সুমন করাতি, হুগলি: পরনে পাটভাঙা নতুন শাড়ি। মাথায় ঘোমটা, কপালে সিঁদুরের টিপ। কারও গলায় রকমারি হার, কারও হাত ভর্তি চুরি। সমস্ত নিয়ম মেনে চলছে মা জগদ্ধাত্রীর বরণ। তবে এঁরা কেউই মহিলা নন। নারী বেশে পুরুষ। নিষ্ঠাভরে হাতে বরণডালা নিয়ে তাঁরা সকলে মায়ের বিদায়ের কাজকর্মে ব্যস্ত। হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন। অবাক হলেও দশমীতে ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলার মাতৃবরণে এই দৃশ্যই চোখে পড়ে প্রতি বছর। মাথায় ঘোমটা দিয়ে পুরুষরাই মহিলা সেজে বরণ করেন মাকে।
২৩২ বছর ধরে এই প্রথাই চলে আসছে ভদ্রেশ্বর তেঁতুলতলা জগদ্ধাত্রী বারোয়ারিতে। এবছরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মোট ১৭ জন পুরুষ মিলে একেবারে মহিলাদের মতো সেজে পুজো মণ্ডপে আসেন। মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাতে শাঁখা, সিঁদুর পরে দেবীর কনকাঞ্জলি থেকে বিদায়বরণ সব কিছুই সম্পন্ন করেন সুষ্ঠুভাবে। হাতে বরণের থালা নিয়ে দিব্যি সাবলীলভাবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছবিও তোলেন সকলে। এমনকি তাঁদের সঙ্গে সেলফি তুলতেও দেখা যায় কয়েকজন মহিলাকে। তবে এই পুরুষদের সাজ দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। এখানকার পুজোয় কেন এই নিয়ম পালন করা হয়?
কথিত আছে, এক সময় ইংরেজ ও ফরাসিদের ছাউনি ছিল ভদ্রেশ্বর গৌরহাটি এলাকায়। সেই সময় নিরাপত্তার কারণে মহিলারা বাড়ির বাইরে বেরতেন না। তাঁরা অন্দরমহলেই থাকতেন। তাই সেই সময়ে জগদ্ধাত্রী পুজোর আচার-অনুষ্ঠান পুরুষরাই সামলাতেন। এমনকি পরিবারের মহিলারা যে ভাবে বাড়ির ঠাকুরকে বরণ করেন সেভাবেই পুরুষরা এখানে বরণ করতেন। প্রথা মেনে আজও মহিলাদের মতোই শাড়ি পরে, কপালে সিঁদুর লাগিয়ে পুরুষরা বরণডালা সাজান। তার পর রীতি মেনেই শোভাযাত্রা বের করে গঙ্গায় ভাসান দেওয়া হয় প্রতিমা। তবে মন্দিরের মধ্যে জনসাধারণের প্রবেশ নেই।
এই বিশেষ রীতি নিয়ে তেঁতুলতলা বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটির সদস্যরা জানান, ২৩২ বছরের আগে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান দাতারাম সুর গৌরহাটিতে বাস করতেন। তিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমতি নিয়ে দুই বিধবা কন্যাদেরকে নিয়ে নিজের বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো করেন। কিন্তু কালের নিয়ে সেই পুজো থেমে যায়। পরে সেই জগদ্ধাত্রী পুজোই তেঁতুলতলা বারোয়ারির নাম পায়। ইংরেজ শাসনকালেই এই অঞ্চল জঙ্গলে ভরা ছিল। এছাড়া এই এলাকাগুলোতে ইংরেজ সৈনিক থাকার কারণে নিরাপত্তার অভাব সব সময় থেকেই যেত। মহিলাদের উপর অত্যাচারের কারণে তাঁরাও আর বাড়ি থেকে বেরতেন না। তাই সেই পরিস্থিতিতে পুরুষদের দিয়েই মায়ের বরণ শুরু হয়। এই রীতিই কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে এখানে।
দেখুন ভিডিও: