ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর স্ট্রাগল, লোকের সমালোচনা, হাল না ছাড়া মনোভাব এবং নতুন ছবি নিয়ে অকপট রাজ চক্রবর্তী। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়
মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে ছবি করবেন বলেই কি এমন বাবা-ছেলের গল্প বাছলেন?
রাজ: গল্পটা আমার নয়। ‘এসভিএফ’ থেকে আমাকে গল্পটা বলা হয় এবং মিঠুন চক্রবর্তীর নাম সাজেস্ট করা হয়। বহুদিন ধরেই ওঁর সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছি। জোরালো গল্প, আমার ভালো লেগে যায় তাই কাজটা করতে রাজি হই। তারপর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ইনপুট দিই।
কীরকম?
রাজ: আমার বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা প্রভাবিত করেছে, এই গল্প বলতে। এবং আমার চারপাশে একটা চেনা প্যাটার্ন দেখেছি। সন্তানের কাছে ছোটবেলায় বাবা হিরো হলেও, সে বড় হয়ে গেলে বাবা-মাকে নিজের সন্তানের মতো দেখে এবং তাদের অভিভাবক হয়ে ওঠে। আমার সঙ্গে বাবা-মায়ের নানা সময় সংঘাত হয়েছে। প্রথম দিকে আমার থিয়েটারে যোগদান নিয়ে মায়ের আপত্তি ছিল। অন্য বন্ধুরা যখন পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করছে আমি তখন থিয়েটারে কখনও অভিনেতা কিংবা ব্যাকস্টেজে কাজ করছি। মা প্রায়ই আমাকে অন্য চাকরি করার জন্য, বিভিন্ন লোকের কাছে সুপারিশ করেছে। পরে হালিশহর থেকে কলকাতায় বাবা-মায়ের শিফট করা নিয়ে সমস্যা হয়। শারীরিক কারণে আমি খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রশ্ন করলে বাবার সঙ্গে সংঘাত একটা সময় চরমে উঠেছিল। আমার শাসন মেনে নিত না কিছুতেই। ‘সন্তান’-এর গল্পেও সেই ছায়া আছে।
থিয়েটার থেকে সিনেমা পরিচালক?
রাজ: যখন অভিনেতা হিসাবে থিয়েটার করছি তখন পরিচালনার কথা মাথাতেই ছিল না। সাইকেল নিয়ে হালিশহর স্টেশনে আসতাম কলকাতায় যাওয়ার জন্য। স্বপন সাহার ছবিতে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসাবেও কাজ করেছি, অর্থ জোগাড়ের জন্য। বন্ধুরা বলত, তুই ট্রেনে সল্টেড বাদাম বিক্রি করবি। আমি সবসময়ই অন্য একটা কিছু করতে চেয়েছি এটাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল।
ছবির বিষয়টা আর একটু বিশদে বলবেন?
রাজ: মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় ছেলে-মেয়ে কেবল কর্তব্য পালন করছে। কোনও মতে ফোনে অল্প কথা বলা, মাস গেলে একটা খোরপোশ পাঠিয়ে দেওয়া। বাড়তি খেয়াল বা প্রয়োজনের কথা মাথায় না রাখা। এদিকে নিজেদের শপিং, খরচ করে বেড়ানো কিংবা রেস্তোরঁায় যাওয়া সবই বহাল থাকে। এই ছবিতে বাবা যখন দেখে, মায়ের অসুস্থতার জন্য ছেলে দায়িত্ব নিতে রাজি নয়, তখন তাকে উচিত শিক্ষা দিতে উদ্যত হয়। বাঙালির গল্প। তবে প্যানপ্যানে নয়, পারফরম্যান্স নির্ভর।
পরপর নিজের প্রোডাকশনে কাজ করে আবার অন্য হাউসে যোগ দিলেন। নন্দিতা-শিবপ্রসাদের মতো অন্য হাউসে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেননি!
