২০ ডিসেম্বর মুক্তি পেতে চলেছে প্রতিম ডি গুপ্তর (Pratim D Gupta) নতুন ছবি 'চালচিত্র' (Chaalchitro)। প্রতিমের এই থ্রিলার ছবিতে রয়েছেন বাংলাদেশের অভিনেতা অপূর্ব, টলিউড অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরী, ব্রাত্য বসু, অনির্বাণ চক্রবর্তী শান্তনু মাহেশ্বরী, রাইমা সেন, তানিকা বসু এবং স্বস্তিকা দত্তের মতো অভিনেতারা। ছবি নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে মনের কথা খোলসা করলেন পরিচালক প্রতিম। শুনলেন শম্পালী মৌলিক
২০১২ সালে আপনার ফিল্ম পরিচালনা শুরু, ‘পাঁচ অধ্যায়’ দিয়ে। আজকে ২০২৪, প্রায় ১২ বছর অতিক্রান্ত। যেটা অ্যাচিভ করতে চেয়েছিলেন, সম্ভব হয়েছে? ফিরে তাকালে কী মনে হয়?
প্রতিম ডি গুপ্ত: হ্যাঁ, আমি জানি। প্রথম যখন ছবি করেছিলাম, সবসময় মনে হত, পৃথিবীতে একটা কিছু ঘটাব, আমি-ই একমাত্র জানি ছবি বানাতে (জোরে হাসি)। প্রথম ছবিই সেই ধাক্কাটা দেয়। ‘পাঁচ অধ্যায়’ কেউ দ্যাখেনি। তার পরের তিন বছর ভালো যায়নি। ২০১৫-তে হাসানদা বলে, যে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ প্রযোজনা করবে। ওই তিন বছর আমি সাংবাদিকতায় ফিরেছিলাম। প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম, আর ছবি বানানোর সুযোগ আসবে না। স্ক্রিপ্ট লিখছিলাম কিন্তু কোথাও গিয়ে মনে হয়েছিল, ছবি বানানো হয়তো আমার জন্য নয়।
তারপর?
প্রতিম ডি গুপ্ত: তারপরে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ লোকজনের ভালো লাগে। তখন নতুন করে উদ্দীপনা পাই। ‘সাহেব বিবি’র পর থেকে যে ক’টা ছবি বানিয়েছি, সেগুলোর সবকটা নিয়ে আমি গর্বিত। এখন বানালে হয়তো কিছু বদল করতাম। স্টিল অ্যাম প্রাউড অফ দেম। সব মিলিয়ে ১২ বছরের জার্নিতে আমার এখনও সবচেয়ে পছন্দ লেখা। আগে কাগজে লিখতাম, এখন স্ক্রিপ্ট লিখি। তারপরে ভালো লাগে মিউজিক, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বসানো। ফিল্ম মেকিংয়ের কিছু বিষয় আমি দারুণ উপভোগ করি, কিছু জিনিস কম। সবচেয়ে ভালো লাগে নিজের একটা জগৎ তৈরি করতে। ছবির চরিত্রগুলো তৈরি করতে, তাদের ভাবনা-অ্যাকশন ক্রিয়েট করতে দারুণ লাগে। আরেকটা মানুষ যে অন্ধকারে বসে উল্টোদিক থেকে ছবিটা দেখছে তাকে ছুঁতে সবথেকে এনজয় করি।
ছবির শুটিংয়ে রাইমা সেন ও প্রতিম ডি গুপ্ত।
আপনার শেষ রিলিজ ছিল ‘লাভ আজ কাল পরশু’ (সিনেমা) আর সিরিজ ‘টুথপরি’। এবারে ‘চালচিত্র’ ছবিটা আসছে ২০ ডিসেম্বর। থ্রিলার ছবি, ট্রেলার দেখেই বোঝা যায়। এখন থ্রিলার, রহস্য-ঘেঁষা ছবি বা গোয়েন্দা-ছবির রমরমা। সে সব ভেবেই কি এই পথেই ছবি বানানো?
