সুকুমার সরকার, ঢাকা: বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব খর্ব করতে উঠেপড়ে লেগেছে চিন। ঋণের পসরা সাজিয়ে ঢাকাকে যে কিছুটা প্রভাবিত করেছে বেজিং সে কথা অজানা নয়। তবে ‘ড্রাগনে’র বন্ধুত্ব যে আসলে ফাঁদ তা এবার বুঝতে পারছে বাংলাদেশে (Bangladesh)। পরিকাঠামো উন্নয়নের নামে দেশে ‘আর্থিক লুট’ চালাচ্ছে চিনা সংস্থাগুলি।
[আরও পড়ুন: করোনা আবহে বাংলাদেশে দুর্গাপুজোয় প্রসাদ বিতরণ, শোভাযাত্রায় জারি নিষেধাজ্ঞা]
বাংলাদেশের পরিকাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন প্রকল্পে লাগাতার ব্যয় বৃদ্ধির অভিযোগ উঠেছে চিনা কোম্পানির বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছে, চিনা কোম্পানিগুলি নানা ছুতোয় সময় বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ব্যয় বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ করছে চিনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং’ কোম্পানি। আর জি টু জ ‘র ভিত্তিতে সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ করছে ‘চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড’। নদীশাসনের কাজ করছে চিনা (China) কোম্পনি ‘সিনোহাইড্রো করপোরেশন’। এটি ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকার প্রকল্প। ২০১১ সালে প্রথম প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধনের পর ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগের পর ২০১৮ সালের মধ্যে চালুর সিদ্ধান্ত হয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে সেতু চালু হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১৮ সালে এসে প্রকল্প সংশোধন না করে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর খুঁটির (পিলার) সংখ্যা ৪২টি। এসব খুঁটির ওপর ৪১টি স্প্যান যুক্ত করা হবে। মূল সেতু হবে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। নকশা সংশোধন ও নদীশাসনে বিলম্বের কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ আগেই পিছিয়েছিল। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং বন্যার স্রোতের কারণে স্টিলের কাঠামো (স্প্যান) বসানো যায়নি। তার দায়ভারও নিতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১৬ সালের মে মাসে। ঢাকা থেকে মাওয়া-ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এভাবে সময়মতো কাজ না হওয়ায় রেল সংযোগ প্রকল্পে নির্মাণ ব্যয়ও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে সেতুতে ওঠা ও নামার সময় বড় বড় ট্রাক ও কভার্ডভ্যান উচ্চতা নিয়ে রেল সংযোগ পিলারে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে আপত্তি জানিয়েছে সড়ক কর্তৃপক্ষ। এতে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ মূল সেতু ও রেল সংযোগ নির্মাণকারী দুটি প্রতিষ্ঠানই চিন সরকারের মালিকানাধীন।
বাংলাদেশের রেলপথ মন্ত্রী মহম্মদ নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, নকশা নিয়ে যে সামান্য ত্রুটির কথা বলা হচ্ছে তা দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে। এতে সেতু বা রেল সংযোগ নির্মাণে বাড়তি সময় লাগবে না পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে যুক্ত দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সময়মতো কাজ না হওয়ার দায় ঠিকাদার নিচ্ছে না। পাইলিংসংক্রান্ত নকশা সংশোধন, নদীশাসন কাজে বিলম্ব এবং নদীভাঙন ও প্রবল স্রোতের কারণে কাজ পিছিয়েছে। বাড়তি সময়ের পুরো দায় বহন করতে হচ্ছে সরকারকে। যেমন দেরির কারণে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির (প্রাইস এসকেলেশন) খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। এ সময়ে যেসব লোকবল ব্যবহার করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, তার খরচ বহন করতে হবে বাংলাদেশকে। এমনকি নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির বাড়তি সময়ে ব্যবহারের খরচও দিতে হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। পাইলিং-সহ নানা জটিলতার কারণে ইতিমধ্যে মূল সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিকভাবে পৌনে তিন বছর বাড়তি সময় দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। নদীশাসনেও ঠিকাদারকে আড়াই বছর বাড়তি সময় দেওয়া হয়েছে। মূল সেতুর পৌনে তিন বছর সময় বেড়েছে অতীতের সমস্যার কারণে। করোনা ও বন্যার তীব্র স্রোতের কারণে দেখিয়ে মূল সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি অনুযায়ী ২০২২ সাল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। একইভাবে নদীশাসনেও সময় ও অর্থ উভয়ই বাড়ানো হয়েছে। অথচ নদীশাসনের কাজ শুরুর চিঠি দেওয়া হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। পরবর্তী চার বছরে ২০১৮ সালে কাজ শেষ করার কথা ছিল। সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় তাদের লোকবল বসিয়ে রাখার জন্য খরচ দিতে বাধ্য করছে সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একইভাবে নদীশাসন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারকেও নদীভাঙন মেরামতেরও খরচ দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। বছর বছর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেলে ঠিকাদারকে বাড়তি টাকা দিতে হয়। এই জন্য পদ্মা মূল সেতু প্রকল্পে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা ধরা আছে। সাবেক সচিব ও বড় প্রকল্প বিষয়ে বিশ্লেষক মুহাম্মদ ফাওজুল কবীর খান বলেন, প্রকল্পের কাজে দেরি মানেই ব্যয় বৃদ্ধি। কাজ নেওয়ার পর সময়ক্ষেপণ, এরপর ক্ষতিপূরণ দাবি এগুলো ঠিকাদারদের পুরোনো কৌশল।