স্টাফ রিপোর্টার: ভারতীয় ক্রিকেটে সুনামের চেয়ে দুর্নাম অর্জন বেশি করেছেন তিনি। তাঁর কোচিংয়ের সময়কে আজও এ দেশের ক্রিকেটের কালো অধ্যায় ধরা হয়। সেই গ্রেগ চ্যাপেল, ওরফে গুরু গ্রেগ টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিরাট কোহলির অবসরের পর লম্বা লেখা লিখলেন এক ক্রিকেট ওয়েবসাইটে। তা তুলে দেওয়া হল...।
'...টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিরাট কোহলির অবসর এক অসামান্য যুগের সমাপ্তি ঘোষণা করল। সে এমন এক যুগ, যেখানে চোয়ালচাপা সংকল্প ছিল, আগুন ছিল, আর ছিল অপার ঔদ্ধত্য।
শচীন তেণ্ডুলকরের পর বিরাটই ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় প্রভাবশালী ক্রিকেট চরিত্র। আমার তো কোথাও গিয়ে মনে হয়, ভারতের ক্রিকেটীয় সত্ত্বার উপর সংস্কৃতিগত এবং মানসিকগত ভাবে প্রভাব বিস্তারের প্রেক্ষিতে শচীনকেও বোধহয় বিরাট ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেখুন, বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারতীয় ক্রিকেটীয় হৃদপিণ্ড ছিল বিরাট। যে শুধুমাত্র রান করেনি। একই সঙ্গে প্রত্যাশার মানদণ্ডের মাপকাঠির সংজ্ঞা নতুন করে তৈরি করেছে, সনাতনী সমস্ত প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করেছ এবং একবিংশ শতকে এক অনমনীয় ভারতকে বিশ্বদরবারে পেশ করেছে! টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে বিরাটের চলে যাওয়া শুধু এক গভীর শূন্যস্থান সৃষ্টি করল না। একই সঙ্গে একটা প্রশ্নও জন্ম দিল–বিরাটের মতো অফুরান প্রাণশক্তির ক্রিকেটার আর কখনও আসবে তো?
ভারতীয় ক্রিকেটে একটা সময় ছিল যখন, বিদেশ সফর এলেই টিমটা কেমন যেন গুটিয়ে যেত। প্রথম থেকেই সসম্মানে যুদ্ধের জমি ছেড়ে দেওয়ার একটা মনোভাব কাজ করত টিমে। টেকনিক কিংবা স্কিলের দিক থেকে নয়। মানসিকতায়। যা পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। সৌরভ গাঙ্গুলি ভারতীয় ক্রিকেটকে মেরুদণ্ড দিয়েছিল। এমএস ধোনি শীতল নেতৃত্বগুণ দিয়ে সাদা বলের ক্রিকেটে টিমকে রাজত্ব করতে শিখিয়েছিল। কিন্তু কোহলি? কোহলি স্রেফ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল! পুরনো চিত্রনাট্য সবেগে ছিঁড়েখুঁড়ে নতুন এক স্ক্রিপ্ট লিখেছিল ও। যে চিত্রনাট্য বলে ভারত শুধুমাত্র বিদেশ সফরে গিয়ে লড়বে না। বরং ভারতের থেকে জয় প্রত্যাশা করা হবে!
সোজাসুজি বলছি, বিরাট হল সেই ক্রিকেটার, যে অস্ট্রেলীয় না হয়েও চূড়ান্ত ভাবে অস্ট্রেলীয়! টেস্টের সাদা জার্সি যার কাছে ছিল এক ক্ষুরধার যোদ্ধার বেশ। বিনা যুদ্ধে যে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে রাজি নয়। বরং যার চাহিদা সব সময় বেশি। আর সে চাহিদা শুধুমাত্র নিজের বোলার বা ফিল্ডারের থেকে নয়, বিপক্ষের থেকে নয়, সবার আগে নিজের থেকে!
