ভারতে ফুলচাষ একটি উদীয়মান ব্যবসায়িক সুযোগ। যা ফুলের বাণিজ্য, নার্সারি উদ্ভিদের উৎপাদন এবং পটেড গাছ, বীজ এবং বাল্ব উৎপাদন, শুকনো ফুল, ল্যান্ডস্কেপিং, মাইক্রোপ্রপাগেশন এবং প্রয়োজনীয় তেল নিষ্কাশন ব্যবস্থা এর অন্তর্ভুক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চ-উৎপাদনশীল ফুলগুলির চাহিদা বেড়েছে যেমন অর্কিড, অ্যান্থুরিয়াম এবং লিলিয়াম। এইগুলোর মধ্যে লিলিয়ামের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আমদানির মাধ্যমে। লিলিয়ামের চাষে ভালো রোজগারের সুযোগ রয়েছে। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্প এবং ভূমি চিত্রায়ন বিভাগের গবেষক পূজা মাইতি এবং তীর্থরাজ রায়।
প্রথম পর্ব
লিলিয়াম পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যান্য রাজ্য এবং এমনকী আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করা যায়, যা বৈদেশিক মুদ্রার আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। পশ্চিমবঙ্গের বৈচিত্র্যময় জলবায়ুর কারণে, লিলিয়াম অফ-সিজনে চাষ করা সম্ভব, যা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা প্রদান করে এবং ফুলের চাহিদা তীব্র হলে বাজারের শূন্যতা পূরণ করে থাকে। কলকাতা ও অন্যান্য শহরের আশেপাশের এলাকায়, ফুলচাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা সূত্রে পরিণত হয়েছে। কলকাতার মল্লিক ঘাট ফুল বাজারের মতো ফুলের বাজারগুলি লিলিয়াম ফুলের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক কার্যকলাপে অবদান রাখে। লিলিয়ামের তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত বৃদ্ধি চক্র (প্রায় ৩-৪ মাস) বছরে একাধিক ফসল চক্রের সুযোগ দেয়। যা আয় বাড়াতে সহায়ক। পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্যানপালন দপ্তর, কৃষি দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন স্কিমের অধীনে ফুলচাষকে উৎসাহিত করে। বীজ, সেচ এবং কোল্ড স্টোরেজের জন্য ভর্তুকি প্রদান করে। এটি লিলিয়াম চাষিদের উৎপাদনশীলতা ও লাভ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। লিলিয়াম ফুলের সৌন্দর্য এগ্রি-ট্যুরিজমকে উৎসাহিত করে। দর্শনীয় স্থান কৃষি খামারে আকর্ষণ করে। বিশেষ করে দার্জিলিংয়ের পাদদেশ এবং অন্যান্য দৃশ্যাবলী স্থানগুলিতে। কাট ফ্লাওয়ার ছাড়াও, এই ফুলগুলো তোড়া তৈরি, ফুলের সাজসজ্জা এবং পটের মাধ্যমে স্থানের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। বাণিজ্যিক পর্যায়ে ভারতের মধ্যে অ্যাসিয়াটিক, ওরিয়েন্টাল এবং এলএ (L.A.) সাধারণত চাষ হয়। মৃদু জলবায়ু এলাকাগুলো লিলিয়াম চাষের জন্য অনুকূল। ভারতে এটি প্রধানত হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বেঙ্গালুরু এবং পাঞ্জাবের কিছু অংশে চাষ করা হয়। ভারতে লিলিয়াম চাষের জন্য ভালো মানের কন্দ অন্য দেশ থেকে আমদানি করা করা হয়ে থাকে। প্রজাতি এবং প্রকারভেদ বিভিন্ন ব্যবহার রয়েছে এবং এগুলো সীমানা ও পটে চাষ করা যেতে পারে। উজ্জ্বল রূপ ও সুন্দর রঙের জন্য চমৎকার কাট ফুল।
