অর্পণ দাস: “আমার উপর সবাই ভরসা করেছিল। বলেছিল, আমি মেরে খেলতে পারব। সেটাই আমার বিশ্বাস বাড়িয়েছে। সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম, ফাইনালে নিজেদের শেষ পর্যন্ত উজাড় করে দেব।"
ভারতের বিশ্বজয়ের পর টিভিতে বলেছিলেন রিচা ঘোষ। বিশ্বকাপ জয়ী রিচা, বাংলার রিচা, পুরো ভারতের রিচা। 'সবাই' কথাটার উপর যেন একটু বাড়তি জোর। ব্যক্তি রিচা নয়, দলের জন্য সবর্স্ব পণ করা এক ক্রিকেটার। শিলিগুড়ির ক্রিকেটারের বাবা মানবেন্দ্র ঘোষও বারবার বলছিলেন 'সবার' কথা। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের কথা, দলের সাপোর্ট স্টাফদের কথা। বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নিয়ে 'ঘোরের মতো' থাকার মুহূর্তের কথা। মুম্বই থেকে ফোনালাপে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে তিনি ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের পরবর্তী অনুভূতি ভাগ করে নিলেন।
কীরকম ছিল সেই অনুভূতি? তিনি জানালেন, "এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এ যেন আনন্দাশ্রু। সেটাই কাল আমাদের চোখ দিয়ে বয়ে গিয়েছে। এই অনুভূতি আমি অন্তত ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কিছু আনন্দের অনুভূতি নীরবেই থেকে যায়। এটাও সেরকম। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জায়গা পেয়েছে আমাদের রিচা, আমাদের দেশ। এখনও সেই ঘোরটা কাটেনি। রিচার মায়েরও ঠিক একই অনুভূতি।"
ভারত যে ম্যাচই খেলুক না কেন, শেষবেলায় শিলিগুড়ির ২২ বছর বয়সি তরুণীর ব্যাটের ঝড় ছাড়া যেন ইনিংস অসম্পূর্ণ। বিশ্বকাপে তিনি মোট ২৩৫ রান করেছেন। যার মধ্যে লিগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাঁর সর্বোচ্চ ৯৪ রান ছিল। ফাইনালে ২৪ বলে ৩৪ রান করেন। মানবেন্দ্র বাবুর সংযোজন, "কাল বিশ্বজয়ের পর সব অভিভাবকদের নিচে ডেকেছে। সবার হাতে কাপ দিয়েছে। এই অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করব কী করে? এটা কিছুতেই কথায় বোঝাতে পারব না।"
সমগ্র দেশবাসীও তো ঠিক ঘোরের মধ্যে আছে। কেউ মুম্বইয়ে, কেউ কলকাতায়, কেউ শিলিগুড়িতে, কেউ-বা এই বিরাট দেশের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে। একটা বিশ্বকাপ জয় অনেক কিছু বদলে দিল। আজ থেকে কোনও অভিভাবক তাঁর কন্যাকে বলতেই পারেন, “দেখো, রিচার মতো হতে হবে।” উঠতি ক্রিকেট প্রতিভাদের ঘরে ঘরে থাকবে ‘রিচা দিদির’ পোস্টার। সেই দিনটা কি এসেই গেল? মানবেন্দ্র বললেন, "একদম। আগে হয়তো অভিভাবকরা ভয় পেত। কোথাও গিয়ে একটা হয়তো অবহেলাও ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই মানসিকতার বদল ঘটেছে। কলকাতা ময়দানে আগে যে ক্লাবগুলো একজন-দুজন করে মহিলা ক্রিকেটার ছিল, সেখানে আজ মেয়েদের জায়গা দিতে পারছে না। আজ রিচাদের বিশ্বজয়ে অবশ্যই একটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু কারও সঙ্গে তুলনা নয়। এই ক্রিকেটারদের গুণগুলো যেন পাই। এটাই যেন আমাদের প্রার্থনা হয়।"
তা আসবে। আসতে বাধ্য। রিচার মতো 'সবার' স্ট্রাগল আজ এই দিনটা নিয়ে এসেছে। কিন্তু মানবেন্দ্র বাবুর মতো ভাবতে পারেন ক'জন, "এখন রিচা যা অর্জন করেছে, আমি যদি পিছিয়ে দেখি, তাহলে সেই স্ট্রাগল-যন্ত্রণা তুচ্ছ বলে মনে হয়।" তাই রিচার বাবা বিশ্বাস করেন শুধু ১৫ জন ক্রিকেটার নন, এই সাফল্যের কারিগর আরও বহু বহু মানুষ। তিনি বলেন, "কৃতিত্ব তো কারও একার নয়। গোটা দল খেলে বিশ্বকাপ জিতেছে। দলের সাপোর্ট স্টাফরা নেপথ্যে থেকে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা যা পেয়েছেন, যা করেছেন, তার জন্যই কিন্তু আজ রাস্তা অনেক সহজ হয়েছে। তাঁদের অবদান কিন্তু কম নয়। তাঁদের প্রত্যেকের সম্মান প্রাপ্য। সেই সব কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলছি, গল্প বলছি, সেটাও অভাবনীয়।"
বিশ্বকাপের সময়ই ছিল দুর্গোৎসব। সেই সময় রিচার মা স্বপ্না ঘোষ মা দুর্গার কাছে মেয়ের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। মেয়ে যেন বিশ্বকাপ জেতে, সেটাই ছিল প্রার্থনা। সেটা পূরণ হয়েছে। 'দেবীপক্ষ' শেষ হল না ভারতের মেয়েদের সাফল্যে। বিশ্বজয়ের পর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতে হয়তো খুব বিশেষ কিছু কথা হয়নি। সম্ভবত প্রয়োজনও নেই। মেয়ে বিশ্বজয় করে ফিরেছে। সামনে গর্বিত মা-বাবা। সেই মুহূর্তটা যেন হাজার হাজার কথার থেকেও বেশি দামি হয়ে ওঠে।