প্রতিম ডি গুপ্ত: দুটো কারণে এটা লেখা শুরু করেছিলাম। একটা হচ্ছে, অনেকদিন ধরে আমি মহিলাকেন্দ্রিক ছবি বানাচ্ছিলাম। এবং আমার জীবনের প্রথম স্ক্রিপ্ট ছিল একজন সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে ‘ভ্যানিস’ বলে, সেটা এখনও করা হয়নি। আমার চিরকালের ইচ্ছে সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে ছবি বানানোর। ফাইনালি ভাবলাম, বানিয়ে ফেলি। তার সঙ্গে পুরুষের জগৎটা ধরতে চেয়েছিলাম, যেখানে চারজন পুলিশ রয়েছে ছবিতে। তারপর সিরিয়াল কিলার বিষয়টা এমন, অবধারিতভাবে থ্রিলার। লিখতে গিয়ে দেখলাম আমার যেগুলো খুব স্বাভাবিকভাবে আসে, ঢুকে পড়লাম। এই পুলিশদের বাড়ির গল্প, এই কেসের সঙ্গে তাদের যোগ– আল্টিমেটলি হিউম্যান স্টোরিগুলোই বেরিয়ে এল। আর সেই অ্যাঙ্গেল থেকে থ্রিলারটা নতুন উদ্দীপনা পেল। যখন লোকেরা ছবিটা দেখবে, মনে হবে অন্যরকম থ্রিলার দেখলাম।
কপ ড্রামা বানানো তো সহজ নয়। তার জন্য পুলিশের জগৎটা চিনতে হয়েছে। প্রস্তুতি কেমন?
প্রতিম ডি গুপ্ত:দুরকমের জগৎ হয়। একটা একদম রিয়েল, আরেকটা হল সিনেমাটিক রিয়েল। বিশ্বকবাবু বলে একজন পুলিশের সঙ্গে অনেক আলোচনা করেছি। উনি একটা বই-ও লিখেছেন, বইটার নাম ‘কেদার ফাইলস’। বই ছাপার আগে উনি প্রাথমিকভাবে কিছু অংশ পড়তে দিয়েছিলেন। সেগুলো পড়ে আমার কিছু ধারণা তৈরি হয়। ওঁর তিন-চারজনের টিম ছিল এবং তারা একসঙ্গে কেস সলভ করত। সেখান থেকে কিছু আইডিয়া পেয়েছি। বাকিটা সিনেমাটিক রিয়েল, যেটা নিজে ক্রিয়েট করেছি। এভাবেই হয়েছে। আমি সুপার রিয়্যাল ছবি বানাতেও চাইনি। একটু লার্জার দ্যান লাইফ চেয়েছি। সিরিয়াল কিলার বিষয়টা তো কলকাতায় নেই। শুরুই করছি যখন বড় ক্যানভাসে, হুট করে একদম রিয়েল গ্রাউন্ড লেভেলে যেতে চাইনি, মানে ‘দোস্তজী’ বা ‘সহজ পাঠের গপ্পো’-র মতো কিছু চাইনি এই বিষয় নিয়ে।
ছবির শুটিংয়ে ব্রাত্য বসু, শান্তনু এবং প্রতিম।
কলকাতার প্রতিষ্ঠিত অভিনেতাদের সঙ্গে শান্তনু মহেশ্বরী বা বাংলাদেশের অপূর্বকে নিয়েছেন। এদের কাস্ট করার নেপথ্য ভাবনাটা কেমন?