রাজ: গল্প এবং প্রযোজক পছন্দ হলে করতেই পারি। তাছাড়া ওদের একটা টিম আছে, আর আমি একা। আমাকেই সবদিক দেখতে হয়। তাই যে সিনেমা বোঝে তাদের সঙ্গে কাজ করতেই পারি।
কী মনে হয়, নন্দিতা-শিবপ্রসাদের জনারের ছবি সবচেয়ে সফল?
রাজ: জনার বলে কিছু হয় না। ছবি ভালো হলে দর্শক দেখবে। এক একটা সময় এক একজনের টাইম আসে। একটা সময় রাজ চক্রবর্তীর ছিল, তারপর সৃজিতের সময় এল, নন্দিতা-শিবপ্রসাদেরও সাফল্যের ফেজ এল, স্বপন সাহারও একটা সময় মাতামাতি ছিল। ইন্ডাস্ট্রিতে এটাই নিয়ম। সবার সময় আসে। তাছাড়া আমি যদি শিবুর পথ অবলম্বন করি তাহলে আমার ছবি চলবে না বা শিবু যদি আমার পথে হাঁটে তাহলে সেটাও ক্লিক করবে না।
তার মানে বলতে চাইছেন ‘সন্তান’ ততটাও মেলোড্রামাটিক ছবি নয়!
রাজ: আমি জানি শহুরে বাঙালি এ ভাবেই ভাবে। নামটা শুনেই জাজ করবে। এটা এক ধরনের দ্বিচারিতা। পিতা-সন্তানের গল্প অথচ নাম দিলেই মুশকিল। রাজ ‘চ্যালেঞ্জ’ করলে তখনও গালাগালি, ‘প্রলয়’ করলে বলবে অঁাতলামো করছে, ‘পরিণীতা’ করলে বলবে শরৎচন্দ্রের গল্প নিয়ে হিট করার চেষ্টা করছে। এটা নিয়ে শ্রীকান্তদার সঙ্গেও মতভেদ হয়েছে। বলেছিলাম এই নাম দিলেই লোকে মেলোড্রামাটিক বলে রিজেক্ট করে দিতে পারে। শ্রীকান্তদা বলেছিল, যখন ‘প্রলয়’ করেছিলে তখন কেউ দেখেনি, এখন সেই ছবির কথা লোকে বলছে। তাই যারা দেখার তারা ঠিকই দেখবে। আমি বলব ছবিটা দেখে তারপর বিচার করতে।
আপনি কখনও ফ্র্যাঞ্চাইজি ছবি করেননি...
রাজ: হ্যাঁ, অফার পেয়েও করিনি। সেই জন্য কি আমি বড় হতে পারলাম না? ‘ব্যোমকেশ’-এর মতো ছবি করিনি বলেই কি পরিচালক হিসাবে জাতে উঠতে পারলাম না?
সত্যিই এসব আপনার মনে হয়?
রাজ: আমি তো মানুষ, মনে না হওয়ার কী আছে! আমি করিনি কারণ মনে হয়েছিল একটু উল্টো রাস্তায় হাঁটব। আর যদি কখনও করি তাহলে সবাই যেভাবে দেখতে চায়, সে ভাবে নাও করতে পারি।
বলিউড মিঠুন চক্রবর্তীকে ইদানিংকালে সেভাবে ব্যবহার করেনি। এখন তিনি পরপর বাংলা ছবি করছেন। কী মনে হয়, বাংলায় মনে রাখার মতো ছবি তিনি রেখে যেতে চাইছেন? বলিউডের ওপর অভিমান আছে?
