উত্তরপ্রদেশে দুর্নীতি কোনও ইস্যু নয়, উন্নয়ন এক্সপ্রেস হাইওয়ে বা নয়ডার বিমানবন্দর কোনও ইস্যু নয়, এমনকী, মন্দির-মসজিদও এখনও পর্যন্ত বড় ইস্যু নয়। মূল প্রশ্ন এখনও জাতপাত। কিন্তু জাতপাতের ঊর্ধ্বে সে-রাজে্য ‘মমতা’-র পরিচিতি মস্ত বড় রাজনৈতিক অস্ত্র। অখিলেশের লড়াই সহজ নয়। সে লড়াইয়ে অখিলেশের কাছে রাহুল গান্ধীর চেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়োজনীয়তা বেশি। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, এই রাজ্যের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের একজন উত্তরপ্রদেশের যাদব পরিবারকে সাহায্য করতে গিয়েছেন। সুকান্তবাবু অধ্যাপক। বয়সে নবীন। আধুনিক মানুষ বলেই জানতাম। কিন্তু যেভাবে তিনি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়-যাদব’-এর সমীকরণ উল্লেখ করে জাতপাতের রাজনীতির দৃষ্টান্ত দিয়েছেন- তা দেখে বিস্মিত হলাম! কারণ মমতার পরিচিতি কিন্তু ব্রাহ্মণ পরিচয়-সত্তার সঙ্গে যুক্ত নয়, যেমন নরেন্দ্র মোদিকে কেউ ‘ওবিসি নেতা’ বলে না। সুকান্তবাবু বিজেপির দলীয় বাধ্যবাধকতা থেকেই জাতপাতের কথা বলেছেন। আমরা, বাঙালিরা হয়তো এখনও ব্রাহ্মণ বনাম ঠাকুর বনাম ওবিসি রাজনীতি পছন্দ করি না, কিন্তু এখন উত্তরপ্রদেশের ভোট রাজনীতিতে উন্নয়ন নয়, জাতপাতই প্রধান বিবেচ্য। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, গৈরিক বসনধারী, নাথ সম্প্রদায়ের সাধু কিন্তু গোরখপুরের ঠাকুর নেতা। নাথ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী হাতে অস্ত্র নিয়ে রাজশক্তির জন্য লড়তে পারেন, তাও চন্দ্রগুপ্তের ‘ভারতবর্ষ’-এ নয়, মাফিয়া-সমাজবিরোধীর উত্তরপ্রদেশে, মুসলমান-বিরোধী হিন্দুত্ববাদী লক্ষ্যপূরণে- এটাও বাঙালির পক্ষে বোঝা কঠিন, কারণ আমাদের গৈরিক বসনধারী স্বামীজির ত্যাগমহিমায় জেড প্লাস সিকিউরিটির রাজনীতি ছিল না।
এবার প্রচারে যোগী বলছেন, রাম ক্ষত্রিয় ছিলেন। রাজা। তাই আমি তো তারই জাত। সঙ্গে সঙ্গে সমাজবাদী পার্টির নেতা ‘গুগল’মামার সাহায্য নিয়ে বলেছেন, সে কী যোগীজি! ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজস্থানে গিয়ে প্রচারকালে আপনি না বলেছিলেন, আপনার জাত হনুমানের জাত? হনুমান বনবাসী জাতি। এখন উন্নয়নের চেয়েও বড় প্রশ্ন, আপনি রামের জাত না হনুমানের জাত? বিজেপির এক ওবিসি রাজ্য-নেতা রামশংকর বিদ্যার্থী বললেন, টেক ইট ফ্রম মি। ‘গোন্ডওয়ারা’ হল হনুমানের জন্মস্থান। হনুমান তাই আমার মতো গোন্ডবাসী নিম্নবর্গ। বিজেপির মন্ত্রী লক্ষ্মীনারায়ণ বলেছেন, হনুমান আসলে জাঠ। আরও এক ধাপ এগিয়ে সমাজবাদী পার্টির নেতা বাক্কি নামাহ্ বলেছেন, হনুমানের ধর্ম ছিল আসলে ইসলাম। তিনি মুসলিম। কী কাণ্ড! কী কাণ্ড! সুকুমার সেন, অতুল সুররা তো এখন বেঁচে নেই। আন্দ্রে বেঁতে বা দীপঙ্কর গুপ্তর মতো সমাজতাত্ত্বিকরা রক্ষে করুন এই রাজনীতিবিদদের। দোহাই, হে রাম!