প্রতিম ডি গুপ্ত: ভেবেছিলাম চারটে পুলিশেরই কোনও একটা স্ট্রং অ্যাটিটিউড হবে। প্রধান পুলিশ যেটা, টোটা করেছে, সে প্রচণ্ড ফ্লড অফিসার। তার অনেক সমস্যা আছে। তার ব্যাক স্টোরি ছবির বড় প্লট। ওই প্রোটাগনিস্ট। এরপর একজনকে চেয়েছিলাম, যে বেশ অভিজ্ঞ, একটু বয়স্ক, অলমোস্ট ফাদার ফিগার হবে পুরো টিমের কাছে। সেজন্য অনির্বাণ চক্রবর্তীকে বেছে নিই। আর একজনকে চেয়েছিলাম যে মুখে নয়, হাত দিয়ে কথা বলে। যে কারণে ইন্দ্রজিৎকে নেওয়া। শান্তনুর ক্ষেত্রে আগে অ্যাক্টর এসেছে, পরে ক্যারেক্টার। ‘টুথপরি’-তে অনেকদিন ওর সঙ্গে কাজ করেছি। অনেকদিন ও কলকাতায় কাটিয়েছে। খুব মিষ্টি এবড়োখেবড়ো বাংলা বলে। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘বাংলা ছবি করবি?’ ওর বক্তব্য ছিল, আমি ওকে যবে থেকে নিয়েছি, তারপর অনেকে ওকে অফার করেছে। স্ক্রিপ্ট পড়তে দিই ওকে। শুরুতে ওর চরিত্রটা বাঙালি ছিল। কিন্তু ও রাজি হলে অবাঙালি করব বলেছিলাম। স্ক্রিপ্ট পড়ে ওর খুব ভালো লাগে। তখন চরিত্রটাকে খুব ব্রাইট ভাবে লিখি। এই ছেলেটা সারা জীবন একা ফার্স্টবয়, সে হঠাৎ এমন একটা টিমের সঙ্গে কাজ করছে। আর অপূর্ব-র চরিত্রটা, আমি অপূর্ব করবে ভেবে লিখিনি। খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যে এই পুলিশদের সাহায্য করতে আসে একসময়। তুখড় অভিনেতা দরকার ছিল এখানে, যে কন্ট্রোল নেবে একসময়। হাসানদাই আমাকে অপূর্বর কথা বলে। আমাদের কস্টিউম ডিজাইনার সাবর্ণীদি-ও (দাস) আমাকে অপূর্বর কথা বলেছিল। তারপর ওঁর নাটক দেখার পর, স্টার ফ্লেয়ারটা বুঝতে পারি। এবং ওঁকে নেওয়ার কথা ভাবি।
ছবির নারীচরিত্রে রাইমা সেন, তানিকা বসু এবং স্বস্তিকা দত্ত রয়েছেন।
প্রতিম ডি গুপ্ত: এদের ক্ষেত্রে আগে অভিনেতা কেউ আসেনি, প্রথমে চরিত্রই এসেছে। তানিকাকে অডিশন করে নেওয়া হয়। প্রিয়াকে অনেকদিন ধরে চিনি, মুম্বই থেকে যখন যৌনকর্মীর চরিত্রটা আসে চিত্রনাট্যে, ওর কথা মনে হয়। ওর মধ্যে সাংঘাতিক সিম্পলিসিটি আছে। ফ্রেশনেস চেয়েছিলাম এই চরিত্রে। স্বস্তিকা প্রথম পছন্দ ছিল না। অনেকের সঙ্গে দেখা করার পর, ওকে নির্বাচন করি। ওকে ‘ফাটাফাটি’-তে দেখেছি। এই ছবিতে ওকে শান্তনুর সঙ্গে ভালো মানিয়েছে। আর রাইমা বন্ধু হলেও এই প্রথম কাজ করল আমার ছবিতে। রাইমা-টোটা স্বামী-স্ত্রী ছবিতে।
‘চালচিত্র’ এমন সময়ে আসছে ঘাড়ে আরও কটা বড় ছবি রয়েছে। ‘পুষ্পা টু’ তো চলছে। প্লাস ‘খাদান’, ‘সন্তান’ এবং ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’ রয়েছে। ‘চালচিত্র’-র লড়াই তো কঠিন।
প্রতিম ডি গুপ্ত: সে তো বটেই। আগে ‘চালচিত্র’ এলে হল থেকে সরিয়ে দিত, পরে এলে এই ছুটির সময়টা মিস করতাম। শেষ চার-পাঁচ বছরে যা দেখলাম বড়দিন বা পুজোর সময়ের ছবিগুলো চলছে, প্রযোজকের সঙ্গে আলোচনা করেও তাই বুঝলাম। ফলে ফাটকা খেলে অন্য সময়ে আসার চেয়ে প্রযোজক উৎসবের সময়টাই বেছে নেয়। অন্তত কিছুটা ব্যবসা এক্ষেত্রে হয়তো নিশ্চিত থাকে।
প্রায় সাতটা ছবি করে ফেলেছেন, এখন বক্স অফিস সাফল্য যদি বলি, সেটা অধরা আপনার। সেটা কি ব্যথার জায়গা?