রাজ:ওঁর কোনও মরিয়া ইচ্ছে-ফিচ্ছে নেই। ভালো চরিত্র দিলে উনি দারুণ কাজ করে বেরিয়ে যাবেন। মিডিওকার স্ক্রিপ্ট হলে ভালোবেসে কাজটা করবেন না। নিজের ক্রাফ্টের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও, ক্রাফ্টের আর ওঁকে নতুন করে দেওয়ার মতো কিছু নেই। কোনও কিছুতেই তঁার কিছু আসে যায় না। বলিউড তাঁকে কী দিল এসব নিয়ে ভাবেন না। অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে তঁাকে যেতে হয়েছে। বয়স হলে পারিপার্শ্বিক চাপও তৈরি হয়। ভালো স্ক্রিপ্ট দাও বা না দাও তাতে ওঁর অ্যাটেনশন পাওয়া নির্ভর করে না। তুমি যদি সহজ মানুষ হও, চালাকি ছাড়া ওঁর সঙ্গে কথা বলো, উনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারেন। এবং ওঁর সঙ্গে কাজ করতে হলে প্রপার হোমওয়ার্ক এবং প্রিপারেশন নিয়ে আসতে হবে। মিঠুন হলেন ওয়ান টেক অ্যাক্টর।
ঋত্বিক চক্রবর্তীকে আবার আপনার ছবিতে দেখা যাবে...
রাজ: ঋত্বিক দুর্দান্ত অভিনেতা। ওর অভিনয় আমাকে ইরফানের কথা মনে করায়। সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে পারে। ‘সন্তান’-এ ছেলের চরিত্রটা আর কোনও অভিনেতা করার দম রাখত বলে আমি মনে করি না। কেবল গ্রে নয়, দর্শক ঋত্বিককে জুতোপেটাও করতে পারে। এবং ঋত্বিক এই জুতোপেটা খাওয়ার জন্য রেডি। মিঠুনদা এবং ঋত্বিকের যুগলবন্দি এমনই ছিল, ‘কাট’ বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
এতবছর ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছেন, দর্শক কতটা বদলেছে বলে আপনি মনে করেন?
রাজ: অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আর আমাদের সবচেয়ে বড় ব্লান্ডার হল, আমরা মাস অডিয়েন্সকে ছেড়ে দিয়েছি। এবং এর ফল সারাজীবন আমাদের ভোগ করতে হবে। লার্জার মার্কেট যেই হাত থেকে চলে যাবে তখনই তুমি স্মল মার্কেটে ঘোরাফেরা করবে। এখন শহরে সুপারহিট হলে যে কালেকশন তার সঙ্গে পূর্বের গ্রামবাংলা মিলিয়ে হিট হলে যে লাভ হত, তার মধ্যে পার্থক্য আছে। আগে হিরো ওরিয়েন্টেড ছবি কিংবা ভালো মিউজিক দিয়ে সিনেমা বিক্রি করা যেত, এখন ভালো গল্প ছাড়া হয় না।
নতুন কাজ কী করছেন?
রাজ: হিন্দির ওয়েব সিরিজ ‘পরিণীতা’ শেষ করব, স্টার-এ নতুন ধারাবাহিক লঞ্চ করছি। এছাড়া ওয়েব সিরিজ করার ইচ্ছেই আছে, সিনেমা আর করতে চাই না।
সে কী! কেন?
রাজ: নাহ্, সিনেমা করতে আর ইচ্ছে করে না। একটা অনীহা তৈরি হয়েছে। সিনেমার ক্ষেত্রে এখন শহুরে দর্শকের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আমি শহরটা কম বুঝি। অঁাতলামি করে কথা বলতে পারি না, তো আমি এই শহরের ত্রুফো, গোদার বা ফেলিনি হতে পারব না। আমার স্ট্রেন্থ হল মাস অডিয়েন্সের জন্য কাজ করা। সেই ধরনের বিগ বাজেট ছবি এখন তৈরি কম হচ্ছে। ‘আবার প্রলয়’-এর মতো সফল ওয়েব সিরিজ বানানোর পরে মিডিয়া সেটা গ্রাহ্য করেনি। এক থেকে দশের মধ্যে রাখেনি। ‘বাবলি’ মুক্তি পাওয়ার পর রেটিং কমিয়ে দিয়ে আমার গ্রেডটাকে কমানো হয়েছে। আসলে মিডিয়াতে ‘ক্লোজ’ বন্ধুবান্ধব তৈরি করতে হয়, না থাকলে এমন হয় (হাসি)! ‘পরিণীতা’ হিন্দি অডিয়েন্সের জন্য ভেবে তৈরি করছি। এরপর ইচ্ছে আছে হিন্দিতে আরও কাজ করার।