অরিঞ্জয় বোস, ঘাটাল: ভারত-পাকিস্তান ম্যাচেও সৌজন্য চলে, রাজনীতিতে থাকবে না কেন? ‘আমি ক্ষমতায় নয়, ভালোবাসায় বিশ্বাসী’।
রুপোলি পর্দার চেনা ডায়ালগ বলে মঞ্চ থেকে হাততালি কুড়াতে অনেকেই পারেন। বঙ্গ-রাজনীতি এমন কুশীলব দেখেছে প্রচুর। অতীতে, এখনও। কিন্তু ক’জন পারেন, সেই সিনেমার ডায়ালগকে এমন বাস্তবসম্মত করে তুলতে? সংখ্যাটা হাতেগোনা। আর সেই নগণ্য প্রজাতির মুখ বলতে প্রথমেই যে নামটা চোখের সামনে ভাসে, তিনি দীপক অধিকারী। জনতা জনার্দন অবশ্য তাঁকে চেনে ‘সুপারস্টার’ দেব নামেই।
তবে তিনি শুধু ‘সুপারস্টার’ নন, জননেতা। লোকসভা নির্বাচনে ঘাটালের তৃণমূল পদপ্রার্থী। তবু ক্ষমতায় নয়, তাঁর নিজের সিনেমা ‘প্রধান’-এর জনপ্রিয় ডায়লগের মতোই তিনি ভালোবাসায় বিশ্বাসী। সে বিশ্বাস যতই না ঘরে-বাইরে প্রশ্নের মুখে পড়ুক, দেব নিজের অভীষ্টে আত্মমগ্ন, সাধনায় অবিচল। ঘাটালের পথে ও প্রান্তরে ভোটপ্রচারে সৌজন্যেবোধের মন্ত্রশক্তিতেই ভোটের বৈতরণি জয়ের স্বপ্ন দেখছেন ঘাটালের দুবারের সাংসদ।
সেই মন্ত্রগুপ্তি কী? প্রতিপক্ষ যতই কাদা ছুড়ুক, ভালোবাসার বাণীতে হৃদয় জয় করো। কাঁটাকে ফুলে পরিণত করো। কেশপুরে ভোটপ্রচার শেষে দেব আরও স্পষ্ট করলেন, “গত দশ বছরে রাজনীতিতে অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু আমি অন্যরকম রাজনীতিতে বিশ্বাসী। ক্ষমতা মানে তো আসলে সাধারণ মানুষকে ভালোবাসা। জনপ্রতিনিধি মানে জনতার কাছের মানুষ হয়ে ওঠা। তারা আসবে, ছুঁয়ে দেখবে। অনুভব করবে, এ আমার এলাকার ছেলে, আমার জায়গার সাংসদ। নেতা হলে, ঘরের ছেলে হয়ে উঠলেই তো সেটা সম্ভব। তাই ক্ষমতায় নয়, ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি।”
শুধু বঙ্গ-রাজনীতি নয়, দেশের রাজনীতিতে এখন কাদা ছোড়াছুড়ি বেশি, সৌজন্যবোধ কম। দেব সেখানে আশ্চর্য ব্যতিক্রম। রাজনৈতিক মঞ্চে, ভোটপ্রচারেও তাঁর মুখে অকথা-কুকথা নেই। বদলে জায়গা নিয়েছে রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি, তাঁর ভূমিকা এবং পরিকল্পনা। এই উলটোস্রোতে ভাসতে গিয়ে ধাক্কাও যে খেতে হচ্ছে না তাঁকে, তা নয়। তবে দেব অবিচল। রাজনীতিতে যে সৌজন্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে, মানলেও সেটা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি, দাবি দেবের। আর সেই ধারার বাহক হিসেবে নিজের রাজনৈতিক দর্শনকে প্রতিষ্ঠা দিতে চান টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ার বর্তমান ‘মহানায়ক’। বলতে ভোলেননি, “শুধু সাংসদ কেন, মানুষ হিসাবেও বরাবর সৌজন্যবোধের পরিচয় দিয়েছি। যারা আমাকে চেনেন, কমবেশি জানেন। তাদের কাছে আমার এই আচরণ নতুন তো কিছু নয়। ১৮ বছর হয়ে গেল বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছি। ১০ বছর রাজনীতিতে। আমাকে নিয়ে কেউ এমন এমন মন্তব্য করতে পারবে না যে, দেবের অহংকার আছে। দেব কাউকে সৌজন্য-সম্মান দেখায়নি। আমার মনে হয়, রাজনীতির মধ্যে এলেই সবাই ভাবে যে, কে কেমন ব্যবহার করছে। আচরণ করছে। কে কতটা কুকথা বলছে। আজকাল এসবই সেটাই গুরুত্ব পায়। আমি সেভাবে দেখি না। আমি আগেও যেমন ছিলাম, এখনও তাই আছি। বিরোধী দলের কাউকে ‘কেমন আছ?’ জিজ্ঞাসা করার মধ্যে কোনও অপরাধ নেই। সেটাই বেসিক সৌজন্য। এটা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচেও হয়। রাজনীতিতে তাহলে থাকবে না কেন?”