প্রতিম ডি গুপ্ত: এখনও হিউজ রোরিং সাকসেস যাকে বলে, সেটা আসেনি আমার। আমি হয়তো সেরকম ছবি বানাই না। রোরিং সাকসেস হচ্ছে ‘বেলাশেষে’, ‘বহুরূপী’। হয়তো আমার সিনেমা-ভাষা সেইরকম নয়। ‘সিরাজ’-এর বিরিয়ানি আর তাজের বিরিয়ানির কথা যদি বলো, তাজের তুলনায় সিরাজের বিরিয়ানির বিক্রি বেশি। আমার বিরিয়ানির সেল কোনওদিনই অত বেশি হবে না, হয়তো চারটে লোকে খেয়ে বলবে সিরাজের থেকে খেতে ভালো (স্মিত হাসি)।
কখনও বক্স অফিসের কথা ভেবে ছবি বানানোর চেষ্টা করবেন না?
প্রতিম ডি গুপ্ত: করব হয়তো। এখনও পর্যন্ত করিনি। এখন মনে হয় লোকে খুব কনফিউসড, বক্স অফিসের কথা ভেবে করলেও কী করা উচিত, তা নিয়ে। শিবুদাদের (নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) সাফল্যের পর সবাই নিজেদের অ্যাডজাস্ট করেছে। কৌশিকদা (গঙ্গোপাধ্যায়) অন্যরকম ছবি করছে। রাজদা (চক্রবর্তী) অন্যরকম বানাচ্ছে। সৃজিত (মুখোপাধ্যায়) কিন্তু নিজের টার্মসে ছবি বানাচ্ছে। তার জন্য সৃজিতের প্রতি আমার হিউজ রেসপেক্ট। সে ছবি ক্লিক করুক বা না করুক।
আপনি যেহেতু সাংবাদিকতা থেকে ফিল্ম মেকিংয়ে এসেছেন। শুরুতে ইন্ডাস্ট্রিতে আপনাকে একটু তফাতে রাখা হত। এখন কি সেটা সরে গিয়েছে?
প্রতিম ডি গুপ্ত: এখন কোথাও একটা, ও প্রতিম তো বম্বেতে থাকে, এমন একটা আছে। আবার কিছু মানুষের সঙ্গে আমি খুবই ঘনিষ্ঠ। ইন্ডাস্ট্রিতে ‘ও আমাদের কেউ নয়’ এমন মনোভাব নেই, আবার সাংঘাতিক ইনসাইডার আমি তাও নয়। আমার মনে হয় আর চারজন পরিচালকের মতোই। আমার মনে হয়, ইনসাইডার মহলটা খুব মুষ্টিমেয় কয়েকজন, এবং তারা নিজেদের নিয়ে খুশি আছে।
আপনার অ্যাটিটিউড খুবই স্নবিশ ধরে নেওয়া হত। পার্টি বা আড্ডায় কি অ্যাক্টর বা পরিচালকরা আপনার সঙ্গে গল্প করতে পারে?
প্রতিম ডি গুপ্ত: মনে হয় স্নবিশ ইমেজটা তৈরি হয়েছিল আমার লেখা থেকে। ছবি নিয়ে সমালোচনা করলেই লোকে ভাবে, এ সবজান্তা। যে কাজ করেছে আমার সঙ্গে সে কিন্তু এমন বলবে না (হাসি)। মমতা শঙ্কর, অঞ্জনদা (দত্ত) বা আদিল হুসেন কিন্তু এমন বলবে না। তাই জন্যই তো পাওলি আমার সঙ্গে চারটে ছবি করেছে, বা ঋত্বিক (চক্রবর্তী), অনির্বাণদা (চক্রবর্তী) যারা কাজ করেছে জেনুইনলি ভালোবেসেই করেছে। শুভঙ্কর ভড় (ডিওপি) আমার সঙ্গে বারবার কাজ করেছে। যদি খারাপ লাগত এতবার কাজ করত না আমার সঙ্গে (হাসি)।