shono
Advertisement

বাংলার ‘হুমায়ুন নামা’, নেহরু জমানা থেকেই চলছে দলবদলের রাজনীতি!

ভারতীয় রাজনীতিতে 'ইজম'-এর বুঝি মৃত্যু ঘটেছে বহুদিন।
Posted: 03:13 PM Jun 30, 2023Updated: 05:00 PM Jun 30, 2023

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ভারতীয় রাজনীতিতে ‘ইজম’-এর বুঝি মৃত্যু ঘটেছে বহুদিন। বরফের কফিনে রাখা শবদেহের মতোই গণতন্ত্র আজ ফ্যাকাশে। দলবদলের রাজনীতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে, যে ‘বিশ্বস্ত’ লোক সকালে জান কবুল করেছে, বিকেলে সেই হয়তো বিরোধী শিবিরের জামাই আদরে আপ্লুত। এই প্রেক্ষাপটেই বাংলার রাজনীতিতে জোর জল্পনা উসকে দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের ‘বিদ্রোহী’ বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। তবে বাংলার ‘হুমায়ুন নামা’র বিস্তার কয়েক দশক জুড়েই। মূলত তিন ‘কবীরের কীর্তি’ নিয়েই এই রচনা।

Advertisement

মুর্শিদাবাদের হুমায়ুন কবীর

ভরতপুর থেকে তৃণমূলের বিধায়ক। তবে বরাবরের মতোই প্রশ্নের মুখে তাঁর আনুগত্য। পঞ্চায়েত ভোটের আবহে বেসুরো বেজে জল্পনা তৈরি করেছেন তিনি। পঞ্চায়েতের টিকিট বিলি নিয়ে তাঁর ক্ষোভের অন্ত নেই। বি্ধায়ক হুমায়ুন কবীরের দাবি, মাত্র ৫ শতাংশ টিকিটের অংশীদারিত্ব পেয়েছেন তিনি। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে অপূর্ব সরকার নিজে চেয়ারম্যান হয়ে বেশি আসন সরবরাহ করছেন। অন্যদিকে, একজন হেরে যাওয়া বিধায়িকা শাওনি সিংহ রায় লালবাগ ও ডোমকলে নিজের মনমতো প্রার্থী নির্বাচন করেছেন। তারপরই ডোমকলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার পালটা সভা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যদিও শেষমেশ সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন তিনি।

সবাই জানে, রাজনীতির আলো এবং ক্ষমতার বৃত্তে থাকতে বার বার দল বদলেছেন হুমায়ুন কবীর। তাঁর বাড়ি রেজিনগরে। কংগ্রেসের টিকিটে রেজিনগর থেকেই বিধায়ক ছিলেন। মাঝপথে ছেড়ে দেন। সেটা ২০১৩ সাল। তৃণমূলের টিকিটে উপনির্বাচনে লড়েন এবং হারেন। আপাতত তিনি ভরতপুর থেকে তৃণমূলের বিধায়ক। নয়ের দশকে বহরমপুরের সাংসদ তথা হেভিওয়েট কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর হাত ধরেই মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতে উত্থান কবীরের। ১৯৯৯ সালে অধীর প্রথম বার সাংসদ হন। সেই ফলক ছুঁতে অধীরকে নাকি সাহায্য করেছিলেন হুমায়ুনও। ফলে ২০১১ সালে ‘পুরস্কার’ হিসেবে রেজিনগর থেকে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের প্রার্থী হন হুমায়ুন। প্রথম বারেই জয় পান। তবে বহু চমক বাকি ছিল তখনও। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ভেঙে যায়। তৃণমূল সরকার থেকে কংগ্রেসের পাঁচ মন্ত্রী পদত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। শোনা যায়, তখন ইংরেজবাজারের কংগ্রেস বিধায়ক কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে রেজিনগরের বিধায়ক হুমায়ুনকেও মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিল তৃণমূল। ২০১২ সালের নভেম্বরে কৃষ্ণেন্দু-হুমায়ুন দু’জনেই তৃণমূলে যোগ দেন। মন্ত্রিত্ব পেতে দেরি হয়নি। প্রাণিসম্পদ বিকাশ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী হন হুমায়ুন। তবে ছ’মাস পরে নিয়ম মেনে বিধায়ক পদ ছেড়ে উপনির্বাচনে জিততে হত। কৃষ্ণেন্দু জিতেছিলেন। হুমায়ুন হেরেছিলেন।

তারপরই দলের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন হুমায়ুন। ‘মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ভাইপোকে রাজা করতে চান’ মন্তব্য করে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের রোষানলেও পড়েন। ২০১৫ সালে তাঁকে সাসপেন্ড করে তৃণমূল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রেজিনগর কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী হন হুমায়ুন। হাজার তিনেক ভোটে কংগ্রেসের রবিউল চৌধুরীর কাছে হেরে যান। কিন্তু রবিউল কিছু দিন পরেই তৃণমূলে যোগ দেন। ফলে হুমায়ুনের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন আরও কঠিন হয়ে যায়।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে অধীরের প্রস্তাবে কংগ্রেসে ফেরেন হুমায়ুন। ২০১৮ সালে কংগ্রেসের হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলায় পঞ্চায়েত ভোটে নেতৃত্বও দিতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু প্রত্যাবর্তন স্থায়ী হয়নি। ২০১৮ সালে কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থীও হন। হারেন। পরের বছরই বিজেপি ছাড়েন। ২০২১ সালের ভোটের আগে আবার তৃণমূলে। তবে এ বার আর রেজিনগরে নয়। ভরতপুরে। জিতেও যান।