দু’টো টেস্ট সিরিজের কথা আমি উল্লেখ করব যা কোহলির পরম্পরাকে বোঝাবে। ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে, তাদের দেশে দু’টো সিরিজ। ২০১৪ সালের ইংল্যান্ড সফর বিরাটের দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। জিমি অ্যান্ডারসনের লেট সুইংয়ের প্রেত তাড়া করছিল কোহলিকে। কিন্তু ব্যর্থতা হারিয়ে দিতে পারেনি ওকে। বরং নতুন করে গড়তে সাহায্য করেছে। সেই সফরের পর নিজের অনূর্ধ্ব উনিশ সময়কার কোচ লালচাঁদ রাজপুতের শরণাপন্ন হয় কোহলি। শচীনের থেকেও পরামর্শ আসে। চার বছর পর ইংল্যান্ড সফরে যখন আবার যায় কোহলি, ব্যাটার ও চরিত্র, দুইয়েই প্রভূত উন্নতি ঘটিয়ে যায়। ২০১৮-র ইংল্যান্ড সফরে কোহলির ব্যাটিং লোকগাথা হয়ে থাকবে। এজবাস্টনে সিরিজের প্রথম টেস্টে ১৪৯ করে দেয় বিরাট। অনমনীয় মনোভাব, ধৈর্য দেখিয়ে। কঠিন পরিবেশের সঙ্গে অকল্পনীয় লড়াই করে। এজবাস্টনেই দ্বিতীয় ইনিংসে ওর হাফসেঞ্চুরি কোনও অংশে কম ছিল না। সিরিজের পাঁচটা টেস্ট জুড়ে ৫৯৩ রান করেছিল কোহলি। ৫৯.৩০ গড়ে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে কয়েক মাইলের দূরত্ব রেখে সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিল। ২০১৪-র ব্যর্থতাকে যার পর শুধু ঝেড়ে ফেলা যায়নি, সমূলে উৎপাটিত করে দেওয়া হয়েছিল।
ইংল্যান্ড যদি ক্রিকেটার কোহলিকে পুনর্জন্ম দিয়ে থাকে, তা হলে ২০১৮-’১৯-এর অস্ট্রেলিয়া সফর ওর মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছিল। ভারত তার আগে পর্যন্ত কখনও অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে টেস্ট সিরিজ জেতেনি। কিন্তু অধিনায়ক বিরাট বিশ্বাস করেছিল যে, সেটা সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব। পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখলে, আসল নায়ক চেতেশ্বর পুজারাকেই মনে হবে। কিন্তু পারথের ভয়ঙ্কর পিচে বিরাটের ১২৩, যুগন্ধর ইনিংস। যা নিয়ে চর্চা বছরের পর বছর চলবে। তুখোড় টেস্ট ক্রিকেট বলতে যা বোঝায়, ‘র’ টেস্ট ক্রিকেট বলতে যা বোঝায়, তা-ই হয়েছিল ওই সিরিজজুড়ে। ভারত সিরিজটা ২-১ জেতে। এবং একই সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া সফরে ভারতীয় ক্রিকেটের গায়ে সেঁটে থাকা ‘হীনমন্যতা’ শব্দটাকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যায়।
পরিষ্কার লিখছি, কোনও ভারত অধিনায়ক টিম নিয়ে ও রকম দুর্দমনীয় ভাবে বিদেশে রাজত্ব করতে পারেনি। এবং শচীন তেণ্ডুলকর বাদে আর কোনও ব্যাটার সমস্ত মহাদেশে গিয়ে এমন শাসন করতে পারেনি। ও যেসব পরিস্থিতিতে যেসব ইনিংস খেলেছে, সত্যিই দুর্ধর্ষ।
অল হেইল দ্য কিং! রাজার সম্মানে সবাই আজ উঠে দাঁড়াও সবাই। আর বিরাট, আমার তরফ থেকে তোমাকে ধন্যবাদ। তুমিই দেখিয়েছো, যে শাসন আর সম্মান হাতে হাত ধরে চলতে পারে!
