সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: বাংলা জুড়ে পঞ্চায়েত ভোটের (Panchayat Election) প্রচারে এ এক আজব কাণ্ড! আর তাকে ঘিরে রঙ্গ-রসিকতাও কম নয়। সোশ্যাল সাইটের ওয়াল থেকে গাঁ-গঞ্জের চায়ের ঠেক, এমনকি কমরেডদের সম্পাদকমণ্ডলীর গুরুগম্ভীর বৈঠকেও উঠে আসছে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রচারে হাঁ করা সিংহের ছবি। যে ছবি দেখে গরু, ছাগল এমনকি গ্রামের শিশুরাও ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। গরু, ছাগল যেমন দৌড়ে পালাচ্ছে, তেমনই ওই পথ দিয়ে যাওয়া-আসা বন্ধ করে দিয়েছে গ্রামের শিশু থেকে বালক-বালিকারা। তাই সর্বসম্মতিক্রমে গ্রামের সিদ্ধান্ত, ভোটের প্রচারের জন্য দেওয়ালে আঁকা ওই সিংহের ছবি রীতিমতো বস্তা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে পুঁতে দেওয়া হয়েছে পেরেক। এতে অবশ্য আপত্তি করেননি ফরওয়ার্ড ব্লক (Forward Block) প্রার্থীরাও। আর এই মুখঢাকা সিংহের ছবিই এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় (Social Media) থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়েছে। আর এই নিয়ে এখন মসকরার শেষ নেই পুরুলিয়ায়।
পুরুলিয়া (Purulia) দু’নম্বর ব্লকের ঘোঙা গ্রাম পঞ্চায়েত। সেই গ্রাম পঞ্চায়েতেরই কোলবাঁধ এলাকায় ১৩/১৪ ও ১৩/১৫ সংসদে দাঁড়িয়েছেন দুই ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী টগর রাজোয়াড় ও মুটুকা প্রামাণিক। তাঁরা লড়ছেন গ্রাম পঞ্চায়েত আসন থেকে। তাঁদের সমর্থনে দেওয়াল লিখনকে ঘিরেই এমন ঘটনা। ওই এলাকায় একেবারে গ্রামে ঢোকার মুখে একটি বাড়ির দেওয়ালে হাঁ করা সিংহের (Lion) প্রতীক এঁকেছেন ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মী-সমর্থকরা। আর তাতেই বিপদ! গ্রামের গরু-ছাগল থেকে শিশু-বালকরা যেন ভয়ে কেঁপে উঠছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের (FB) রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অসীম সিনহা বলেন, “এটা শুনে আজব মনে হলেও ওই গ্রামের ক্ষেত্রে কিন্তু একেবারে সত্যি ঘটনা। আমরা দলের তরফে সংগঠনের নেতা ও প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঘোঙা গ্রাম পঞ্চায়েতের কোলবাঁধে একেবারে ঢোকার মুখে আমাদের প্রতীক দেওয়ালে আঁকা হাঁ করা সিংহের ছবি দেখে গরু, মোষ, ছাগল পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে। সেই কারণেই গ্রামের মানুষজন আলোচনা করে সিংহের মুখ বস্তা দিয়ে ঢেকে পেরেক আটকে দিয়েছেন। গ্রামের মানুষজনের কথা ভেবে আমরা কোনও বাধা দিইনি। প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশনে কোনও অভিযোগ করা হয়নি।”
[আরও পড়ুন: নিজের জন্মদিনে গ্রাহকদের অভিনব উপহার! জোম্যাটোর ডেলিভারি বয়ের ‘কাণ্ডে’ মুগ্ধ নেটদুনিয়া]
সোশ্যাল সাইটে এই মুখ ঢাকা সিংহ নিয়ে নানান রঙ্গ-রসিকতা চলছে। পুঞ্চা পঞ্চায়েত সমিতির তিন নম্বর আসনে কুড়মি সমর্থিত নির্দল প্রার্থী সৌম্যদীপ মাহাতো ফেসবুকে (Facebook) লিখেছেন, “গাঁয়ে ঘরে আজব গজব সমস্যা রে ভাই। গ্রামে ঢোকার মুখে প্রথম বাড়ির দেওয়ালে ফরওয়ার্ড ব্লক ছাপ এঁকে ভোটের প্রচার লিখন বানিয়েছিল। বিকালে গরু, মোষ বাড়ি ফেরার পথে রোজ বাঘ দেখে দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করছিল। গ্রামবাসীরা শেষে কোনও উপায় না পেয়ে বস্তা দিয়ে বাঘ মামার মুখ ঢেকে দিয়েছে।”
ফরওয়ার্ড ব্লকের ‘সিংহ’ প্রতীক নিয়ে পুরুলিয়ায় অতীতে এমন নানান ঘটনা ঘটেছে। বাম আমলে পুরুলিয়া লোকসভা আসনটি বামফ্রন্টের (Left Front) তরফে ফরওয়ার্ড ব্লককে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে জেলা জুড়ে দেওয়াল জুড়ে সিংহ আঁকা হতো। কিন্তু এই জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এই সিংহকে ‘বাঘ’ বলেই জানত। এখনও অনেকেই ‘বাঘ’ ছাপে ভোট দেওয়ার কথা বলেন। ঘাড়ের কাছে থাকা কেশর সমেত সিংহের ছবি আঁকা চাট্টিখানি বিষয় নয়। অনেক ভাল শিল্পীরাও হৃষ্টপুষ্ট কেশরওয়ালা সিংহের ছবি আঁকতে পারেন না। এর যে প্রভাব লাল দুর্গ পুরুলিয়ার ভোটে পড়বে তা কে জানত?
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট সমর্থিত পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী নরহরি মাহাতো হেরে যান। তারপর তাদের জেলা সম্মেলনে সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে তাঁরা স্বীকার করেন, কেশরওয়ালা, হৃষ্টপুষ্ট সিংহের ছবি ভালভাবে না আঁকাতেই এমন বিপর্যয়! তারপর থেকেই ফরওয়ার্ড ব্লক হাঁ করা সিংহের প্রতীক আঁকতে রীতিমতো ছাঁচ ব্যবহার করে দেওয়ালে দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলছে। যাতে একেবারে ভয়ার্ত সিংহের মুখ ফুটে ওঠে।
[আরও পড়ুন: ‘আজ ১১ ঘণ্টা, দরকারে ২৪ ঘণ্টা থেকে সহযোগিতা করব’, ইডি দপ্তর থেকে বেরলেন সায়নী ঘোষ]
তার জন্য যে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে তার মুখই ঢেকে দেবেন, তা ভাবতে পারছেন না কমরেডরা। পুরুলিয়ার বাসিন্দা দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অসীম সিনহা বলছিলেন, “আমাদের সিংহ প্রতীক নিয়ে নানান ঘটনা রয়েছে। কিন্তু সেই হাঁ করা সিংহ দেখে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এমন কখনও হয়নি।” ঘোঙা গ্রাম পঞ্চায়েতের ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী টগর রাজোয়াড়, মুটুকা প্রামানিকের বক্তব্য, “কী বলব বলুন? গ্রামের মানুষের কথা তো শুনতেই হবে। গ্রামে ঢোকার মুখে হাঁ করা সিংহের মুখ দেখে গরু, মহিষ, ছাগল, এমনকী গাঁয়ের ছোটরা ভয় পাচ্ছে। তাই বস্তায় ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবে এতে কোনও অসুবিধা হবে না। বরং এই কাজে আমাদের প্রতীক আরও জনপ্রিয় হয়ে গেল।”