গৌতম ভট্টাচার্য: সুদূরপ্রসারী এমন প্রভাব সেই দুর্ঘটনার যে গুগলে এরিকসন মারলে বিশ্ববিখ্যাত সফটওয়ার কোম্পানির নাম আর একমাত্র উদয় হচ্ছে না। এজমালি ব্যবস্থার মতো আপলোডেড হচ্ছেন তিনি ক্রিস্টিয়ান এরিকসন (Christian Eriksen)। ড্যানিশ তারকার মাঠে লুটিয়ে পড়ার সেই মোচড় যত দুর্ভাগ্যজনক হোক, সহমর্মিতায় এক করে দিয়েছে গোটা ফুটবল বিশ্বকে। প্রথম দিনটাই যেন ট্রেন্ডসেটার ছিল যে এবারের ইউরো কাপ (Euro Cup 2020) নিছক ফুটবল যুদ্ধের পরিণতি পেতে রাজি নয়। মেসির (Lionel Messi) ফ্রি কিক গোলসহ কোপা আমেরিকা (Copa America) চলার ঘোর আবহেও তাই ইউরো হয়ে গিয়েছে বিশ্ব ফুটবলগ্রহের প্রতিনিধিত্বকারী প্রকৃত টুর্নামেন্ট।
ওয়েম্বলি মাঠের আশপাশটা সাধারণত একটু ফাঁকা ফাঁকা। স্টেডিয়ামের বাইরে ববি মুরের মূর্তিসহ জায়গাটার অদ্ভূত ব্যঞ্জনা রয়েছে। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে এরিকসনের মতো টুর্নামেন্টের বুকে সিপিআর করার ন্যূনতম প্রয়োজন নেই। ১১ জুলাইয়ের ফাইনালে বরং শরীরী-অশরীরী, মাঠ-মাঠের বাইরে সব গল্পগাছা মিলেজুলে একটা চূড়ান্ত ব্যাপ্তির দিকে এগোবে এবারের টুর্নামেন্ট। এমনিতে যে কোনও টুর্নামেন্ট ‘খুব ভাল’ থেকে ‘চিরস্মরণীয়’তে উন্নীত হয় দুই বিভাগের আদর্শ বিন্যাসে। বল মাঠে দুরন্তভাবে পড়ল এবং সময় সময় তার বাইরে গভীর অর্থযুক্ত নৈঃশব্দ্য বিরাজ করল– দুইয়ের রোমান্টিক সমন্বয়ে। দুটোই যে জরুরি। আর ইউরোর বল মাত্র ক’দিন মাঠে পড়তে শুরু হয়েও যেন অলরেডি সেই যুগ্ম সন্ধানের উঁকিঝুঁকি। পেশাদার নিষ্ঠুরতা কখনও গা ঢাকা না দিয়ে তার মতো করে বিশ্বপর্যায়ের পারফরম্যান্সে থাকবেই। নইলে পাঁচ বছর আগের ফাইনালে জয়সূচক গোলকারী এডেরকে পর্তুগাল-সহ অংশগ্রহণকারী সব দেশের মিডিয়া এভাবে ভুলে যায়? নইলে বিশ্বকাপ জেতানো জোয়াকিম লো-র এবারের প্রতিযোগিতা শেষে বিসর্জন আগাম নির্দিষ্ট হয়ে যায়? কিন্তু এগুলো প্রতিবারের স্টিরিওটাইপ। ব্যতিক্রমী– সমান্তরালভাবে ভালবাসার ছাইগুলো উড়ে উড়ে এসে চোখ ছলছল করে দেওয়া।
[আরও পড়ুন: ‘ঠান্ডা পানীয় না, জল খান’, রোনাল্ডোর আবেদনের পরই বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে Coca-Cola]
নব্বই দশকের মাঝ থেকে আমরা ক্রীড়া সাংবাদিকেরা নিয়মিত লেখালিখি শুরু করি, সর্বগ্রাসী বদলে যাওয়া কনজিউমারিজমের দুনিয়ায় ‘দেশ’ কনসেপ্ট অচল হয়ে গিয়েছে। যে কোনও বিভাগের সেরা পেশাদাররা যেমন তার রোজগারকেই অগ্রাধিকার দেয়। কোনও দেশজ মানচিত্র নির্ভর ভৌগোলিক সীমানাকে নয়। ফুটবলেও তাই হচ্ছে। বিশ্বখ্যাত ক্লাবগুলো যেহেতু মোটা টাকা দিয়ে সারা বছর প্লেয়ার পোষে এবং দেশ সেই তুলনায় হঠাৎ হঠাৎ উদয় হয়ে অকিঞ্চিৎকর পারিশ্রমিক দেয়, দেশজ টুর্নামেন্টগুলো আর শ্রেষ্ঠত্বের সেরা পরীক্ষা হতে পারে না। সে বিশ্বকাপ হোক বা ইউরো। ডেভিস কাপের জেল্লা যেমন চটে গ্যাছে ক্রমশ অন্যগুলোর অধোগতিও প্রতিভাত হবে। দেওয়ালের লিখন তো দেখাই যাচ্ছে। অমাবস্যার পর পূর্ণিমার অনিবার্য আগমনের মতো যে জাতীয়তাবাদের ঢের আগে ডলার।