আইপিএস থেকে রাজনীতিবিদ হুমায়ুন

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য এই আইপিএস চাকরিজীবন থেকে অবসর নিয়েই রাজ্যের শাসকদলে যোগ দেন। আর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই গত বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলেন মুখ্যমন্ত্রী। হুমায়ুনবাবু আসলে ডেবরার ভূমিপুত্র হলেও, সেভাবে কোনওদিন ডেবরায় থাকা হয়নি তাঁর। তাই নিজেকে ডেবরার ভূমিপুত্র হিসেবে সেভাবে এখনও মেলে ধরতে পারেননি। দলেও সমস্যা কম ছিল না । এলাকায় তৃণমূলের (TMC) গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল ব্যাপক। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্যই সেবার ডেবরার বিধায়ক সেলিমা খাতুনকে প্রার্থী করেনি শাসকদল। স্বভাবিকভাবেই অসন্তোষ ছিল শাসকদলের কর্মীদের একাংশের মধ্যেও। তবে প্রাক্তন পুলিশকর্তা লড়াইয়ে উতরে যান। গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রথমবার বিধায়ক হন। হয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃতীয় তৃণমূল সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়ে যান। যদিও তার মেয়াদ বেশি দিন ছিল না। কিছু ব্যক্তিগত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় তাঁকে মন্ত্রীর পদ খোয়াতে হয় বলেই প্রশাসনের অন্দরে খবর।

বরাবরই শাসক ঘনিষ্ট বলে পরিচিত হুমায়ুন। বাম জমানাতেও তাঁর শাসকপ্রীতি নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে তাঁকে মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। শোনা যায়, সেই সময়ে তাঁর কাজে বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। কর্মজীবন শেষ হওয়ার চার মাস আগে ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি আচমকাই চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।

গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী ভারতী ঘোষকে (প্রাক্তন আইপিএস) পারাতেও বর্তমানে দলে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছেনা না তিনি বলেই খবর। দলের অনেকে বলেন, কলকাতার বাড়িতে বসেই নাকি ডেবরা সামলান তিনি। তবে তাঁর হিতৈষীরা জানাচ্ছেন, একেবারেই না। বিধায়ক হিসেবে কেন্দ্রে নিয়মিত যান হুমায়ুন।

[আরও পড়ুন: সভায় TMC নেতার মাথায় ছাতা ধরে পুলিশ! ভিডিও পোস্ট করে কটাক্ষ শুভেন্দুর, কী বলছে তৃণমূল?]

নেহরু জমানার মন্ত্রী হুমায়ুন

ইনিও হুমাবুন কবীর। রাজ্যের সাংসদ ছিলেন। জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীও ছিলেন। তবে শেষের দিকে অবশ্য অজয় মুখোপাধ্যায়ের কংগ্রেস ছেড়ে বাংলা কংগ্রেসে যোগ দেন। রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান পতনের সাক্ষী থেকেছেন তিনি। বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোমারপুরে ১৯০৬ সালে হুমায়ুন কবীরের জন্ম। ছাত্র জীবনের তাগিদে কলকাতায় আসেন। তখনকার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করেন তৃতীয় স্থান পেয়ে। এর পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া এবং দুর্দান্ত রেজ়াল্ট। এর পরে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের ডাকে অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ। শিক্ষাবিদ হিসেবে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কেন্দ্রের শিক্ষাসচিব থেকে শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান। নেহেরু মন্ত্রিসভার পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন এই হুমায়ুন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে মাদ্রাজের রাজ্যপালের পদে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে অনুরোধ উপেক্ষা করেন।

একটা বড় সময় রাজ্যসভায় কংগ্রেস সাংসদ হুমায়ুন বসিরহাট লোকসভা আসনেও জিতেছিলেন কংগ্রেসের টিকিটে। কিন্তু সেটা পাঁচ বছরের জন্য। ১৯৬৭ সালে তিনি মূল কংগ্রেস থেকে সরে গিয়ে বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হন। অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জিতেওছিলেন। কিন্তু পুরো মেয়াদ সাংসদ থাকতে পারেননি। ১৯৬৯ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন গুরুত্বের সঙ্গে শুরু করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত আর তত গুরুত্বপূর্ণ থাকেননি। সব মিলিয়ে বাংলার হুমায়ুন নামা যে যথেষ্ঠ বর্ণময় তা বলাই যায়।

[আরও পড়ুন: অভিমানে দলবদল প্রাক্তন কংগ্রেস নেত্রীর, বাহাত্তরের গীতাতেই আস্থা বিজেপির]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
toolbarHome ই পেপার toolbarup অলিম্পিক`২৪ toolbarvideo শোনো toolbarshorts রোববার