সুলয়া সিংহ: ক্রিমিনাল জাস্টিস সিরিজের নিয়মিত দর্শক হলে আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে যে এই সিরিজের ফোকাস অভিযুক্তকে নির্দোষ প্রমাণ করা। কোর্টরুমে লাগাতার সওয়াল-জবাবের পর সেই মামলার পাতা ওলটাতে ওলটাতেই জালে ধরা পড়ে দোষী। খানিকটা গতে বাঁধা কাহিনিই তৃতীয় সিজনেও তুলে ধরেছেন পরিচালক রোহন সিপ্পি। কিন্তু গল্প বলার মুন্সিয়ানা, চিত্রনাট্যের সঠিক বুনন এবং তুখড় অভিনেতা পেলে যে সে গল্পও নজর কাড়তে পারে, তা প্রমাণ করে দিল ক্রিমিনাল জাস্টিসের অন্তিম সিজন।
এবার প্রথমে ২টি এবং তারপর প্রতি সপ্তাহে একটি করে পর্ব মুক্তি পেয়েছে ‘হটস্টারে’। তবে একটি পর্ব শেষ হতে পরের পর্ব দেখার খিদেটা বাড়িয়ে দিতে সফল হয়েছেন পরিচালক। গতকাল, শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে শেষ পর্ব। তাই এখনও না দেখা হয়ে থাকলে নিশ্চিন্তে বসে গোটা সিরিজটি দেখে ফেলতেই পারেন। কেন দেখবেন? স্পয়লার সরিয়ে এবার তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১. জনপ্রিয় সেলিব্রিটি কিড জারার (দেশনা দুগড়) রহস্যমৃত্যু। সন্দেহের তালিকায় এক এবং একমাত্র ব্যক্তি সেই কিশোরীর সৎ দাদা মুকুল (আদিত্য গুপ্ত)। যাকে কঠোরতম শাস্তি দিতে লড়াইয়ে নেমেছে বিলেত ফেরত আইনজীবী লেখা (শ্বেতা বসু প্রসাদ)। কিন্তু ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন মাধব মিশ্র অর্থাৎ সিরিজের ‘হিরো’ পঙ্কজ ত্রিপাঠী। গল্পে উচ্চবিত্তের চাকচিক্যে ভরা লাইফস্টাইল এবং ছা পোষা মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের পার্থক্যটা অত্যন্ত নিঁখুত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিলাসবহুল জীবন, অগুনতি অর্থের মালিক হলেও সম্পর্কের টানাপোড়েনে কীভাবে একটা সংসারে চিড় ধরে, তা অবন্তিকা (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়), নীরজ (পূরব কোহলি) ও মুকুলের মধ্যে চাপা রাগ, মানসিক যন্ত্রণা, অভিমান, ভুল বোঝাবুঝিতেই স্পষ্ট।
[আরও পড়ুন: নাবালিকা মেয়ের প্রেমিককে নিয়ে আপত্তি, যুবককে পিটিয়ে ‘খুন’, তুমুল উত্তেজনা চুঁচুড়ায়]
২. একদিকে আদালতের কাঠগড়ায় তর্ক-পালটা তর্ক, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, অন্যদিকে জুভেনাইল হেফাজতে অভিযুক্ত নাবালকদের মানসিক পরিস্থিতি যেভাবে পরিচালক দেখিয়েছেন, তা প্রশংসার যোগ্য। অল্প বয়সিদের ঝামেলা, পকেটমারির প্রশিক্ষণ, মাদকসেবন, জেল থেকে পালানোর প্রবণতা- কোনও বিষয়ই বাদ পড়েনি। আইনের ঘোর-প্যাঁচের সঙ্গে সংশোধনাগারের অন্ধকার জীবনের নিষ্ঠুরতা- সব দিকই সমানভাবে জায়গা করে নিয়েছে এই সিরিজে।
৩. কোর্টরুম কাহিনি নতুন কিছু নয়। শুধুমাত্র আদালতের তর্ক ও বিতর্কের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে একাধিক সিনেমা ও সিরিজ। কিন্তু সরকার পক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে পুলিশের ‘আঁতাঁত’, অভিযুক্তের আইনজীবীর আমজনতার রোষানলে পড়ার বিষয়গুলি এই সিরিজকে যেন অন্য মাত্রা দিয়েছে। এ গল্পে সোশ্যাল মিডিয়ার ভাল ও মন্দ দিকটিও খুব ভাল ভাবে ফুটে উঠেছে। ভারচুয়াল দুনিয়া কাউকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দিতে পারে, আবার এক নিমেষে কেড়ে নিতে সবকিছু। যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
৪. এ গল্পে নজর কেড়েছে দাম্পত্য সম্পর্কগুলি। পঙ্কজ ত্রিপাঠী ও কল্যাণীর দাম্পত্যের সারল্য এই সিরিজের অন্যতম ইউএসপি। কয়েনের উলটো পিঠের মতো আবার ততটাই জটিল হয়ে উঠেছে স্বস্তিকা ও পূরবের সম্পর্ক। তারই মধ্যে প্রকট হয়েছে স্বস্তিকার প্রাক্তন স্বামীর উপস্থিতি। নিজের অতীতকে যে নতুন করে শুধরে নিতে মরিয়া। স্ত্রীরা হাজার যন্ত্রণা বুকে আঁকড়ে রেখেও কীভাবে স্বামীর রক্ষাকবচ হয়ে ওঠে, তা ব্যক্ত করে আরেকটি দাম্পত্যের সম্পর্ক।
[আরও পড়ুন: অন্যের সঙ্গে দুর্গা-দর্শনে আপত্তি, প্রেমিকাকে ধর্ষণ করে গলায় ক্ষুর চালাল প্রেমিক]
৫. এই সিরিজের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এর অভিনয়। পঙ্কজ ত্রিপাঠীর যত প্রশংসাই করা হোক, কম পড়বে। এহেন ভার্সাটাইল অভিনেতা সত্যিই বলিউডের সম্পদ। তাঁর সংলাপ বলার ধরন থেকে চোখের চাহনি, স্ত্রীকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরা, সবই যেন বারবার করে দেখতে ইচ্ছা করে। তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় কল্যাণীর অভিনয় মুখে হাসি ফোটায়। লেখা হিসেবে শ্বেতা এককথায় অনবদ্য। অসহায় মায়ের ভূমিকায় স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ছাড়া যেন কাউকে ভাবাই যায় না। ‘আমি তোমার বন্ধু নই,’ স্বস্তিকার ছেলেকে ধমক দেওয়ার দৃশ্যটা বাঁধিয়ে রাখার মতো। মুকুলের চরিত্রে আদিত্যও বড় অভিনেতাদের রীতিমতো টেক্কা দিয়েছে। এছাড়াও পূরব কোহলি, দেশনারা নিজেদের জায়গায় ভাল।
তবে এ সিরিজে চরিত্র খুব কম। তাই দর্শক হিসেবে কোনও চরিত্রকে সন্দেহ করার মতো তেমন উপায় নেই। সিরিজের লোকেশন আরও একটু ইন্টারেস্টিং করাই যেত। জারা কিংবা মুকুলদের বন্ধুমহলের দিকটা একটু কম দেখানো হয়েছে। মিডিয়া ট্রায়ালের বিষয়টি প্রথম দিকে উঠে এলেও পরে তা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। তবে পঙ্কজ ত্রিপাঠীর জন্যই দেখে ফেলা যেতে পারে এই অন্তিম সিজনটি।