[আরও পড়ুন: বিনয়-বাদল-দীনেশ আসলে যোদ্ধা বাঙালির গল্প, সিনেমা নয়, বাস্তবে কেমন ছিল তাঁদের লড়াই?]
তা এই হল আমাদের আজকের ‘উলটাপ্রদেশ’। অখিলেশ যাদব এ-রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গেলেন, তিনি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ বলে নয়। ২০২১-এ বিজেপির রথের চাকা বঙ্গের মাটিতে বসে গিয়েছে। বিজেপিকে তিনি পরাস্ত করতে পেরেছেন তাই সমগ্র দেশে মোদিবিরোধী ব্র্যান্ড ইকুইটি এখন তাঁর প্রবল। বিরোধী রাজনীতির একত্রিকরণে তিনি এখন প্রধান চুম্বক। লাল রং অখিলেশের রং। মোদি তাঁকে ‘লাল টুপিওয়ালা’ বলে চিহ্নিত করেন, আর মমতা সেই লাল ফুটবল ছুড়ে ‘খেলা হবে’ বলে লখনউ তখ্তে বিজেপিবিরোধী ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভোটব্যাংকে অ্যাড্রিনালিন নিঃসরণ ঘটিয়েছেন। আর তাই সে-রাজ্যে তৃণমূলের এমএলএ, এমপি না থাকলেও ‘মমতা’-র পরিচিতি মস্ত বড় রাজনৈতিক অস্ত্র। অখিলেশের লড়াই সহজ লড়াই নয়। সে লড়াইয়ে অখিলেশের কাছে রাহুল গান্ধীর চেয়ে মমতার প্রয়োজনীয়তা বেশি।
এই হল লখনউ তখ্ত। এ-দেশের ১৪ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ন’জন প্রধানমন্ত্রী দিয়েছে এ-রাজ্য। ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের ৪০৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি ৩১২টি আসন পেয়েছিল। আপনাদের দ্রুত মনে করিয়ে দিই, কংগ্রেস পায় সাতটি আসন, অখিলেশ ৪৭টি আসন। মায়াবতী এযাবৎ সবচেয়ে কম, মাত্র ১৯টি আসন পেয়েছিলেন। পাঁচ বছর রাজত্ব করার পর যোগী-রাজের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ যে নেই, তা তো নয়। দারিদ্র, কর্মহীনতা, উন্নয়ন- এসব ইস্যু দেখা যায় না, কিন্তু ভোটার মনস্তত্ত্বের অবচেতনে যে থাকে না, তা নয়। তার উপর থানায় থানায় যোগী ‘ঠাকুর’ পুলিশ বসিয়ে ঠাকুররাজ কায়েম করেছেন, এমন অভিযোগ প্রবল। যেমন, একদা মুলায়ম-জমানায় যাদব-রাজ বা মায়াবতীর রাজত্বে বাহুবলী দলিত-রাজ কায়েম হয় বলে অভিযোগ ছিল। নরেন্দ্র মোদি বারবার নিজে গিয়ে সর্বভারতীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রর হিন্দু হৃদয়সম্রাটের রাজধর্মর ভাবমূর্তি প্রচার করছেন। ভোটে তো শুধু একটা ‘ফ্যাক্টর’ থাকে না। যদি দাঙ্গা-ফাসাদ বা পুলওয়ামা আক্রমণ ফ্যাক্টর হওয়ার কথা মাথায় রাখতে হয়, তাহলে একটা কথা বলাই যায়। ভোটপর্ব সবে শুরু হয়েছে, পরবর্তী ‘ফেজ’-এ কী হবে জানি না, কিন্তু এখনও পর্যন্ত বলা যায়, অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ বা বেনারসের গঙ্গাস্নানের স্থানীয় প্রভাব থাকলেও গোটা রাজ্যে প্রধান ঝড় তোলার মতো ইস্যু তা হয়নি। আলিগড়, মেরঠ আর বেনারস এক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু অনেক দূর।
উত্তরপ্রদেশ থেকে উত্তরাখণ্ড আলাদা হয়েও এ-রাজ্য বড় রাজ্য। পাকিস্তান বা ব্রাজিলের সমান আয়তন। তাই এখনও এ-রাজ্য সবচেয়ে জটিল রণক্ষেত্র। আগে বলা হত, ইউনাইটেড প্রভিন্স। ১৯৪৬ সালে প্রভিন্সিয়াল বিধানসভা গঠিত হয়। যা ছিল ১৯৫২ সাল পর্যন্ত। ’৬৭ সাল পর্যন্ত ছিল কংগ্রেসের শাসন। ১৯৫২ সালে ৪৩০টি আসনে কংগ্রেস ৩৮৮টি আসন পেয়েছিল। গোবিন্দবল্লভ পন্থের মতো ব্রাহ্মণ নেতা ছিলেন প্রভিন্সিয়াল রাজ্যেরর প্রিমিয়ার, তারপর ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী। তিনি দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে চলে এলে সংস্কৃত পণ্ডিত ড. সম্পূর্ণানন্দ হন মুখ্যমন্ত্রী।
নেহরুর সময় থেকেই উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস-রাজনীতিতে ব্রাহ্মণ-আধিপত্য প্রবল হয়ে ওঠে। উপাধ্যায় বনাম গুপ্তার লড়াইয়ের মধ্যে ’৪৮ সালেই রফি আহমেদ কিদওয়াইয়ের সমাজতন্ত্রী গোষ্ঠী কংগ্রেস ছেড়ে দেয়। কংগ্রেসের দলাদলি খেয়োখেয়ি দেখে ব্যথিত, ক্ষুব্ধ নেহরু তাঁর সহকর্মী মোহনলাল সাক্সেনাকে এক চিঠিতে লেখেন, দলীয় রাজনীতির জন্য উত্তরপ্রদেশের সম্মান ধুলোয় লুণ্ঠিত হচ্ছে। কাঁসিরাম যে বহুজন আন্দোলন শুরু করেন, তা এই মনুবাদী ব্রাহ্মণ জাতির বিরুদ্ধে। কাঁসিরাম বলতেন, উত্তরপ্রদেশকে ‘ব্রহ্মবর্ত’ বলা হত। এ নাকি ব্রহ্মার এলাকা। ব্রাহ্মণ আর ঠাকুরদের মধ্যেও লড়াই ছিল। পরশুরাম ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয়-নিধন শুরু করেন। রাম আর পরশুরাম তাই দুই ভিন্ন জাতকে প্রতিনিধিত্ব করে। কমলাপতি ত্রিপাঠি থেকে নারায়ণ দত্ততিওয়ারি- কংগ্রেস দলে ছিল ব্রাহ্মণ ভোটের আধিপত্য, তার সঙ্গে ছিল মুসলিম ও গান্ধীর হরিজন সমাজ। ব্রাহ্মণ অভিজাততন্ত্র কংগ্রেস নেতৃত্বকে গ্রাস করল বলেই যাদবদের দল, বহুজন সমাজের দলভিত্তিক আলাদা দল হল।
লালকৃষ্ণ আদবানি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্দোলনকে দলীয় কর্মসূচি করে হিন্দুত্ববাদী ভোটব্যাংকে ক্ষত্রিয় ও ওবিসি নিম্নবর্গের হিন্দুদেরও শামিল করলেন। সে এক সাংঘাতিক জাতপাতের ইঞ্জিনিয়ারিং। চরণ সিংয়ের সময় নানাজি দেশমুখের সাহায্যে জনসংঘ লখনউতে প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পায়, কিন্তু আদবানি বোঝেন, আগামী দিনে নিম্নবর্গের রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠে বিজেপিকেও কংগ্রেসের মতো উচ্চবর্ণের পার্টিতে পরিণত করতে পারে। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি, কিন্তু নিজে ঠাকুর হয়েও ‘মণ্ডল রাজনীতি’ আমদানি করলেন। মনে করুন, আদবানি বঙ্গারুলক্ষ্মণকে কেন দলের সভাপতি করেন? মুরলীমনোহর যোশীকে বাদ দিয়ে কেন কল্যাণ সিংহকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়? লোহিয়ার স্লোগান ছিল, ‘পিছড়ে মাঙ্গে শ-মে ষাট।’ নিম্নবর্গের জন্য শতকরা ৬০ ভাগ সংরক্ষণের দাবি তো প্রথম তিনিই উত্থাপন করেন। বিজেপি সেই নিম্নবর্গের রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে। যদিও এখনও আরএসএস এই সংরক্ষণের বিরুদ্ধে। আদবানি বারবার বলতেন, হিন্দুকে সুসংহত করতে গেলে ব্রাহ্মণ আর ওবিসির মিলন ঘটা দরকার। মনে রাখতে হবে, আদবানি নিজেও সিন্ধি ছিলেন, ব্রাহ্মণ নেতা ছিলেন না। এখন যোগী বিপদে পড়েছেন। ভোটের মুখে তাঁর ক্যাবিনেট থেকে এতজন ওবিসি মন্ত্রীর ইস্তফা সমাজবাদী পার্টির জোটকে আরও সুসংহত করে দেয়। মায়াবতী দুর্বল হয়ে যাওয়ায় অখিলেশ বনাম যোগী মেরুকরণ তীব্র হয়ে যায়, তাতে লাভ বেশি বিজেপিবিরোধী শক্তির।
কিন্তু এই প্রতিকূল পরিস্থিতি বুঝে বিজেপিও পালটা রণকৌশলে সক্রিয়। পৃথক দু’-দুটো বহুজন ফ্রন্ট তৈরি হয়ে গেল। ভাগিদারী পরিবর্তন মোর্চা তৈরি করেছে ‘অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (এআইএমআইএম), অর্থাৎ সেই আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দল। ‘জন অধিকার পার্টি’র সভাপতি বাবু সিং কুশওয়াহা। ‘ভারত মুক্তি মোর্চা’র নেতা ভামান মেশরাম। ২০১১ সালে কুশওয়াহা ‘বিএসপি’ থেকে বহিষ্কৃত হন। দ্বিতীয় ফ্রন্টটি ‘ভীম পার্টি’র নব্য নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ। চন্দ্রশেখর অখিলেশের সঙ্গে জোট গঠন করলেন না, আরও আসনের দাবিতে অটল থেকে এখন গোরখপুরে যোগীর বিরুদ্ধে তৃতীয় প্রার্থী। নিন্দুকেরা বলছেন, ওয়াইসি থেকে চন্দ্রশেখর- এঁরা প্রত্যেকে বিজেপির বি-টিম।
মাথাব্যথা বাড়ছে অখিলেশের। তাই সব শেষে বলব, উত্তরপ্রদেশে না দুর্নীতি কোনও ইস্যু, না উন্নয়ন এক্সপ্রেস হাইওয়ে বা নয়ডার বিমানবন্দর কোনও ইস্যু, এমনকী, মন্দির-মসজিদও এখনও পর্যন্ত বড় ইস্যু নয়। মূল প্রশ্ন এখনও জাতপাত। পশ্চিমাঞ্চলে চরণ সিংয়ের নাতির হাত ধরে অখিলেশ জাঠ ও মুসলমান ভোট জোট করতে চাইছেন, বিজেপি উদ্বিগ্ন। তার সঙ্গে গরিব চাষিদের ক্ষোভ তো রয়েইছে। তাই আপাতত জাঠ ও মুসলমান জাতির মধ্যে সংঘাত লাগাতে নানা শক্তি সক্রিয়।
কী ভয়ংকর, রাহুল গান্ধী পৈতে পড়লে বিজেপি নেতারা রে রে করে ওঠেন, নেহরু পৈতে পরতেন না। বাপ-ঠাকুরদা করেনি, ও কেন করছে? উফ! রাজনীতি সত্যিই বড় কূট।