shono
Advertisement

পদ্মার মায়া, ভালবাসার চোরাকারবার আর বাঙালির ‘বিসর্জন’

সরোজ দরবার: বাংলাদেশে আটকে পড়ে ভারতীয় যুবক নাসির আলি (আবির চট্টোপাধ্যায়)। তাঁকে আশ্রয় দেয় বিধবা পদ্মা (জয়া এহসান)। এদিকে পদ্মাকে বিয়ে করতে চায় মীন ব্যবসায়ী গণেশ মণ্ডল (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়)। আখ্যান এমনই আপাত সরল। এগোয় পায়ে ইতিহাস জড়িয়ে। আসলে ‘বিসর্জনের গল্পটা মিথ্যে’… অথচ কী আশ্চর্য সেই মুহূর্ত! কী বিধুরতা নিয়ে চমৎকার! কী নিষ্ঠুর সুন্দর! যখন পদ্মার বুকে মুখ […] The post পদ্মার মায়া, ভালবাসার চোরাকারবার আর বাঙালির ‘বিসর্জন’ appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 08:05 AM Apr 16, 2017Updated: 04:41 PM Jul 13, 2018

সরোজ দরবার: বাংলাদেশে আটকে পড়ে ভারতীয় যুবক নাসির আলি (আবির চট্টোপাধ্যায়)। তাঁকে আশ্রয় দেয় বিধবা পদ্মা (জয়া এহসান)। এদিকে পদ্মাকে বিয়ে করতে চায় মীন ব্যবসায়ী গণেশ মণ্ডল (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়)। আখ্যান এমনই আপাত সরল। এগোয় পায়ে ইতিহাস জড়িয়ে। আসলে ‘বিসর্জনের গল্পটা মিথ্যে’…

Advertisement

অথচ কী আশ্চর্য সেই মুহূর্ত! কী বিধুরতা নিয়ে চমৎকার! কী নিষ্ঠুর সুন্দর! যখন পদ্মার বুকে মুখ রেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে তরুণ ভারতীয় ‘অতিথি’ প্রেমিক। অতিথি তো ভগবান। তাকে কী করে ফেরায় পদ্মা? ফেরায় না। অতি সঙ্গোপনে রেখে দেয় কাছে। শুধু যখন রাত নয়, দিনও নয়, প্রায় নৈস্বর্গিক এমন এক মুহূর্তে প্রেমিকা পদ্মা ‘বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে’, এমত জয়া এহসান তাঁর সজল দৃষ্টি মেলে ধরে আবিরের চোখে। আর কিছু নয় কেবল মনে করিয়ে দেয়, বিসর্জনের পর ফিরে তাকাতে নেই। কাঁটাতারের অদৃষ্ট মানা তার পলাতক প্রেমিক, তখন অতি গোপনে চোরাকারবারি হয়ে বুকে আগলে রাখে সেই আতরঢালা আদর। কী অদ্ভুত এ বিসর্জন! যখন প্রেমিকা পদ্মা মিশে যায় গৃহিণী পদ্মায়। ভাল থাকে সে। আর ভাল থাকার ছাড়পত্র হাতে দিয়ে উচ্ছ্বলা পদ্মার দখল নেয় মীন ব্যবসায়ী। কোথায় তখন তার পুরনো প্রেমিক? জানে না সে। যেন তার ঢেউয়ে ভাসে সুধীন দত্তের পংক্তিরা, ছলাৎ ছল বলে, ‘সে এখনও বেচে আছে কিনা/ তা শুদ্ধ জানি না।’ পদ্মা শুধু তাকিয়ে থাকে তার ভালবাসার জন্মদাগের দিকে। কাঁটাতার যেখানে নির্বোধের মতোই ব্যর্থ ও মিথ্যা। যে ভালবাসার রক্ষাকবচ শুধু ভালবাসাই। পদ্মাকে সে ভালবাসা তুলে দিয়ে নীরবে হেসে ওঠে ইছামতী। আর আমরা ভিড় করি ‘বিসর্জন’ দেখতে। দেখিও। শুধু টের পাই না বিসর্জন ঘটে যায় কোন অলক্ষে। হয়তো প্রতিদিনই এভাবে পার ভাঙে পদ্মার।

কী আশ্চর্য এই মিতকথন কাহিনীকার কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের। বিষয় এমন স্পর্শকাতর। অথচ একটুও অতিকথন নেই, নেই নিজের মতামত। যেন প্রবহমান সময় নদীর দু-এক আঁজলা ফ্রেমবন্দি করেছেন মাত্র। কিন্তু সিনেমাওয়ালার কাজ কী সেখানেই শেষ? নাহ, আছে তো সমকালীন রাজনীতি, পরিস্থিতি। আছে তো বিভাজন, ব্যর্থতা, প্রশ্ন এবং সর্বোপরি বিসর্জন। মসৃণ মীড়ের মতো ছবির পরতে পরতে মিশে থেকেছে তা। কোথাও তা বিশেষ সাড়াশব্দ করে না। কিন্তু কে না জানে নৈশঃব্দও কখনও প্রবল অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে! শৌভিক বসুর চিত্রগ্রহণও যেন সেই পথ ধরে। দেগে দেখানো নেই অথচ পায়ে পায়ে এক ক্লান্ত ইতিহাস যেন ফ্রেমবন্দি হয় একখানি আপাত প্রেমের গল্পে।

আর জয়া এহসান, তিনি তো এ ছবির প্রাণপ্রতিমা। তাঁর পদ্মা তো ইতিহাস থেকে ছেনে আনা বর্তমান। সুতরাং একাধিক ক্লোজ শটে তাঁকে ধরা দিতেই হত। যে পদ্মার বিবাহ কাকতাড়ুয়ার মতোই মিথ্যা এবং প্রবল কৌতুক, তাঁকে তো দিনের বিধবা আর রাতের ছেনালের মধ্যে ফারাক স্পষ্ট করে দিতে হত মুখের রেখায়। তার দমিত বাসনাকে তো মেলে ধরতেই হত ঠোঁটের প্রজাপতি কাঁপনে। দক্ষ অভিনেত্রী জয়া তা করেছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন, পদ্মা কেন চিরকালীন প্রেমিকা হয়ে থাকতে পারে। অবশ্য ওই কুদর্শন গণেশ মণ্ডল বিপরীতে না থাকলে যেন এত নিংড়ে বের হত না তাঁর অভিনয় দক্ষতা। কী স্বাভাবিক, এন্টারটেইনিং অথচ অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, গণেশ হয়ে। তুলনায় আবিরের মতো অতি দক্ষ অভিনেতা এই দু’জনের কাছে যেন একটু ফিকে হয়ে গিয়েছেন। না কোথাও কমতি ছিল না অভিনয়ে। তাঁর মুখের পেশি কেঁপেছে ভয়ে, বিষাদে, ভালবাসায়। তাঁর চোখের কোণ লাল হয়ে উঠেছে ইতিহাসের বিভাজনের রক্তাক্ত ভোর হয়ে। তবু কোথাও একটা নাগরিক ছাপ থেকে যায় তাঁর অভিব্যক্তিতে। যা হয়তো কখনও সখনও আলাদা করে চোখে পড়ে যায় । তবু এই তিনের অভিনয়েই তৈরি হয় বিসর্জনের কাঠামো। যে কাঠামোয় মাটি দেয় প্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সুর, কণ্ঠ। হায়, এত মায়া থেকে যায় তাঁর গানে, এত মায়া লেগে থাকে পদ্মায়, তবু মায়ার বাঁধন কেটে যায়। এটাই বাস্তব।

বাস্তব এই যে, একদিকে ভারত আর অন্যদিকে বাংলাদেশ। তাহলে ইছামতী কার? প্রশ্ন করে ছবির ছোট্ট খুদেটি। উত্তরে কথা ঘোরায় তার মা। বিভাজনের ইতিবৃত্তের এই মৌনতাটুকুই বাঙালির অবিভাজিত সত্তার বিসর্জন। তার তো কোনও উত্তর থাকতে নেই। এই পদ্মার উপর দিয়ে যেতে যেতে নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন ঋত্বিককুমার ঘটক। সত্যজিতের হাত ধরে বলেছিলেন, বাংলাদেশটাও বিদেশ হয়ে গেল। সেই বিদেশ জেগে থাকে এ ছবির অন্তরালেও। আর এদিকে ভারতের বুকে জেগে থাকে পদ্মার প্রেম। পদ্মা শুধু চোখ রাখে তার ভালবাসার জন্মদাগে। কী অদ্ভুত এই ত্রিকোণ! আর এরই মাঝখানে জেগে থাকে কাঁটাতার। জল না ছাড়ার অভিযোগ। জেগে থাকে মীন ব্যবসা-চোরা কারবার। এ সবের ভিতরেই তাই কোথাও বেজে ওঠে দশমীর বাজনা। হ্যাঁ এই আদ্যন্ত নাগরিক সমাজে, দেশভাগের যন্ত্রণা ভুলতে বসা প্রজন্মের মনেও। কৌশিকের ‘বিসর্জন’ ঠিক সেখানেই প্রবল অস্বস্তি নিয়েই এগিয়ে যায় সাফল্যের সোপানে।

The post পদ্মার মায়া, ভালবাসার চোরাকারবার আর বাঙালির ‘বিসর্জন’ appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement