বিশ্বদীপ দে: রবিবারের সকালে মনখারাপ বাঙালির। চলে গেলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা মনু মুখোপাধ্যায় (Monu Mukhopadhyay)। আপামর সিনেপ্রেমীর কাছে তাঁর অন্যতম পরিচয় ‘মছলিবাবা’। ফেসবুক জুড়ে স্মৃতিচারণাতে ফিরে ফিরে এসেছে বেনারসের গঙ্গাঘাট আর মাছের আঁশ পরিবৃত কাল্ট চরিত্রটি। কিন্তু তিনি কি শুধুই ওই একটি ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সারা জীবনে? সহজে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের। তাই একটি বিখ্যাত চরিত্রের আড়ালে থাকা মনুর সামগ্রিক অভিনয় জীবনও যে এমনই কত মণিরত্নখচিত, তা মনে করতে অনীহা জাগে। কিন্তু একজন অভিনেতাকে তাঁর গোটা কেরিয়ার জুড়ে চিহ্নিত করতে পারাটা জরুরি। না হলে অন্যায় হয়ে যায়। অবশ্য এমনটা বাঙালি হরদম করেই থাকে।
মনু মুখোপাধ্যায় বলতেই যেমন ‘মছলিবাবা’ মনে পড়ে, তেমনই মনে ঝিলিক দেয় ‘পাতালঘর’ (Patalghar) ছবির সেই অপয়া বৃদ্ধ গোবিন্দ বিশ্বাস। যাকে উদ্দেশ করেই সেই গান ‘তুমি কাশী যেতে পারো/ যেতে পারো গয়া/ পাবে না এমন দ্বিতীয় অপয়া।’ দমফাটা হাসির এই গান আর বাকি ছবিতে মনুর দুরন্ত টাইমিং, চরিত্রটিকে ছেলেবুড়ো সকলেরই বড় প্রিয় করে তোলে। অথবা সেই কোন কালে ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবির সেই খল চরিত্র। ছেলেধরাদের পাণ্ডা। দাঁতে বিড়ি চেপে ছোট বাচ্চাদের উদ্দেশে ছুরি তুলতেও যার হাত কাঁপে না। চোখেমুখে ঝলসে ওঠে নিষ্ঠুরতা। সেই ছবিতে একদম তরুণ মনুকে দেখলে শিশুরা তো বটেই বড়দেরও বুকের মধ্যে কেঁপে উঠতে বাধ্য।
[আরও পড়ুন: জীবনযুদ্ধে হার, প্রয়াত বর্ষীয়ান অভিনেতা মনু মুখোপাধ্যায়]
যে কোনও ভূমিকাতেই তাঁর অনায়াস যাতায়াত। সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) ‘নায়ক’ ছবিতে অরিন্দমের চরিত্রে উত্তম কুমার বলেছিলেন, ‘ক্যামেরার সামনে অতি অভিনয় চলে না।’ কথাটা কত বড় সত্যি, তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ নিঃসন্দেহে মনু মুখোপাধ্যায়। গোটা অভিনয় জীবন জুড়েই যেন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নিম্নবিত্ত অসহায় বাঙালির এক প্রতিনিধিকে। আবার একই সঙ্গে খলনায়কের ভূমিকাতেও চমকে দিয়েছেন সহজাত অভিনয়ে। সহজ, সাবলীল অভিনয়ই তাঁর ইউএসপি। যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে যায়নি। বয়সজনিত কারণে কিছুটা বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলেও মনু কিন্তু কাজ করে গিয়েছেন অশক্ত শরীরেও। এই তো বছর দুয়েক আগে, ৮৮ বছরে তাঁকে দেখা গিয়েছিল ‘আলিনগরের গোলকধাঁধা’ ছবিতে। সেই গঙ্গার ঘাট থেকে স্নান সেরে ফেরার দৃশ্য। যেন চকিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির আইকনিক মুহূর্ত। সেখানেও তিনি একই রকম সহজ। কয়েক বছর আগের ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ ছবিতেও সেই প্রমাণ মেলে।
কেবল টিভি আসার আগে একেবারে নয়ের দশকের গোড়ায় ‘নোনা স্বাদ’ নামের এক টেলিফিল্মে তাঁর অভিনয় আজও স্পষ্ট বহু দর্শকের কাছে। জোর করে বড়লোক বন্ধুর পরিবারের সামনে সমুদ্রে স্নান করতে নামার সময় স্যান্ডো গেঞ্জির ছেঁড়া অংশের মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে নিঃসীম দারিদ্রের জলছাপ। সেই সময় মনুর মুখ জুড়ে যে সংকোচ, তা মুহূর্তে অস্বস্তিতে ফেলে প্রতিটি দর্শককে। আবার ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর সেই ড্রিল স্যারকে মনে করুন। এই মুখের অভিব্যক্তিরই অন্য এক প্রকাশকে কাজে লাগিয়ে অনায়াসে হাস্যরস তৈরি করে ফেলেন তিনি।
[আরও পড়ুন: ওয়েব সিরিজে তৃতীয় লিঙ্গের চরিত্রে মিলিন্দ সোমন, নজর কাড়লেন আগাম ঝলকে]
এখানেই তাঁর জিত। বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ জুড়ে কেবল উত্তম-সুচিত্রা-সৌমিত্রদের গ্ল্যামারাস দ্যুতিই নেই। রয়েছে এমনই কত সব নিতান্ত সাধারণ মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করা শক্তিশালী অভিনেতাও। সাধারণদর্শন হওয়াটাই যাঁদের প্লাসপয়েন্ট হয়ে ওঠে। তুলসি চক্রবর্তী থেকে নৃপতি হালদার হয়ে এই যে অভিনয়ের ধারা, তারই এক সফল উত্তরসূরি ছিলেন মনু। তাঁর মৃত্যুতে সেই চিরকালীন বাঙালি অভিনয়ের ধারাটি আরও ক্ষীণ হল, সেকথা মানতেই হবে।