সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ড হারবার: আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্রের পর্দাফাঁস করে বড়সড় সাফল্য পেল ডায়মন্ড হারবার (Diamond Harbour) জেলা পুলিশের। পাচারচক্রের খপ্পর থেকে উদ্ধার বাংলাদেশি (Bangladesh) নাবালিকা। তার কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আটজনকে। চক্রের সঙ্গে যুক্ত বাকিদের খোঁজেও চলছে জোর তল্লাশি। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জানিয়েছে, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় ছিল। ধৃতদের জেরা করে জানার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, চক্রের খপ্পরে পড়ে পাচার হয়ে যাওয়া অন্যান্য মহিলার নাম, পরিচয় ও খুঁটিনাটি।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৭ ফেব্রুয়ারি। ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলার ‘আস্থা’ অ্যাপে একটি SOS আসে রামনগর থানা এলাকা থেকে। সঙ্গে সঙ্গে কুইক রেসপন্স টিমের (QRT) ভ্যান ওই এলাকায় পৌঁছে যায়। জানা যায়, নুরপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে এসওএসটি পাঠানো হয়েছে। সেখানে পৌঁছে এক নাবালিকাকে উদ্বিগ্ন অবস্থায় ঘোরাফেরা করতে দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়। নাবালিকাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে তার বাড়ি বাংলাদেশের কুমিল্লায়। তাকে সীমান্ত পার করে এদেশে এনে এক যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।
মেয়েটি জানায়, এক যুবকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। প্রেমিক তাকে বান্ধবীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে অন্য এক যুবকের বাইকে তুলে দেয়। সেখান থেকে সাতক্ষীরায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এক মহিলার কাছে। ওই মহিলার মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে নিয়ে আসা হয় তাকে। পাচারকারীরা তার উপর যথেচ্ছ যৌন নির্যাতনও (Sexual Torture) চালায় বলে পুলিশকে অভিযোগে জানায় ওই নাবালিকা। আরও অভিযোগ, তাকে এই মর্মে হুমকি দেওয়া হয় – এখন সে রয়েছে ভারতের মাটিতে, বাড়ি থেকে অনেক দূরে। ফলে কোনও চালাকি করলে তার নিজেরই ক্ষতি হতে পারে। ভয়ে চুপ করে থাকতে বাধ্য হয় ওই নাবালিকা। সীমানা পেরিয়ে ভারতে ঢোকার পর তাকে নিয়ে আসা হয় পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল এলাকার একটি পতিতালয়ে। প্রায় দু’-আড়াই মাস ধরে সেখানে তাকে মূক ও বধির সাজিয়ে রাখা হয়। মুখ থেকে টুঁ শব্দটিও বেরলে পাচারকারীরা তাকে প্রাণে মারারও হুমকি দেয় বলে পুলিশকে জানিয়েছে উদ্ধার হওয়া নাবালিকা।
[আরও পড়ুন: ফের কলকাতায় অগ্নিকাণ্ড, ট্যাংরায় চামড়ার গুদামে দাউদাউ আগুন, ভাঙল গুদামের ছাদ]
ডায়মন্ড হারবার জেলা পুলিশ সুপার (SP) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, নাবালিকার অভিযোগের ভিত্তিতে রামনগর থানায় মামলা দায়ের করে তদন্তে নামে জেলা পুলিশের অ্যান্টি হিউম্যান ট্র্যাফিকিং ইউনিট ও মহিলা থানার পুলিশের একটি বিশেষ দল। পুলিশ সুপার জানান, ওই নাবালিকা পুলিশকে জানিয়েছে, মহিষাদলের ওই পতিতালয় থেকে নিজের চেষ্টাতেই কোনওরকমে পালিয়ে হুগলি নদী পেরিয়ে সে ওই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেছিল। উদ্ধার হওয়া নাবালিকাকে হোমে পাঠানো হয়েছে। পকসো (POCSO) আইনে মামলা রুজু করে শুরু হয়েছে তদন্ত।
আদালতে নাবালিকার গোপন জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে পাচারচক্রের সঙ্গে যুক্ত দুই মহিলা-সহ আটজনকে। ধৃতদের মধ্যে মহিষাদলে পতিতালয়ের মালকিন সোমা ওরফে নন্দরানি মাইতি, সাফাইকর্মী জিয়াউর রহমান তাঁতি ওরফে প্রেমকুমার, পাচারচক্রের পান্ডা নজরুল গাজি, শেখ আনসারি, চক্রে আড়কাঠির কাজে নিযুক্ত থাকা তাপসী ওরফে কাকলি ওরফে বউদি, মফিজুল গাজি ওরফে কালাম, মহিষাদলের বাসিন্দা মনোরঞ্জন বারুই এবং সাদ্দাম। এদের মধ্যে জিয়াউর, নজরুল, শেখ আনসারি, মফিজুল ও সাদ্দামকে বাংলাদেশের নাগরিক বলেই সন্দেহ করছে পুলিশ। পাঁচজনকেই বারুইপুর ও সোনারপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকড়াও করা হয়। আড়কাঠির কাজ করা তাপসীকে ধরা হয় স্বরূপনগর এলাকা থেকে।
[আরও পড়ুন: আগামী মাসেই রাজ্যের ২ কেন্দ্রে উপনির্বাচন, দিনক্ষণ জানাল জাতীয় নির্বাচন কমিশন]
পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের শনাক্তকরণে টিআই প্যারেডে (TI Parade) ইতিবাচক ফল মিলেছে। পাচারচক্রের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কিনা, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এই আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের মাধ্যমে আরও অনেক নাবালিকা ও যুবতীর পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। সে ব্যাপারে জানতে দফায় দফায় চলছে ধৃত পাচারকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ।