অভিষেক চৌধুরী, কালনা: মসলিন জামদানি থেকে তাঁতের শাড়ি - প্রিমিয়াম বস্ত্র উৎপাদন ও নকশায় কালনার তাঁতশিল্পীদের হাতের কাজ দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং। কালনার বিখ্যাত তাঁতশিল্পী জ্যোতিষ দেবনাথ। তাঁর উদ্যোগেই গ্রামের মহিলা শিল্পীরা কঠোর পরিশ্রম করে তৈরি করেছেন সব শাড়ি। আর তাঁদের তৈরি মসলিন জামদানি শাড়িগুলোর চাহিদা তুঙ্গে দেশে ও বিদেশে। সেসব দেখে মুগ্ধ মন্ত্রী। নিজের সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডলে পোস্ট করে তাঁর বক্তব্য, স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
নিজের X হ্যান্ডেলে পোস্ট করে তিনি জানান, “শ্রী জ্যোতিষ দেবনাথের কঠোর পরিশ্রম ও নির্দেশনায়, কালনা গ্রামের মহিলারা এখন প্রিমিয়াম মসলিন জামদানি শাড়ি বানিয়ে দেশ-বিদেশে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করেছেন। এই বিষয়টি স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার এক বিশেষ উদাহরণ হয়ে উঠেছে।” সোশাল মিডিয়া পোস্টে বস্ত্রমন্ত্রী কালনার প্রান্তিক এলাকায় থাকা মহিলাদের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাঁদের আত্মনির্ভরতার কাহিনিকে তুলে ধরেন। পাশাপাশি ‘সন্ত কবীর অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়া জ্যোতিষ দেবনাথ কীভাবে নিজের উদ্যোগে দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের ৫০ জনেরও বেশি মহিলা শিল্পীদের ২০২২-২৩ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তুলেছেন, তাঁরা প্রতি মাসে কীভাবে ৭-৮ হাজার টাকা করে উপার্জন করছেন ও তাদের তৈরি জামদানি শাড়িগুলি কীভাবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অর্ডার ও বিক্রি করা হচ্ছে, তা তিনি তুলে ধরেন। এছাড়াও তাঁদের নিখুঁত বুনন, সূক্ষ্ম হাতে মিহি সুতো দিয়ে তৈরি মসলিন জামদানি শাড়ির ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক গুরুত্বের জন্য তা কতটা পরিচিতি লাভ করেছে সেকথাও মন্ত্রী তুলে ধরেন। মন্ত্রীর প্রশংসা পেয়ে উচ্ছ্বসিত তাঁতশিল্পীরা।
কালনার শিল্পীদের নিখুঁত হাতের বুনন। নিজস্ব চিত্র।
মসলিন ও জামদানি শাড়ির উপর সুনিপুণ কাজ, নিখুঁত নকশা-সহ তাঁতশিল্পের উন্নয়নে কালনা শহরের বারুইপাড়ার বাসিন্দা ৬৭ বছর বয়সি জ্যোতিষ দেবনাথের ঝুলিতে রয়েছে ‘সন্ত কবীর অ্যাওয়ার্ড।’ রয়েছে জাতীয় স্তরের বিভিন্ন পুরস্কারও। শুধু তাই নয়, সোনিয়া গান্ধী থেকে নীতা আম্বানি, বিদ্যা বালন থেকে কাজল, জয়া বচ্চনের মতো মুম্বইয়ের অনেক সেলিব্রিটি যেমন তাঁর শাড়ি কেনেন, তেমনই তাঁর তৈরি শাড়ি প্রদর্শনীর জন্য পাড়ি দেয় লন্ডন, স্কটল্যান্ড, ইটালি, সিঙ্গাপুর, জাপান-সহ বিভিন্ন দেশে। এত সুনামের পরেও তিনি শহরে পড়ে না থেকে বেশিরভাগ সময় থাকেন কালনার গ্রামে।
আংটি দিয়ে গলে যায় একটা মসলিন শাড়ি। তা দেখাচ্ছেন শিল্পী জ্যোতিষ দেবনাথ। নিজস্ব চিত্র।
লকডাউনের আগে ও পরে তাঁতশিল্প ও তাঁতশিল্পীদের দূরবস্থার কথা ভেবে দত্তদারিয়াটন গ্রামে জ্যোতিষ দেবনাথ কলকাতার উইভার সার্ভে সেন্টারের সহযোগিতায় একটি মসলিন জামদানি শাড়ি তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন। পাশাপাশি কারখানাও শুরু করেন। সেই কারখানায় বর্তমানে ৫০-এর বেশি পরিবারের বধূরা মসলিন জামদানি শাড়ি তৈরি করে প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা করে আয় করে পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। জ্যোতিষ দেবনাথ জানান, “ঠাকুরদা, বাবার পর বংশ পরম্পরায় আমরা এই তাঁতের কাজ করে চলেছি। মসলিনের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। মসলিন জামদানি তৈরি করেছি। এখানে সেইভাবে কর্মসংস্থান ছিল না। গ্রামীণ এলাকার বাড়ির পুরুষরা একসময় মাঠে কাজ করলেও সেই কাজ বর্তমানে অনেক কমে গিয়েছে। তাই অভাব-অনটনের মধ্যে থাকা কাজ না জানা ৭০ জন মহিলাকে মসলিন জামদানির উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ শিখিয়ে তাদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। উৎসাহ ও আগ্রহ থাকায় ওরাও খুব অল্প সময়েই সেই কাজ শিখে রুটিরুজির জোগাড় করে নেয়।”
বস্ত্রমন্ত্রীর X হ্যান্ডলে পোস্ট দেখে প্রসঙ্গে জ্যোতিষ দেবনাথ বলেন, “মন্ত্রীর এই প্রশংসায় তাঁতশিল্পীদের কাজের আগ্রহ আরও বাড়বে। ওরা আরও উৎসাহিত হবে। একটি শাড়ি তৈরি করতে ৪-৫ মাস ধরে তাঁতশিল্পীরা যেভাবে কঠোর পরিশ্রম করেন সেটিকেও মন্ত্রী প্রশংসায় ভরিয়ে দেন। আসল মসলিন শাড়িকে তিনি ‘প্রিমিয়াম মসলিন’ বলে উল্লেখও করেছেন। গুণগত মানের বিচারে একটি মসলিন শাড়ির দাম ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়। তার দাম ১০ লক্ষ টাকা বা তার বেশি হতে পারে।” অন্যদিকে সোমা সাহা, স্বপ্না দেবনাথ, শুক্লা দেবনাথ, সুচিত্রা দেবনাথ নামের মহিলা তাঁতশিল্পীরা জানান, “বাড়ির কাজ ছাড়া টাকা রোজগার করার মত কোনও সম্মানজনক কাজ আমাদের জানা ছিল না। জ্যোতিষবাবু আমাদের মসলিন শাড়ি তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে আয়ের পথ দেখিয়েছেন। এর ফলে সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। সুখের মুখ দেখতে পেয়েছি। বস্ত্রমন্ত্রী যেভাবে আমাদের কাজের ও কালনার-বাংলার মসলিন-জামদানি শাড়ির প্রশংসা করেছেন তাতে আমরা মুগ্ধ। ”