আবহাওয়া ও তাপমাত্রা
লিলিয়াম চাষের জন্য আলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর। সেরা ফুল উৎপাদনের জন্য ২০০০ থেকে ৩০০০ ক্যান্ডলস ফিট আলো প্রয়োজন। শীতকালে কম আলোর তীব্রতা ফুলের অকাল পতন ও ঝরার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে অতিরিক্ত/ সাপ্লিমেন্টারি আলো শীতকালে উৎপাদন বাড়ায়, কাণ্ডের দৃঢ়তা উন্নত করে এবং ফুলের গুণমান বৃদ্ধি করে থাকে। প্রথমে ১২ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা (যতক্ষণ না কাণ্ডের শিকড় গজায়)। এশিয়াটিক হাইব্রিডগুলো ২১ থেকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (দিনের তাপমাত্রা) এবং ১৪ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (রাতের তাপমাত্রা)-এ ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে কুঁড়ির পতন ও পাতার হলদেটে হওয়া শুরু হয়। লংগিফ্লোরাম হাইব্রিডগুলির জন্য, গ্রহণযোগ্য দিনের তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকা দরকার। ভালো মানের ফুল পাওয়ার জন্য প্রায় ৬০ থেকে ৭৫% আর্দ্রতা প্রয়োজন।
জাত নির্বাচন
পশ্চিমবঙ্গে আমরা এশিয়াটিক লিলি চাষ করতে পারি সেইগুলি হলো লিটোউন, পাভিয়া, সুলপিস, ট্রেজর, প্রাটো, সোলেমিও, ইন্ডিয়ান সামারসেট, ইয়েলো ডায়মন্ড, ইত্যাদি আর এল হাইব্রিড জাতের মধ্যে যেগুলো চাষ করা সম্ভব সেগুলি হল ব্রিন্ডিসি, লাটেয়া, মেনোর্কা, নাশভ্যালি, এরেমো ইত্যাদি।
প্রজনন পদ্ধতি
লিলিয়ামের প্রজনন কন্দ, কন্দের ছোট অংশ (bulbils), মাধ্যমে করা যায়। বীজ দিয়েও রোপণ করা যায়। তবে ভালো মানের ফুল পাওয়া যায় না। ফুল উৎপাদনের ৬-৮ সপ্তাহ পর মূল কন্দ থেকে ছোট কন্দগুলো তুলে নেওয়া হয়। তার পর তাদের শীতল অবস্থায় রেখে নিদ্রার অবস্থা ভাঙানো হয়। সাধারণত ২-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৬-১০ সপ্তাহ ধরে, প্রজাতির উপর নির্ভর করে। ৬ সপ্তাহের জন্য ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শীতল সংরক্ষণকাল নিদ্রা ভাঙানোর জন্য প্রয়োজনীয় এবং কন্দগুলো -২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা করা হয়। ছোট কন্দগুলো পাত্র বা বেডে রোপণ করা হয়। ছোট কন্দগুলো থেকে সঠিক আকারের ফুলের কন্দ গঠিত হতে ২-৩ বছর সময় লাগে। যখন এই কন্দগুলো পুরোপুরি পরিপক্ব হয়, তখন এগুলো গাছ থেকে সংগ্রহ করে পাত্র বা বেডে রোপণ করা হয়। কন্দগুলোর আকার যত বড় হবে, ফুল উৎপাদনের সম্ভাবনা তত বেশি হবে। লিলিয়ামের কন্দের গঠন রসুনের কন্দের মতো। যেখানে অনেকগুলো স্কেল বেস প্লেটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। বাইরের এবং মধ্যবর্তী স্কেলগুলো কন্দ থেকে একটি ছোট অংশের সাথে আলাদা করা হয়। তাদের রোপণের আগে আধা ঘণ্টার জন্য জল প্রতি লিটার ১ গ্রাম ব্যাভিস্টিন বা কার্বেন্ডাজিম এবং ২ গ্রাম ডিথেন এম-৪৫ (Dithane M-45) দ্বারা ফাঙ্গিসাইড দিয়ে শোধন (treated) করা হয় এবং তার পর ১২ ঘণ্টার জন্য একটি ঠান্ডা ছায়াযুক্ত স্থানে শুকানো হয়। শুকানোর পর, স্কেলগুলোকে ৫০০ পিপিএম এনএএ (NAA 500 ppm)) দ্বারা শোধন (treated ) করা হয়।
