বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত: রাজনীতির জগতে একের পর নক্ষত্র পতন। এক এক করে মুছে যাচ্ছে ছয়ের দশকের বাংলার দামাল ছাত্র আন্দোলনের সমস্ত মুখ। সে সময় বাম ছাত্র রাজনীতিতে তিন যুব নেতার দাপট, বিমান-সুভাষ-শ্যামল। আর ডানপন্থী ছাত্র রাজনীতির রাশ ধরেছেন প্রিয়-সুব্রত-সোমেন। ছাত্র রাজনীতির আঙিনা পেরিয়ে সংসদীয় রাজনীতি। কেউ বা মন্ত্রী হয়েছেন, কেউ বা সাংসদ। কেউ আবার দুই ভূমিকায় সামলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। সময় যত এগোচ্ছে কালের নিয়মে সঙ্গীদের একা করে দিয়ে চলে যাচ্ছেন রাজনীতির একের পর এক মহীরুহ। সুভাষ চলে গিয়েছেন সবার আগে। সেই পথে পা বাড়িয়েছেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সিও। করোনা আবহে কলকাতা হারিয়েছে তাঁদের প্রিয় ছোড়দা-সোমেন মিত্রকেও। এবার করোনা কেড়ে নিল ছয়ের দশকের ছাত্র রাজনীতির আরেক দামাল নেতা শ্যামল চক্রবর্তীকেও (Shyamal Chakrabarty)।
যারা বাম রাজনীতির অলিন্দে ঘোরাফেরা করেন তাঁরা বলছেন, জঙ্গি রাজনীতির সঙ্গে তাত্বিকতার মিশেল ঘটিয়েছিলেন শ্যামলবাবু। যা বাম রাজনীতিতে বিরল। ছয়ের দশকের জঙ্গি ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে উত্থান হয়েছিল তাঁর। প্রমোদ দাসগুপ্তের কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭০ সালে এসএফআই গঠিত হলে তার রাজ্য নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে শিবপুর সম্মেলেনে তিনি এসএফআই-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বারাকপুর রাজ্য সম্মেলন পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এসএফআই-র সর্বভারতীয় যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন।
এরপরই ধীরে ধীরে ছাত্র রাজনীতির গণ্ডি ছেড়ে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ১৯৫৯ সালের শেষে। ১৯৭৮ সালে শিশির মঞ্চে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলন থেকে তিনি পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালের রাজ্য সম্মেলনের পর পার্টির রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হন। ২০০২ সালে হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। পরিবহণ শিল্প, বিদ্যুৎ শিল্প-সহ কয়েকটি ক্ষেত্রে তিনি সর্বভারতীয় স্তরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি হিসেবেও তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে গ্রামীণ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের সংগঠনে নিয়ে আসার প্রশ্নে তিনি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন।
মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ১৯৮১ সালে শ্যামল চক্রবর্তী এই কেন্দ্রে বামফ্রন্টের সিপিআই (এম) প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং প্রথমবার বিধায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের বিধানসভার সাধারণ নির্বাচনেও এই কেন্দ্র থেকে বিধায়ক এবং রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য। রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী হন। ১৯৮৭ ও ১৯৯১ সালেও তিনি মানিকতলা থেকে বিধানসভায় জয়ী হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয়ী হতে পারেননি। রাজ্যসভা সদস্য হন ২০০৮ সালের ৩ এপ্রিল। ছিলেন ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত। সাংসদ হিসেবেও রাজ্যের স্বার্থে এবং দেশের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
দুপুরের দিকে সিটুর অফিসে বসতেন শ্যামলবাবু।সেইসময় সাংবাদিক থেকে দলীয় কর্মী, সকলের জন্য তাঁর অবারিত দ্বার। গল্পগুজবের মধ্যে দিয়েই দলীয় কর্মীদের দলের নীতি, আদর্শ, পার্টি লাইন সহজেই বুঝিয়ে দিতেন সকলের প্রিয় ‘শ্যামলদা’। তবে সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ঠোঁটের কোনে জ্বলতে থাকা সিগারেটটা। শেষপর্যন্ত সেই ধূমপানই ফুসফুসের রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
[আরও পড়ুন : করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তী]
রাজ্য ক্ষমতার পালা বদলের পরও সক্রিয় রাজনীতির অংশ ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে বাম-কংগ্রেস জোটের অন্যতম কাণ্ডারীও ছিলেন তিনি। এমনকী, অশক্ত শরীর নিয়েও আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে ফের কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বিষয় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছিলেন। সেই দর কষাকষির মাঝপথেই করোনা সংক্রমণ কেড়ে নিল তাঁকে।
The post ছাত্র আন্দোলন থেকে দাপুটে শ্রমিক নেতা, ঈর্ষণীয় রাজনৈতিক জীবন ছিল শ্যামলের appeared first on Sangbad Pratidin.