ক যায় না। হাউস ফাদারের আশঙ্কা, “হাতিরা একবার খাবার খুঁজে পেলে ফেরে। সন্ধে নামলে আবার আসতে পারে। অথচ এই আশ্রমে নেই কোনও নিরাপত্তারক্ষী। ৫৭টি শিশুর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা ভয়ানক উদ্বিগ্ন।”
খাবারের লোভে অনাথ আশ্রম ঘিরে তাণ্ডব। নিজস্ব চিত্র
অভিযোগ, বনদপ্তরকে ফোন করা হলেও দীর্ঘক্ষণ সাড়া মেলেনি। ঘটনাস্থলে বনকর্মীরা পৌঁছন দুপুর দেড়টা নাগাদ। এই বিষয়ে ঝাড়গ্রামের ডিএফও উমর ইমাম বলেন, "রেঞ্জার ওখানে গিয়ে সবটা দেখে এসেছে। রিপোর্ট দিয়েছে। আজ থেকে ঝাড়গ্রাম লোধাশুলি রাস্তায় রাতে একটি বিশেষ পেট্রোলিং ভ্যান থাকবে। রাস্তায় যাতে হাতি না উঠে আসে সেটা ওই টিম দেখবে। প্রয়োজনে আরও একটি গাড়ি দেওয়া হবে।" লোধাশুলির রেঞ্জ অফিসার প্রসূন মুখোপাধ্যায় বলেন,"আমরা গিয়ে পুরোটা দেখে এসেছি। যা ক্ষতি হয়েছে সেটার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। শাবক-সহ দলটা ওই হোমে ঢুকে পড়েছিল। একেবারে জঙ্গল লাগোয়া হোমটি। যথেষ্ট আলো নেই। আমরা পুরো বিষয়টা দেখছি।"
খাবারের লোভে অনাথ আশ্রম ঘিরে তাণ্ডব। নিজস্ব চিত্র
তবু সেই 'পুরো বিষয়' কেবল ক্ষতিপূরণে মিটে যায় না। এখনও আশ্রমের শিশুরা আতঙ্কে কাঁপছে। কেউ রাতের ঘুম ফিরে পায়নি। বনদপ্তরের দেরি ও নিশ্চুপ ভূমিকা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। অনাথ শিশুদের এই নিরাপত্তাহীনতা যেন প্রশাসনিক নিষ্ক্রয়তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে গোটা সমাজকে। আতঙ্ক আর অসহায়তাকে একসঙ্গে বয়ে চলেছে একটি অনাথ আশ্রম—যেখানে ঘুম নেই, নিশ্চিন্তি নেই, রয়েছে শুধুই অজানা আশঙ্কা।
