সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: দুর্গা, মহিষাসুর, অভিমন্যু, নারদ, গণেশ, কার্তিক। লম্বা করে একের পর এক সাজানো রঙবাহারি সব ছৌ মুখোশ। এক পক্ষকালেরও বেশি সময় ধরে ঝাঁপ বন্ধ। জমেছে ধুলোর আস্তরণ। জাল বুনছে মাকড়সা। ঝাড়পোঁছ করে কবে যে ফের কেনাবেচা শুরু হবে, সেই উত্তর অজানা পুরুলিয়ার মুখোশ গ্রাম চড়িদার। বেলা ১১টা, বা বিকেল ৪টে অথবা রাত ৮টা। ছৌ সম্রাট গম্ভীর সিং মুড়ার গ্রামে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। নেই ধামসার গুরুগম্ভীর আওয়াজ। বাজছে না মাদল। ছৌ নাচই যে বন্ধ! মুখোশ কিনবে কে? শুধু মাঝে মধ্যে সাঁ সাঁ করে পেরিয়ে যাচ্ছে বাঘমুন্ডি থানার পুলিশ জিপ।
ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। মুখোশ গ্রাম চড়িদায় ঢুকতে গিয়েই বাধার মুখে পড়তে হল। না, পুলিশ নয়। মাও দমনে মোতায়েন কেন্দ্রীয় বাহিনীর বাধাও নয়। ডান দিকের দুর্গা মন্দিরের পাশ থেকে যেন ছুটে এল দু’–তিন জন যুবক। প্রশ্ন – কোথায় যাবেন? কী কাজ? এখানে কেন? কয়েক সেকেন্ডে সাত–আটটা প্রশ্ন। ভাগ্যিস পিঠে থাকা ল্যাপটপের রুকস্যাকে প্রেস কার্ডটা ছিল। না হলে বোধহয় গ্রামে ঢোকাই যেত না। লকডাউনে বহিরাগত প্রবেশ নিষেধ। তবে ততক্ষণে কয়েকজন মুখ চেনা মুখোশ শিল্পী চলে এসেছেন। তাঁরাই বাধা ঠেলে গ্রামে ঢুকিয়ে নিলেন। জগদীশ মুখোশ দোকান, চড়িদা মুখোশ ঘর, আদর্শ মুখোশ দোকান। সব একেবারে তালাবন্ধ। তাদের চোখ–মুখ দেখেই বুঝলাম,করোনা কাঁটায় একেবারে সিঁটিয়ে।
[আরও পড়ুন: গানই হাতিয়ার, বাজারে ঘুরে মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলের অর্থ জোগাড় করছে খুদে শিল্পী]
একে মহামারির ভয়। অন্যদিকে, মহাজনের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নেওয়ার মাসিক সুদ। বৈশাখের ভরদুপুরেই যেন আঁধার নেমেছে এই শিল্পী গ্রামে। জগদীশ সূত্রধর, দ্বিজেন সূত্রধররা (সাধু) বলছেন, “লাখ লাখ টাকার মুখোশ সাজানো রয়েছে দোকানে। কলকাতা থেকে আনা মুখোশ তৈরির নানা সামগ্রী, সব পড়ে রয়েছে। দোকান খুলবে তবে তো!”
আসলে পর্যটক ছাড়াও ছৌ মুখোশ বিক্রির এটাই মরসুম। বৈশাখের ২ তারিখ থেকে পুরুলিয়ার গ্রামবাংলায় শুরু হয় ছৌ নাচের পালা। তারপর বর্ষার আগে পর্যন্ত ঠাসা সূচি। ফলে বৈশাখ জুড়ে চলে মুখোশের কেনাকাটা। তাই মহাজনের কাছে ঋণ নিয়ে যে টাকা বিনিয়োগ করে, তা কার্যত এক মাসেই ‘ডবল’ হয়ে যায়। কিন্তু এই লকডাউনে ‘ডবল’ তো দূর। কীভাবে সুদ গুনবে, তাইই ভেবে পাচ্ছে না চড়িদা। শিল্পী যুবক জনমেজয় সূত্রধর তো বলেই ফেললেন, “আমাদের কথা একটু লিখুন না দাদা, যদি সরকার মুখ তুলে চায়।” ‘এই সরে দাঁড়ান, দূরে থাকুন, জটলা নয়’, হুঁশিয়ার করে বাইক নিয়ে চলে গেলেন দুই সিভিক ভলান্টিয়ার।
[আরও পড়ুন: মুখে মাস্ক, হাতে স্যানিটাইজার! লকডাউনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অভিনব বিয়ে]
ছবি: অমিত সিং দেও।
The post ঝাঁপ বন্ধ, লকডাউনে বৈশাখের ভরা মরশুমে নিঝুমপুরী মুখোশ গ্রাম চড়িদা appeared first on Sangbad Pratidin.