এরপর ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ! ফাইনাল শেষে শূলবিদ্ধ মেসিকে মারাকানা প্রেসবক্স থেকে সযত্নে নিরীক্ষণ করছি। মাত্র কয়েক মিনিট আগে আগুনে ভস্ম তাঁর বিশ্বকাপ স্বপ্ন। সেই ভস্মাধারকে আরও অপমান করতে যেন ব্রাজিলীয় দর্শকে পুষ্ট ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামের জনমণ্ডলী হাততালি দিয়ে চলেছে জার্মানির জন্য। ফিফার লোকগুলো ওদিকে রেডি। বিশ্বকাপ দেওয়া হবে এবার। কিন্তু তার আগে গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল প্রাপকদের ডাক পড়েছে। গোল্ডেন বুট নিতে মেসিকে হেঁটে যেতে হল এমন কারও সাথে একটু আগে যাঁর গোলে বল ঢোকানোর তাঁর ব্যর্থ চেষ্টা ইতিহাসে এখুনি এন্ট্রি হয়েছে। মাঠ থেকে দোতালা সমান উঁচু ফিফা বক্স পর্যন্ত পাশাপাশি হাঁটলেন ম্যানুয়েল ন্যয়ার ও তিনি। দু’জনে একটা কথাও হল না-র চেয়েও চিরস্থায়ী মনে গেঁথে গেল মেসির নিষ্প্রাণ পদক্ষেপ। যেন গোল্ডেন বুট নয় নিজের ডেথ সার্টিফিকেট নিতে যাচ্ছেন। আহা এই তো সেনাপতি! যুদ্ধ হেরেছে মানে নিজে দলবলসহ মারা গ্যাছে। প্রাচীন ফ্রান্স তো বলেই দিয়েছে ডুয়েল হারলে পরাজিত ব্যক্তির বেঁচে থাকার অধিকার থাকে না।
[আরও পড়ুন: রেকর্ড গড়ে সপ্তম স্বর্গে রোনাল্ডো, জয় দিয়ে ইউরো কাপ শুরু পর্তুগালের]
একটু আগে আরও একটা স্তব্ধবাক দৃশ্য দেখেছি। মুখভর্তি রক্ত আরও গড়িয়ে পড়ছে। অথচ তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষায় সতীর্থদের সঙ্গে হাসছেন সোয়াইনস্টাইগার। জার্মানদের জাত্যাভিমান তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতোই বিশ্বখ্যাত। তবু এটা মনে হল চিরন্তন ফ্রেম। সদ্য বিশ্বকাপ জিতল তো কী? একে তো এখুনি হাসপাতাল নিতে হবে চোটের যা বহর। একটা মানুষ নিজের দেশের অভিলিপ্সার সঙ্গে কতটা একাত্ম হলে এমন যন্ত্রণার মধ্যে হাসতে পারে? পরমুহূর্তে মনে হলো নিছক ফ্রেম ভাবছি কেন? ফুটবল মাঠের অয়েল পেইন্টিং যদি এই দৃশ্যটা না হয় তাহলে পেইন্টিং কাকে বলে?
তৃতীয় অভিজ্ঞতা চার বছর পরের রাশিয়া বিশ্বকাপে। ব্যক্তির নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo)। রুশ দেশের সমুদ্রসৈকত ঘেঁষা শহর সোচি-র মারকাটারি সংঘাতে দু’বার এগিয়ে গিয়েও অমন দুর্ধর্ষ স্পেনের কাছে পিছিয়ে পড়েছে তাঁর পর্তুগাল। ২-৩ অবস্থায় শেষ মিনিট ফ্রি কিক পর্তুগালের। স্পানিয়ার্ডরা মরণপণ ওয়াল করেছে। দু’পয়েন্ট তো ঘরে ঢুকে গেছে তাদের জন্য। শুধু এই শট-টা ওয়ালে ধাক্কা লেগে ফিরে এলেই হল। বাইরে উদ্দেশ্যহীন উড়ে গেলেও চলবে। এই অবস্থায় মাঠের পশ্চিমমুখো বল বসালেন সিআর সেভেন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে মাসলগুলো নরম করে নিলেন। দুটো পা দু’দিকে সামান্য স্ট্রেচ করলেন। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কঠোর মুখ যেন ফ্রান্স সীমান্তে যুদ্ধে পাঠিয়েছে তাঁর দেশ। এরপর বিশ্বপর্যায়ের মাপেও খুব বেশি রকম ভাল একটা ফ্রি কিক এবং ৩-৩। কোথায় আলাদা রিয়াল, জুভেন্তাস বা সাবেকি ম্যান ইউ-র লোকটা? ইউরো সাংবাদিক বৈঠকে নিজের সামনে থাকা কোকের বোতল সরিয়ে দেওয়ার মতো টনটনে চেতনা থাকতেই পারে তাঁর স্পনসর-বন্ধু মননের। তা বলে কমিটমেন্টে ফাঁকি কোথায়? ইউরোয় সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন। ১৭৯৩ মিনিট মাঠে থেকেছেন। হ্যাঁ ,পরেরটাও রেকর্ড।
এমন তিন ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর গ্রহের কোন সাহসী বলবে আধুনিক পেশাদারিত্বের হাওয়ায় দেশ কনসেপ্ট নিহত? আর কোভিড বিশ্বব্যাপী বিপন্নতার এমন ম্যানহোল খুলে দিয়েছে যে চিন বাদ দিয়ে বাকি দেশগুলো যেন ঐতিহাসিকভাবে পরস্পরের আরও কাছাকাছি। সেরা পেশাদারও গত এক বছরে মর্মান্তিক উপলব্ধিতে এসেছে যে ধন, জীবন, যৌবন, সাফল্য সব ক্ষণস্থায়ী। নতুন পৃথিবীতে এপার আর ওপারের মধ্যে ব্যবধান মাত্র কয়েক মিলিমিটারের। কখনও কখনও একটা মাস্ক পরা বা না পরার মতো আপাত তুচ্ছ ঘটনার দ্বারা নির্দেশিত।
[আরও পড়ুন: রূপান্তরকামীদের COVID টিকাকরণের ব্যবস্থা করলেন বাঙালি তিরন্দাজ রাহুল ও দোলা]
এবারের ইউরো তাই নিছক দেশ বনাম দেশ নয়। দেশ + দেশ+দেশ। ডেনমার্কের (Denmark) এরিকসনের জন্য প্রার্থনা করছেন ইংল্যান্ডের (England) লিনেকার, এটাই এবারের টুর্নামেন্টের স্পিরিট। ঠিক যেমন আটচল্লিশে ব্র্যাডম্যানের টিমের বিখ্যাত ইংল্যান্ড সফর ছিল। লেন হাটনকে বাউন্সারে ঝাঁঝরা করে দিতে চাইছেন প্রতাপান্বিত অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক। আর ক্যাপ্টেনের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে মিলার-লিন্ডওয়াল বলছেন, ডন, যুদ্ধে কত লোক মারা গ্যাছে দেখোনি? কত নিরপরাধ বোমা বিস্ফোরণে মরেছে। এর পরেও বাউন্সার?
কোভিড পৃথিবীতে জীবন আরও বেশি রকম অনিত্য। রোল কলের মতো যে কোনও সময় ডাক আসতে পারে জেনেও ঘড়ির কাঁটার মতো যে যার নিজের কাজ করে যায়। প্যারিসের মঁমার্তে বসে লোকে ছবি আঁকে। লন্ডনে টেমসের ধারের অস্ট্রেলিয়ান পাবে বিয়ার আর কবিতা নিয়ে বসে যায়। আমস্টারডামের উইন্ডমিলের ধারে প্রেম করে। জার্মানির হ্যামবুর্গে ভর দুপুরেও শরীর ফিট রাখতে দৌড়য়। একমাত্র বুয়েনস আইরেস শহরতলির জার্ডিন বেলা ভিস্তা সমাধিক্ষেত্রে তিনি শুয়ে থাকেন নিশ্চল। সব সময়ের জন্য। কোপা আমেরিকা অবশ্যই স্মরণ করবে কারণ গত ২৫ নভেম্বর গোটা পৃথিবী কাঁদিয়ে তাঁর অকস্মাৎ বিদায়ের পর লাতিন আমেরিকায় এই প্রথম বিশ্ব পর্যায়ের টুর্নামেন্ট। কিন্তু তিনি তো ফুটবলের দেবদূত। নিছক কোনও ভৌগোলিক গণ্ডির নন। তাছাড়া ক্লাব ফুটবলে ইউরোপকে দু’হাত ভরে ঐশ্বর্য দিয়েছেন। ইউরো কেন মানবতার এমন আবহে দিয়েগো মারাদোনাকে (Diego Maradona) স্মরণ করবে না? এমনিতে প্লাতিনিদের মতো ফুটবল কর্তাদের সঙ্গে তাঁর যত তিক্ততম ঝামেলা, সব দেশের প্লেয়ারদের সঙ্গে ততটাই প্রগাঢ় ভালোবাসা। একমাসের টুর্নামেন্টে কারও একবার মনে পড়বে না তাঁর ট্র্যাজিক বিদায়? একবারও কি দেশজ গণ্ডি ভেঙে কারও মুক্তচিন্তায় হাওয়া দেবে না যে, এই লোকটা ছিল আদতে সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত ফুটবলের আত্মা? দিয়েগোর জন্য কাপ জিততে চাই–এবার যদি উচ্চারিত না হয় তা হলে তো বলতে হয়, বরাবরের মতো ইউরো কাপ ইউরোপেই থেকে গেল!