সৌরভ দত্ত, ডিন্ডোরি: এই বঙ্গের খেতে কিষান, কলে মজুরদের জোট বাঁধার স্লোগান এখন ফিকে। সুসংবাদের স্বপ্ন ধূসর, মলিন। লালঝান্ডার কমরেডরা এখন স্রেফ জোট ধরে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু মারাঠাভূমের এ তল্লাটে সেই জোটই গড়ে দেখিয়েছেন কিষান গুজ্জর, সঞ্জয় বনশলে, ভিখু গাভিটরা। একসময়কার উত্তাল বঙ্গ-রাজনীতির হাওয়া যেন এতদিন কোথাও থেমেছিল। অপেক্ষা করছিল, কে গ্রহণ করবে তাকে, সেইজন্য। আজ প্রবেশ করেছে এই মারাঠাভূমে।
[ আরও পড়ুন: ড্রিম গার্ল ছাড়া উন্নতি অসম্ভব, স্ত্রী’র প্রচারে মথুরার জনসভায় বললেন ধর্মেন্দ্র]
ফি-বছরের ফসলে বঞ্চনার প্রতিবাদ গ্রামকে গ্রাম ছাড়িয়ে শহরে টেনে এনেছেন ওঁরা। ওঁদেরই হাত ধরে নাসিক থেকে মুম্বই-চাষির দাবিতে শপথের লালঝান্ডায় লংমার্চে লালে লাল হয়েছে রাজপথ। সেই ‘অধিকার ছিনিয়ে আনার’ ডাক দিয়েই এবার মারাঠা ভূমের একরত্তি এই ‘লালদুর্গে’ ভোটের লড়াইয়ে শামিল ‘কমরেডরা’। মহারাষ্ট্রের ৪৮টি আসনের মধ্যে শুধুমাত্র ডিন্ডোরিতেই লড়ছেন সিপিএমের একমাত্র প্রার্থী জীবা পান্ডু গাভিট। কালওয়ান, সুরগানা, রাখেওয়াড়ার মতো গ্রামে গ্রামে পিঁয়াজ, আঙুর, আখ চাষিদের জেহাদ আরও ‘বুলন্দ’ করে টানা আটবার এ তল্লাট থেকে বিধায়ক হয়েছেন জীবা। এবার সেই লড়াই সংসদে নিয়ে যেতে ময়দানে কমরেড গাভিট। বিমান, সূর্যকান্তরা মানুন বা না-ই মানুন, স্রেফ রাজনীতির কথার কচকচি উড়িয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরের গরিব-গুর্বোদের লড়াইয়ে টেনে আনতে ১৬ আনা সফল ডিন্ডোরির বাম ব্রিগেড। তাই জীবার প্রচারে পোড়খাওয়া চাষি ভিকা ভাগড়ে, সঞ্জয় বনশলের পাশাপাশি পা মিলিয়ে শামিল তরুণ পঙ্কজ আসাওলে, এমনকী, কলেজ পড়ুয়া উত্তম গাভিটও।
[ আরও পড়ুন: গুরুত্ব দিচ্ছে না কমিশন, ইভিএম ইস্যুতে ফের সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে বিরোধীরা]
স্কুলে ক্লাস ফাঁকি দিতে বগলের তলায় পিঁয়াজ রেখে জ্বর আনার বৃত্তান্ত শুনে এখনকার স্কুল পড়ুয়ারা তো হেসেই খুন। সেই পিঁয়াজের তাপে জ্বর আসুক না-আসুক, আর মাস দু’য়েকের মধ্যে পিঁয়াজের বাজারে যে হঠাৎ জ্বর আসবেই-তা নিয়ে বাংলার বিক্রেতারা একরকম নিশ্চিত! জুন পড়লেই হঠাৎ পিঁয়াজ চড়ে কেজি প্রতি ৩০ এমনকী, ৪০ টাকায়! কোলে মার্কেট থেকে শুরু করে এপাড়া-সেপাড়ার খুচরো ব্যবসায়ীদের ডালাও তেতে-পুড়ে একশা। অথচ সেই পিঁয়াজ ফলিয়েছেন যাঁরা, ওই ডিন্ডোরি তল্লাটে, সেই চাষিদের ঘরে তখন নুন আনতে পান্তা ফুরনোর জোগাড়। পিঁয়াজ ফলছে প্রচুর, অথচ এলাকায় হিমঘরই নেই। কাজেই চাঁদোয়ারের পাইকারি বাজারে তড়িঘড়ি খেতের পিঁয়াজ নিয়ে গিয়ে বেচতে বাধ্য চাষি। দাম মেরেকেটে ৩০০ টাকা কুইন্টাল, অর্থাৎ কেজিতে মাত্র তিনটাকা। সেচের জল, সার, কীটনাশকের জন্য বিপুল পয়সা গুনে শেষে নামমাত্রই দাম পেলে চাষি খাবে কী! শুধু পিঁয়াজই নয়, এ তল্লাটের আঙুর, আখ চাষিদেরও দশা হরেদরে একই। ফসলের দাম নেই। পেটে চাষির ভাত নেই। নাসিক থেকে ঘণ্টাদেড়েকের পথ ডিন্ডোরি। আর তারই লাগোয়া গ্রামকে গ্রাম জুড়ে নির্বাচনের ব্যাকড্রপে এমনই হাহাকার।
[ আরও পড়ুন: মোদিকে ভোট দিতে অস্ট্রেলিয়ায় মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরলেন যুবক]
লালঝান্ডার দাপট মানেই গেরুয়ার ফিকে হয়ে যাওয়া, তা নয়। আবার ‘এনসিপি’-র প্রতীক ঘড়ির টিকটিকও একেবারে থেমে যায়নি। ময়দানে হাজির এনসিপির ধনরাজ মাহালে এবং বিজেপির ভারতী পাওয়ার। মুশকিল হল, দু’জনেরই নাম উঠে গিয়েছে আয়ারাম-গয়ারামের দলে। কারণ ভারতীই হোন বা ধনরাজ, আজ বিজেপিতে তো কাল এনসিপির ঘরে। ডিন্ডোরিতেও যথারীতি প্রার্থী অনেক। তবে লড়াইয়ে শামিল ধনরাজ, ভারতী এবং জীবাই। কমবেশি ১৭ লাখ ভোটারের এই কেন্দ্রে ৭০ শতাংশই চাষি। পিঁয়াজ, আখ, আঙুর ফলিয়ে পেট চলে ওঁদের। আবার কেউ কেউ সেই আখ-আঙুরের প্রক্রিয়াকরণ কারখানার কর্মী। আদিবাসী ভোটারও বড় কম নয়। আর তাই আদিবাসীদের জমির অধিকারও এ তল্লাটে বেশ বড় ইস্যু। অভিযোগ, কথা দিলেও কথা রাখেনি সরকার। মুখে বলেছে, বন বিভাগের জমি আদিবাসীদেরই। কিন্তু পাট্টা মেলেনি আজও। হিমঘরের অভাবে পিঁয়াজই হোক বা আঙুর-তড়িঘড়ি বেচতে বাধ্য হল চাষি। নামমাত্র দাম মিললেও তাঁরা অসহায়।আর সেই ফসলই গুদামে রেখে সময়মতো বের করে বেচে দিয়ে মুনাফা লোটেন ব্যবসায়ীরা। তাই হিমঘর চাই। চাষির ফসলের ন্যায্য দাম চাই আর শুধু বৃষ্টির জলে নির্ভরতা এড়িয়ে জমিতে সেচের জল চাই। তুলনায় উঁচু মহারাষ্ট্রের থেকে নিচু গুজরাটে বৃষ্টির জলের ধারা অবিরাম বয়ে যাওয়া ঠেকাতে মঞ্জিরপাড়ায় নির্মীয়মাণ বাঁধের কাজও শেষ করা চাই। কংগ্রেস-এনসিপি আমলে শুরু হওয়া সেই কাজ যে থমকেই গিয়েছে একদম! চাষির চাওয়া এমন অনেককিছুই। ভোটের আবহে সেই চাওয়ার নিরিখেই এখন পাওয়ার হিসাব মেলানোর পালা।
[ আরও পড়ুন: ১৬০টি আসনও পাবে না বিজেপি! প্রথম দফার ভোটের পরই প্রকাশ্যে চাঞ্চল্যকর সমীক্ষা]
ঋণ মকুব হয়নি তাই ফসলের দামও ঠিকঠাক মেলেনি। বিজেপি তাই কাঠগড়ায়। দুষছে এনসিপি, বামেরাও। কিন্তু মুশকিল হল, ডিন্ডোরি লোকসভা আসনের আওতাধীন ছ’টি বিধানসভার মধ্যে দু’টি ছাড়া লালঝান্ডার দাপট আদৌ তেমন নয়। সবে মিলিয়ে লোকসভা আসনের নিরিখে বাম ভোট মেরেকেটে ২০ শতাংশ। রাজ্যের এক মন্ত্রীকে হারিয়েই জীবা পান্ডু গাভিট বিধানসভায় যাওয়ার টিকিট পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু অন্যত্র বামেদের পালে হাওয়া লাগেনি। তুলনায় বিজেপি আর এনসিপির নিজস্ব ভোটব্যাংক ধারে-ভারে ওজনদার বইকি! লংমার্চের রেশ এখনও ফিকে হয়নি। বহু চাষিই সেই লংমার্চের নিরিখেই ‘লালঝান্ডা’ চিনেছেন বলেও দাবি কমরেডদের। কাজেই ওরা নিশ্চিত, বাম ভোট ডিন্ডোরিতে বাড়বে অনেকটাই। কিন্তু সেই ভোট বাড়ার হার বিজেপি বা এনসিপি প্রার্থীকে সত্যিই বেকায়দায় ফেলতে পারবে কি? মুখে যাই বলুন, কমরেডরা কিন্তু এখনও ‘অনিশ্চিত’। কাজেই ১৮ থেকে ৮০-একসুরে বেঁধে গড়ের জমি তৈরি ঠিকই, কিন্তু ডিন্ডোরিতে সেই দুর্গে লাল নিশান আদৌ উড়বে কি না, তা নিয়ে ধন্দ থাকছেই।
The post লং মার্চের আঁতুড়ঘরে ভোটে পুঁজি কৃষকের হাহাকারই appeared first on Sangbad Pratidin.