shono
Advertisement

৫০ বছরেও অধরা! বিমান অপহরণ করে অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া সেই ‘যাত্রী’আজও নিখোঁজ

এই ধরনের সব অমীমাংসিত রহস্য কাহিনিকেই হার মানায় ডিবি কুপারের অন্তর্ধান।
Posted: 09:58 PM Nov 26, 2021Updated: 09:58 PM Nov 26, 2021

বিশ্বদীপ দে: ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর। শান্ত, আপাতনিরীহ চেহারার একটা লোক প্যারাস্যুটে লাফ দিল বিমান থেকে। সঙ্গে ২ লক্ষ মার্কিন (US) ডলার! রাতের হিম অন্ধকারের ভিতরে চিরতরে মিলিয়ে গেল সেই আগন্তুক। স্বস্তির শ্বাস ফেললেন বিমানে থাকা কয়েকজন ক্রু সদস্য। এতক্ষণ ওই লোকটাই যে তাঁদের অপহরণ করে রেখেছিল! কিন্তু কোথায় গেল লোকটা?রাতের এমন হাড়কাঁপানো অন্ধকারে নিচের ঘন অরণ্যের ভিতরে সেঁধিয়ে গিয়ে সে পালাতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি পাঁচ দশক পেরিয়েও। আজ পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি ড্যান কুপারের (Dan Cooper)। সংবাদমাধ্যমের ভুলে ডিবি কুপার নামেই যার কুখ্যাতি। রহস্যের চিরকুয়াশায় হারিয়ে গেছে সে।

Advertisement

পঞ্চাশ বছর পূর্তি হল কুপার সাহেবের অন্তর্ধানের। গোটা পৃথিবী জুড়ে এমন অন্তর্ধানের ঘটনা আরও আছে। কিন্তু সেই সব দুঁদে অপরাধীদের সন্ধান না পেলেও তাদের সম্পর্কে কোনও না কোনও তথ্য ঠিকই জোগাড় করে ফেলেছেন পুলিশ-গোয়েন্দারা। আশ্চর্যের বিষয় হল, এতদিনেও কুপারের টিকিটি যেমন মেলেনি, তেমনই মেলেনি তার সম্পর্কে কোনও রকম তথ্য। কে এই কুপার? থাকে কোথায়? তার বাবা-মা-পরিবার-বন্ধুবান্ধব? কিচ্ছু না। কিছুই জানা যায়নি। আজও। আর সেই কারণেই এই অপরাধীকে ঘিরে কৌতূহল এক অন্য মাত্রা পেয়েছে।
ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? আমেরিকার পোর্টল্যান্ড বিমানবন্দর থেকে ওয়াশিংটনের সিয়াটেল যাওয়ার টিকিট কেটেছিল কুপার। বয়স মধ্য ৪০। চুপচাপ শান্ত চেহারার লোকটার পরনে ছিল সাদা শার্ট, বিজনেস স্যুট ও কালো টাই। প্লেন ছাড়ার পরে দিব্যি সোডা সহযোগে পানীয়তে চুমুক দিয়েছিল সে। তারপর বেলা ৩টেয় একটা ছোট্ট নোট পাঠাল এয়ার হোস্টেসকে। তাতে লেখা, তার সঙ্গের ব্রিফকেসে রয়েছে বোমা!

এই স্কেচ অনুসরণ করেও মেলেনি খোঁজ।

[আরও পড়ুন: বাংলার ‘রবিন হুড’ রঘু ডাকাত! আজও রহস্যে ঘেরা দস্যু সর্দারের এই সব কিস্সা]

এমন নোট পেয়ে এয়ার হোস্টেসের হাল কী হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। তাঁর ফ্যালফ্যাল দৃষ্টির সামনে কুপার হালকা করে খুলে ধরেছিল সস্তা অ্যাটাচিটা। তাতেই উঁকি দিয়েছিল একগুচ্ছ তার ও লাল রঙের সরু লাঠি! সত্যি সত্যিই বোমা রয়েছে তা পরিষ্কার করে দিয়েছিল সে। দ্রুত সেই এয়ারহোস্টেসকে নতুন নোট দিয়েছিল কুপার। পাইলটের কাছে সেই নোট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাতে লেখা, বাঁচতে হলে কুড়ি ডলারের নোটে ২ লক্ষ মার্কিন ডলার দিতে হবে। আর সেই সঙ্গে চারটে প্যারাস্যুট।

খানিক পরে সিয়াটেল বিমানবন্দরে নেমে এল প্লেনটি। বিমান থেকে মুক্ত করে দেওয়া হল ৩৬ জন যাত্রীকে। বিনিময়ে ডলার ও প্য়ারাস্যুট নিয়ে ফের উড়ল বিমান। বিমানে রাখা হল কয়েকজন বিমানকর্মীকে। তাঁরা তখন ‘মডগেজ’। মেক্সিকোর উদ্দেশে নিচু হয়ে উড়ছিল বিমানটি। এরপর সন্ধে আটটা নাগাদ, বিমান যখন সিয়াটেল ও রেনোর নিচে কুপার লাফ দিল। ব্যাস! আর খোঁজ মেলেনি তার। লাফানোর আগে টাইটা খুলে রেখে গিয়েছিল সে। কেবল সেটুকু ছাড়া পুলিশের মুঠোয় ছিল একরাশ শূন্যতা।

রাতের হিম অন্ধকারে লাফ মেরেছিল কুপার।

[আরও পড়ুন: ঘরে ঘরে যমজ, অদ্ভুত রহস্য বুকে নিয়ে পর্যটকদের টানে কেরলের এই গ্রাম]