[আরও পড়ুন: একধাক্কায় নামল পারদ, ফের কালবৈশাখীর পূর্বাভাস, কতদিন চলবে বৃষ্টি?]
কিন্তু রাজনীতির ময়দান তো বড় রুক্ষ। সেখানে সৌজন্যের পালটা সৌজন্য দেখানো চলে না, চলে কুরুচিকর আক্রমণ। ঘাটালে ভোটপ্রচারে নেমে বারংবার সেই অভিজ্ঞতা হচ্ছে দেবের। পাচ্ছেন একদা সিনেমাপাড়ার সতীর্থ, আজকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিরণের কাছ থেকে। পালটা আক্রমণে অবশ্য ‘বাপি বাড়ি যা’ মেজাজ নয়, দেবের ব্রহ্মাস্ত্র ‘গান্ধীগিরি’। বঙ্গ-রাজনীতিতে হারিয়ে যেতে বসা রসবোধ ফুটে বের হল দেবের কথায়। বললেন, “ছেলেটার (পড়ুন হিরণ) আমি দোষ দিই না। ও যেখানে প্রচারে যাচ্ছে লোক হচ্ছে না। মিডিয়ার আকর্ষণ টানলে প্রচারে থাকবে, এটাই তো এখন দেশের ৮০ শতাংশ রাজনীতিবিদ করছে। আমি এগুলো ছাড়াই রাজনীতি করতে চাই। ওকে আটকাচ্ছি না। ঘাটালের মানুষ ঠিক করবে কে ঠিক, কে ভুল। ও তো চেষ্টা করছে জেতার জন্য। ভুলে যাবেন না, এটা ক্ষুদিরাম-বিদ্যাসাগরের মাটি। ৪ জুন ও বুঝতে পারবে, যা করছে ভুল করছে। বিশ্বাস করুন, রাজনীতিতে না থাকলে আমরা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, তা নয়।”
দ্বিতীয় দফা সাংসদ মেয়াদ শেষে ঠিকই করে নিয়েছিলেন রাজনীতি থেকে সরবেন। সেই ভাবনা ধরে এগিয়েও গিয়েছিলেন অনেক দূর। তাহলে ফিরে আসা কেন? দেবের স্ট্রেট ড্রাইভ, “দিদির জন্য।” আর? অবশ্যই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। দুবারের সাংসদের কথায়, “ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান- তার জন্যই ফের নির্বাচনে দাঁড়ানো। কেন্দ্র কীভাবে বাংলাকে ট্রিট করবে, তা জানা। কেন্দ্রে যদি বিজেপি আসে, তাহলে সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন। যা কোনওদিন হত না, সেটা যাতে বাস্তবায়িত হয়, সেটাই আমার লক্ষ্য। মানুষের হয়ে আমি কাজ করতে চাই। আর কিছু না। ঘাটালের আশীর্বাদ থাকলে আমি ভালো কাজ করব। ভালো করব।”
কিন্তু এসবই ভোটের সাপলুডোর অঙ্ক। এর বাইরে একটা জগৎ আছে। যেখানে সৌজন্য ছাড়া আর কিছুকেই প্রাধান্য দিতে নারাজ দেব। “যারা আমার নেত্রীকে ‘গদ্দার’ বলেছে, তাদের মোটেই আমি সাপোর্ট করছি না। আমি আমার বক্তৃতায় কাউকে আক্রমণ করি না, কারণ আমি বিশ্বাস করি না এই ধরনের অসৌজন্যে। কাউকে গদ্দার বলতে হবে, আক্রমণ শানাতে হবে। এটা ঠিক নয়। যদি আমি ঠিকঠাক কাজ করে থাকি, ওটাই আমার পরিচয় হয়ে উঠবে। ২৫ মিনিট কথা বলি মঞ্চে। কাউকে আক্রমণ না করে, কুকথা না বলে, আমি কী উন্নয়ন করতে পেরেছি, আমার দল কী উন্নয়ন করতে পেরেছে এবং সর্বোপরি আমাদের দলনেত্রীর বার্তা আমি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি জনসাধারণের মধ্যে। কাউকে এর জন্য আক্রমণ করতে লাগে না। যখন যখন দলের হয়ে প্রচারে গিয়েছি, এটাই করেছি। আসলে এখানকার লোকেদের পলিটিক্যালি আইডিয়োলজি বলে কিছু নেই। নিজেদেরটা বোঝে। আমি নিজেরা বুঝি না। তাকে ভোট দেওয়ার কথা তো বলছি না। ভোট আমাকে দিন, আমাদের দলকে দিন। সৌজন্যবোধটাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আমার জন্য দলের নাম খারাপ হবে না, এইটা দেখা আমার দায়িত্ব।” অকপট ঘাটালের ‘ঘরের ছেলে’।