বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: মেরুকরণের ভোটের অঙ্কে অথৈ জলে বাম-কংগ্রেস। তাদের ভোটে এবার তৃণমূলের থাবা। সেই ধাক্কায় উত্তরে গেরুয়া শিবির জয় অব্যাহত রাখলেও প্রাপ্ত ভোটে ভাটার টান। পাশাপাশি বাম-কংগ্রেস জোটের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে। ফলাফলের ময়নাতদন্তে এমন তথ্য উঠে আসতে বাম নেতৃত্ব অকপটে স্বীকার করছেন মিছিলে, সভায় যারা ভিড় করেছেন তাদের বেশিরভাগ বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থীদের ভোট দেয়নি।
রাজনৈতিক মহলের মতে, গৌড়বঙ্গ উত্তরের চারটি আসন দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারে এবার ভোটের ফলাফলে মেরুকরণের ছবি স্পষ্ট। জনমত আড়াআড়ি ভাবে দুই ফুল শিবিরে বিভক্ত হয়েছিল। হয় পদ্ম, নয় ঘাসফুল। মধ্যে কেউ নেই। তারই পরিণতিতে বাম-কংগ্রেসের ক্ষয়িষ্ণু সংসারে ফের রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। তাদের ভোট নীরবে ঘরে তুলে বিজেপির সঙ্গে টক্কর দিয়েছে তৃণমূল। এদিকে বাম-কংগ্রেসের যে ভোট সাফ করে ২০১৯ নির্বাচনে মহীরুহ হয়ে উঠেছিল গেরুয়া শিবির। সেই ভোটও ফুল পরিবর্তন করে তৃণমূল শিবিরে ভিড়তে শুরু করায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার এবং জয়ের ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
[আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রে বিপর্যয় বিজেপির, ইস্তফা দিতে চান ফড়নবিস]
এবারের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল বাম-কংগ্রেস শিবিরকে পুরোপুরি দুরমুশ করেছে কোচবিহার আসনে। তাদের প্রায় ৬৫ হাজার ভোট কৌশলে ঘরে তুলে নিয়েছে ঘাসফুল শিবির। এদিকে গেরুয়া শিবিরে চলে যাওয়া বাম ভোটের অনেকটাই ফিরিয়ে নিতে সফল হওয়ায় জয়ের পথ মসৃণ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ওই আসনে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ৮১০ এবং কংগ্রেস প্রার্থী ২৮ হাজার ২১৫। ওই দুই ভোটের যোগফল ছিল ৭৫ হাজার ২৫ ভোট। এবার নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ১০ হাজার ৬৭৯ ভোট। প্রশ্ন বাকি ভোট গেল কোথায়? রাজনৈতিক মহলের মতে, এবার কোচবিহার আসনে ১ লক্ষ ১১ হাজার বেশি ভোট পেয়েছে তৃণমূল। বামেদের প্রায় ৬৫ হাজার ভোট তার একটি অংশ। বাকিটা এসেছে বিজেপিতে চলে যাওয়া বাম ভোট ভাঙিয়ে। পাশাপাশি রাজবংশী ভোটের অংশীদারি এবার অনেকটাই বেড়ে যাওয়ায় তৃণমূলের জয় এসেছে।
দৃশ্যত একই মেরুকরণের ট্রেন্ড ছিল জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং আসনেও। আলিপুরদুয়ার আসনে বাম-কংগ্রেসের প্রায় ৪২ হাজার ভোট তৃণমূলের ঘরে চলে গিয়েছে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ওই আসনে আরএসপি পেয়েছিল ৫৪ হাজার ১০ ভোট। কংগ্রেস প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৭ হাজার ৪২৭। এবার নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৩৯ হাজার ৭০৯ ভোট। ওই আসনে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার। অন্যদিকে বিজেপির ভোট কমেছে প্রায় ৫৪ হাজার। রাজনৈতিক মহলের মতে একদিকে বাম-কংগ্রেস জোট শিবিরে টিকে থাকা ভোট এবং অন্যদিকে বিজেপি শিবিরে চলে যাওয়া বাম ভোটের কিছু অংশ দখলে নিয়ে ভোটের ব্যবধান কমিয়ে এনেছেন তৃণমূল প্রার্থী। কিন্তু জয় আসেনি। কারণ চা বলয়ের আদিবাসী ভোটের বড় অংশ গেরুয়া শিবিরে আস্থা রেখেছে।
[আরও পড়ুন: ভোটবাক্স খুলতেই উধাও ৩০ লক্ষ কোটি টাকা! বাজারকে প্রভাবিত করতেই কি এক্সিট পোল ‘স্ক্যাম’?]
একইভাবে জলপাইগুড়ি আসনে বাম-কংগ্রেসের ঘরে রীতিমতো সিঁদ কেটে ৩০ হাজার ভোট তুলে নিয়েছে তৃণমূল শিবির। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে এখানে কংগ্রেস প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৮ হাজার ৫৬২ এবং সিপিএম প্রার্থীর ৭৬ হাজার ১৬৬। অর্থাৎ জোটের সম্মিলিত ভোট ছিল ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ২৮। কিন্তু এবার নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৭৪ হাজার ৯২ ভোট। কার্যত বাম-কংগ্রেস জোটে টিকে থাকা বাকি ভোট এবং বিজেপি যে বাম ভোটে পুষ্ট হয়েছিল সেখানে থাবা বসিয়ে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় এবার তৃণমূল ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৩৪ ভোট বাড়িয়ে নিয়েছেন । কিন্তু চা বলয়ের ভোটের বড় অংশ পক্ষে থেকে যাওয়ায় এখানে গেরুয়া শিবিরকে টপকে যাওয়া তৃণমূলের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে দার্জিলিং আসনে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫০ হাজার ৫২৪ এবং কংগ্রেসের ৬৫ হাজার ১৮৬ ভোট। বাম-কংগ্রেস জোটের সম্মিলিত ভোট ছিল ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৭১০। কিন্তু এবার কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৮৩ হাজার ৩৭৪ ভোট। অন্যদিকে ২০১৯ নির্বাচনের তুলনায় তৃণমূলের ভোট ৩ লক্ষ ৩৬ হাজার ৬২৪ থেকে বেড়ে ৫ লক্ষ ৮০৬ হয়েছে। বিজেপির ভোট কমেছে প্রায় ৮১ হাজার।
প্রশ্ন উঠেছে কেন বাম এবং কংগ্রেস শিবির নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারেনি? আরএসপি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্মল দাস বলেন, "ভোটদাতারা দুই ফুলে বিভক্ত হয়েছিলেন। মেরুকরণের রাজনীতিতে আমরা নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারিনি।" নির্মলবাবুর মতোই অন্য বাম নেতৃত্ব রাখঢাক না রেখেই বলছেন, মিছিলে, সভাতে ভিড় দেখে আশা জেগেছিল। কিন্তু যারা মিছিলে, সভায় ভিড় করেছেন তাদের বেশিরভাগ ঘাসফুলে ভোট দিয়েছেন। জলপাইগুড়ি জেলা সিপিএম সম্পাদক সলিল আচার্য বলেন, "বাম ভোট স্যুইং করেছে।" একই বক্তব্য দলের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক সমন পাঠক এবং প্রাক্তন আলিপুরদুয়ার জেলা কংগ্রেস সভাপতি মণি ডার্নালের।