মাটি প্রস্তুত
হালকা ও ভালোভাবে জল নিষ্কাশিত মাটি উপযুক্ত। মাটির পিএইচ মান ৬.০-৭.০ (এশিয়াটিক ও লংগিফ্লোরাম হাইব্রিডের জন্য) এবং ৫.৫ থেকে ৬.৫ (ওরিয়েন্টাল হাইব্রিডের জন্য) সবচেয়ে ভালো বলে বিবেচিত হয়। সফল ফুল উৎপাদনের জন্য, মাটির প্রস্তুতি এমনভাবে করা উচিত যাতে শিকড়ের নেটওয়ার্ক সহজেই গড়ে উঠতে পারে এবং গাছগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। ফসল চাষের জন্য ব্যবহৃত মিশ্রণে সঠিক নিষ্কাশনের ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; অন্যথায়, গাছের শিকড় পচে যেতে পারে। মাটি, বালু, পিট বা পার্লাইট মিশিয়ে একটি ভাল মিশ্রণ তৈরি করা যেতে পারে। মাটি, গোবর সার এবং বালুর মিশ্রণ (২:১:১)-ও প্রস্তুত করে ব্যবহার করা যেতে পারে।
রোপণের সময় এবং পদ্ধতি
উত্তর ভারতীয় আবহাওয়ায় হাইব্রিড লিলি রোপণের সেরা সময় হচ্ছে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এশিয়াটিক লিলির জন্য উত্তর সমভূমিতে রোপণের উপযুক্ত সময় অক্টোবর-নভেম্বর পাহাড়ে মার্চ-এপ্রিল রোপণের উপযুক্ত সময়। কন্দ রোপণের আগে নিশ্চিত করতে হবে যে সেগুলো নিদ্রিত অবস্থায় (not dormant) নেই। সুরক্ষিত চাষের জন্য, এক মিটার প্রস্থের উঁচু বেড তৈরি করা দরকার। যার মাঝে ৪০ সেন্টিমিটার প্রস্থের একটি পথ রাখা উচিত। বেডের মাটি অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার গভীর করে খুঁড়ে নিতে হবে এবং প্রতি বর্গমিটার ৫-১০ কেজি ভালোভাবে পচা গোবর সার মেশাতে হবে। বেডগুলো প্রায় ২৫-৩০ সেন্টিমিটার উঁচু করা উচিত। কন্দগুলো ১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হবে এবং লাইন থেকে লাইন ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে রাখতে হবে এবং ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার গভীরতায় রোপণ করতে হবে। কন্দ রোপণের আগে মাটি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মাটি জীবাণুমুক্ত করার জন্য, তা ফরমালিনের দ্রবণে (এক লিটার ফরমালিন ৭ লিটার জলর সাথে মিশিয়ে) প্রস্তুত করা যেতে পারে এবং এর উপর একটি পলিথিন শীট ঢাকা দরকার। এক সপ্তাহ পরে শীটটি সরিয়ে ফেলতে হবে এবং ১৫ দিন খোলা রাখতে হবে যাতে গ্যাসটি মাটি থেকে বের হয়ে যায়। যদি কন্দ খুব অগভীর স্থানে রোপণ করলে কাণ্ডের শিকড় সঠিকভাবে গঠন হয় না এবং এর ফলে ফুলের ফলন ও মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
জলসেচ
সেচ ঋতু ও তাপমাত্রার ভিত্তিতে করা উচিত। বেডে বাল্ব রোপণের আগে সেচ দিতে হবে এবং তারপরে হালকা সেচ দিতে হবে। যেহেতু লিলিয়ামের কাণ্ডের শিকড় মাটির উপরের অংশে বিকাশ লাভ করে, তাই মাটির উপরের ৩০ সেন্টিমিটার স্তরে আর্দ্রতা বজায় রাখা উচিত।
এটি লক্ষ্য রাখতে হবে যে জল জমতে পারবে না, তবে আর্দ্রতা থাকা উচিত। সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা দরকার। সেচের জন্য ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা স্থাপন করা দরকার।