কৃষ্ণকুমার দাস ও রঞ্জন মহাপাত্র: কোভিড হাসপাতাল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এবার করোনা রোগীর স্ত্রী ও মেয়েকে ঘিরে নজিরবিহীন চূড়ান্ত অমানবিক ঘটনা। টানা তিনদিন, দুই রাত খোলা আকাশের নিচে গাছতলায় কাটালেন হাসপাতালেই ভরতি এক করোনা রোগীর স্ত্রী ও কিশোরী মেয়ে। বার বার হাসপাতাল সুপারের কাছে দরবার করেও তাঁদের দু’জনকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠায়নি মেডিক্যাল। লালারস পরীক্ষা না হওয়ায় নিজেরাও কোভিড মুক্ত কি না, তা না জানতে পারায় প্রতিবেশিদের ভয়ে বাড়িতেও ফিরতে পারছেন না অসহায় মা ও মেয়ে। লকডাউনে খাবার নেই, বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে আনা মুড়ি-জল খেয়েই কার্যত অর্ধাহারে সময় কাটছে রোগীর স্ত্রী-মেয়ের। এর আগে এক যুবককে পিপিই পরে করোনায় মৃত দাদার দেহ মর্গে পাঠাতে বাধ্য করেছিল এই হাসপাতাল।
পেশায় পুরোহিত ওই বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ় কাঁথিতে বাড়ি বাড়ি পুজো করেন। ভাড়া থাকেন কাঁথি শহরের মা ভবতারিনী মন্দিরের কাছে। দিঘার কাছে জুনপুটে বালিয়াপুরের নিজের বাড়িতে যাওয়ার পরই গত ৪ মে জ্বর শুরু হয়। কাঁথি শহরের সরস্বতীতলার এক ডাক্তারকে ৬ ও ৯ মে দেখান। অসুস্থতা বাড়তে থাকায় ১১ মে কাঁথি সদর হাসপাতালে ভরতি হন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালে পাঠান সরকারি ডাক্তাররা। কলকাতা আসার পথে অ্যাম্বুল্যান্সে রোগীর সঙ্গে থাকা স্ত্রী ও মেয়েকে কার্যত ভয় দেখিয়ে হাওড়ার শিবপুরের লডর্স নার্সিংহোমে ভর্তি করে দেন। দু’দিন পর শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় পুরোহিতকে সল্টলেক আমরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। লালারস পরীক্ষার রিপোর্টে কোভিড পজিটিভ হওয়ায় ১৫ মে বিকেলে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে কলকাতা মেডিক্যালে নিয়ে আসা হয়। হাওড়া থেকেই সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ও মেয়ে।
মুমুর্ষু স্বামী আইসোলেশন ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ায় শুক্রবার সন্ধ্যায় উদ্বিগ্ন স্ত্রী রাজশ্রী (পরিবর্তিত) মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিতে যান হাসপাতালে রোগীর পরিজনের জন্য নির্দিষ্ট প্রতীক্ষালয়ে। কিন্তু সরকারি ওই আশ্রয়স্থলে ঢোকার মুখে দু’জনকেই আটকে দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নিরাপত্তাকর্মীরা। রবিবার দুপুরে রোগীর স্ত্রী রাজশ্রী অভিযোগ করেন, “পেশেন্ট পার্টি শেল্টারে আমাদের ঢুকতে তো দেয়নি, উলটে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছিল, করোনা রোগীর পরিবারের এখানে ঢোকা নিষেধ। কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে চলে যাও।” সন্ধ্যায় সাহায্য চেয়ে সুপার অফিসে গিয়ে দেখেন তালাবন্ধ। বাধ্য হয়ে মেডিক্যালের গ্রিন বিল্ডিংয়ের নিচে গাছতলায় কাগজ পেতে বসে পড়েন দুজনেই। অজস্র মশা এসে ঘিরে ধরে। কার্যত নির্জন হাসপাতালের এক কোণায় ১৬ বছরের কিশোরী মেয়েকে নিয়ে রাতে বসে থাকতে ভয় করছিল রাজশ্রীর। করোনার পাশাপাশি অজানা আতঙ্কে সারারাত গাছে ঠেস দিয়ে পর পর দু’রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি পুরোহিত রোগীর স্ত্রী।
[আরও পড়ুন: উদ্বেগ বাড়াচ্ছে কলকাতা, শহরে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩০০ ছাড়াল]
শুক্রবার রাতে সেই অমানবিক অধ্যায়ের শুরু, তারপর শনিবার গোটা দিন-রাত এবং রবিবার বিকেল। লকডাউনের জেরে চারপাশের দোকান, রেস্তোঁরা, ক্যান্টিন সবকিছুই বন্ধ। তাই সঙ্গে সামান্য টাকা থাকলেও খাবার কিনে খেতে পারেননি মা-মেয়ে। এরই মধ্যে তাঁদের সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানোর জন্য শনিবার দু-দফায় হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার ডাঃ ইন্দ্রনীল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করেন। দুজনের অসহায় আর্তি ছিল, “স্যর, করোনা টেস্ট না করে গেলে পাড়ার ঢুকতে দেবে না। যে কোনও একটা কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠিয়ে দিন।” রোগীর মেয়ে নন্দিতা (পরিবর্তিত) সুপারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে রবিবার অভিযোগ করেন,“পাড়ার কুকুরকেও ওইভাবে দুর-ছাই করে তাড়িয়ে দেয় না যেভাবে সুপার তাঁর অফিস থেকে বের করে দিয়েছেন। প্রতিবারই বলেছেন তোমরা বাড়ি চলে যাও।” কিন্তু সরকারি নিয়মে করোনা পজিটিভ রোগীর পরিবারকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো ও লালারস পরীক্ষা হচ্ছে। এক্ষেত্রে মেডিক্যালের সুপার কেন একজন কোভিড পজিটিভ রোগীর স্ত্রী ও মেয়েকে বাড়ি চলে যেতে বলছিলেন? প্রশ্নের উত্তরে সুপার ডাঃ বিশ্বাস জানিয়েছেন, “মেডিক্যাল কলেজে করোনা রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে, এটা কোয়ারেন্টাইন সেন্টার নয়। রোগীর বাড়ির লোকের রাখার ব্যবস্থা নেই। আর দু’জন মহিলাকে নার্সদের সঙ্গেও রাখা যাবে না।’’ অভিযুক্ত সুপার অবশ্য স্বীকার করেন, নন্দীগ্রামের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকও মা-মেয়ের জন্য ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছিলেন।
[আরও পড়ুন: নার্সিংহোম-হাসপাতালগুলিই করোনা সংক্রমণের ভরকেন্দ্র, অভিযোগ পেলেন পুরমন্ত্রী]
মেডিক্যালের গাছতলায় তিনদিন ধরে রোগীর অসহায় পরিবার থাকার খবর রবিবার দুপুর পৌনে দুটোয় ‘সংবাদ প্রতিদিন’ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে জানায়। মন্ত্রীকে জানানো হয় বিস্তারিত তথ্য ও রাজশ্রী-নন্দিতার ফোন নম্বর। ঘণ্টাখানেক পর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জানান,“স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মা-মেয়েকে চণ্ডীপুর কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো হবে। ওখানেই পরীক্ষা হবে দুজনের।” অবশ্য পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ সুব্রত রায় জানিয়েছেন, “রোগীর বৃদ্ধ মা, বড় মেয়ে ও ছোট ছেলের করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ এসেছে। আর হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো কাঁথি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও প্রাইভেট চিকিৎসক-সহ ৩২ জনেরও রিপোর্ট নেগেটিভ।” রাতের খবর স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কাঁথি পুরসভার পুরপ্রধান সৌমেন্দু অধিকারী অ্যাম্বুল্যান্স পাঠালে তাতে করেই চণ্ডীপুরে ওই মা-মেয়েকে নিয়ে গিয়েছে স্বাস্থ্যদপ্তর।
The post মেডিক্যাল কলেজের গাছতলায় টানা তিনদিন অভুক্ত বসে করোনা রোগীর স্ত্রী ও মেয়ে appeared first on Sangbad Pratidin.