তবু চেষ্টার কসুর করেনি এফবিআই। পরবর্তী বহু বছর ধরে লাগাতার তদন্ত চালিয়ে গিয়েছিল তারা। ১৯৭৫ সালের মধ্যে এই ঘটনায় অন্তত ৮০০ সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল মার্কিন গোয়েন্দারা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যার সম্ভাবনা ছিল ‘কুপার’ হয়ে ওঠার, তার নাম ম্যাকয়। সেই লোকটাও একই ভাবে একটা বিমান হাইজ্যাক করে পরে প্যারাস্যুটে করে পালিয়েছিল। সেই ঘটনা কুপারের ঘটনার মাস পাঁচেক পরের। কিন্তু তার প্রতি সন্দেহ গাঢ় হলেও শেষ পর্যন্ত তাকে রেহাই দেয় পুলিশ। কেননা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে কুপারের যে ছবি ফুটে উঠেছিল, তার সঙ্গে একেবারেই মিল নেই ম্য়াকয়ের। এছাড়াও আরও কয়েকটি কারণ ছিল। সব মিলিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছিল এই অপরাধীও কুপার নয়।

অনেকেরই ধারণা, কুপার প্লেন থেকে লাফিয়ে বাঁচতে পারেনি। তার পোশাক কিংবা জুতো এই ধরনের লাফের উপযুক্ত ছিল না। তার উপরে সে রাতের অন্ধকারে গাছে ঢাকা জঙ্গুলে এলাকার উপরে লাফ মেরেছিল। সেই সব বিচার করে মনেই করা হয় লোকটার পক্ষে প্রাণ বাঁচানো কঠিন ছিল। কিন্তু তাহলে তো মৃতদেহ মেলার কথা। তাও যে মেলেনি। লোকটা কি তাহলে হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেল?

 

‘ডন’ ছবির সেই দৃশ্য।

অনেকেরই মনে পড়তে পারে বলিউড কিংবা হলিউডের ঝাঁ চকচকে স্পেশাল এফেক্টসের কথা। ‘ডন’ (২০০৬) ছবিতে এভাবেই আকাশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শাহরুখ। মানুষ পর্দায় সেসব দেখে সিটি মেরে উঠেছিল। ১৯৯৭ সালে নিকোলাস কেজের ‘কন এয়ার’ ছবিতেও প্লেনের মধ্যে অসম্ভব সব মারামারি, প্লেন হাইজ্যাকের ব্য়াপার স্যাপার ছিল। এরকম আরও অনেক রয়েছে। কিন্তু রুপোলি পর্দার সেসব দৃশ্য তো বানানো। আর বানিয়েও সেখানে ডিবি কুপারের মতো রহস্যের আমদানি করা যায়নি। ওই যে বলে, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। এ যেন একেবারেই তাই।

অবশ্য এমন অন্তর্ধান মোটেই বিরল নয়। আমেরিকাতেই ছিল ‘ব্ল্যাক বার্ট’। মোটা গোঁফওয়ালা সেই ডাকাত ডাকাতির পরে যে মেসেজ রেখে যেত তাতে লেখা থাকত একেকটা কবিতা। পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর সাজা খেটে বেরিয়ে সেই যে সে জেল থেকে বেরিয়ে ছিল আর কখনও তার টিকি দেখতে পায়নি সে। এমন অসংখ্য অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। এমন জাঁদরেল অপরাধী ভারতেও ছিল। সুকুমারা কুরুপ নামের এক ব্যক্তি গত শতকে আটের দশকে খুন করে পালিয়ে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, নিজেকে মৃত সাজিয়ে জীবনবিমার টাকা হাতানো। শেষ পর্যন্ত পুলিশ তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করলে সে একেবারে গা ঢাকা দেয়। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসের পর থেকে তার কোনও খোঁজ মেলেনি। কিন্তু…

কিন্তু এই সব অপরাধীদের কারও সম্পর্কেই ‘পুলিশ কিস্যু জানতে পারেনি ‘, সেটা বলা যাবে না। তাদের ছবি থেকে নানা তথ্য, জোগাড় করতে অসুবিধা হয়নি পুলিশ প্রশাসনের। কিন্তু কুপার সম্পর্কে বহু মাথা ঘামিয়েও কিচ্ছুটি জানা যায়নি। ২০১৬ সালে সরকারি ভাবে কুপারের ফাইল ক্লোজ করে দিয়েছে এফবিআই।

সেদিন বিমানের যাত্রীরা থ হয়ে গিয়েছিলেন গোটা ঘটনায়।

ফাইল ক্লোজ হলেও বন্ধ হয়নি গল্পের পাতা। আজও পৃথিবীর নানা কোণে অসমাপ্ত রহস্যকাহিনির উল্লেখ হলেই ঝিকিয়ে ওঠে ডিবি কুপার। তাকে নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা চালানো এরিক উলিস বলেছেন, লোকটা যেন জেমস বন্ড হয়ে উঠেছিল। রুদ্ধশ্বাস সিনেমার স্টাইল আইকন ০০৭-কে এভাবেই ছুঁয়ে যায় কুপারের শহুরে লোকগাথা। কনকনে শীতের রাতে পকেটে ২ লক্ষ ডলার নিয়ে যে লাফিয়ে পড়েছিল অজানা অন্ধকারের ভিতরে, তাকে কেবল ভেসে উঠতে দেখা যায় এই সব গল্পগাছার অন্দরেই। পঞ্চাশ বছর পরেও নিরুদ্দেশ লোকটার গল্প মানুষ ভুলতে পারেনি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement