বিশ্বদীপ দে: ৩৭ বছর আগের একদিন। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর গন্ধ। চুরাশির সেই শীতের মধ্যরাতে (২ ও ৩ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী কোনও এক সময় থেকে গ্যাস লিক হওয়া শুরু হয়) আচমকাই ছড়িয়ে পড়তে থাকে মিথাইল আইসোসায়ানেট। তারপর ক্রমে অসংখ্য অজস্র নিরীহ মানুষকে মৃত্যুর গহ্বরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে থাকে এক অতিকায় হিংস্র জন্তুর মতো। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা হাজার চারেকের মধ্যে। কিন্তু বেসরকারি মতে, আসল সংখ্যাটা অনেক বেশি। একটা হিসেবে বলছে সংখ্যাটা অন্তত ২৫ হাজার! ওখানেই শেষ নয়। সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প বিপর্যয়ের নিকষ কালো অন্ধকার আজও বয়ে ফিরতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। মধ্যপ্রদেশের (Madhya Pradesh) ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার (Bhopal Gas Tragedy) বীভৎসতা তাই কমবেশি একই রকম দগদগে হয়েই রয়ে গিয়েছে।
সদ্য বর্ষপূর্তি হল সেই দিনটির। শুভ ঘটনার স্মৃতি যেমন ফিরে ফিরে আসে, একই ভাবে ভয়ংকর দুঃস্মৃতিও বারবার মাথাচাড়া দেয়। বিশ্বের বৃহত্তম শিল্প বিপর্যয় ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনাও তাই বারবার তার অন্ধকার ছায়া মেলে উড়ে আসে ইতিহাসের কিনার ঘেঁষে। কিন্তু একটা ঘটনার বীভৎসতাকে বোঝাতে অনেক সময়ই সামগ্রিক পরিসংখ্যান ও খতিয়ানের চেয়েও মর্মন্তুদ ও ইঙ্গিতবাহী হয়ে উঠতে পারে কোনও একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা। যা এক আঁচড়ে চিনিয়ে দেয় ঘটনার সুগভীর ক্ষতকে।
[আরও পড়ুন: কোভিড সারলেও শেষরক্ষা হল না, প্রয়াত প্রবীণ সাংবাদিক বিনোদ দুয়া]
ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার কথা মনে হলেই প্রায় সকলেরই চোখের সামনে একটা সদ্যমৃত শিশুমুখ মনে পড়ে। যাকে গোটা বিশ্ব চেনে ‘ভোপাল গ্যাস ডিজাস্টার গার্ল’ নামে। গ্রাউন্ড জিরোয় দাঁড়িয়ে নিজেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই পাবলো বার্থলোমিউ নামের এক ফটোগ্রাফার তুলেছিলেন দুর্ঘটনায় মৃত কন্যাকে কবর দেওয়ার ছবি। তখনও তাকে পুরোপুরি কবরস্থ করা হয়নি। অর্ধেক মাটিতে পোঁতা সেই শিশুটির মৃতপ্রস্তর চোখ দুটি যে কারও মনের মধ্যে সটান গেঁথে যায় ছুরির ফলার মতো। সেই ছবিই হয়েছিল ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো’। অন্য এক অ্যাঙ্গল থেকে ছবিটি তুলেছিলেন আরেক বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রঘু রাইও। কিন্তু এই ছবিটি বহুল প্রচারিত। তুলনায় অনেক কম মানুষ চেনেন চিকিৎসক ডিকে শতপথীকে। এই লেখায় তাঁর কথাই বলব আমরা।
৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৪। একেবারে কাকভোরে, ৪টের সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন মধ্যপ্রদেশের হামিদিয়া সরকারি হাসপাতালের তৎকালীন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিব্যকিশোর শতপথী। ঠিক সেই সময় তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে দেন তাঁর প্রফেসর। মধ্য তিরিশের ডা. শতপথীকে ডেকে তুলে তিনি বলেন, ”দ্রুত মর্গে চলে যাও। বহু মানুষ মারা গিয়েছে। মৃতের সংখ্যা আমাদের কল্পনারও বাইরে।” স্বাভাবিক ভাবেই ঘুম ভেঙে এমন কথা শুনে খানিকটা ঘাবড়েই যান শতপথী। কিন্তু ডিসেম্বরের সেই কনকনে ভোরে তাঁর কল্পনারও অতীত ছিল শবদেহের কোন দীর্ঘ সারি তাঁর অপেক্ষায় রয়েছে।
[আরও পড়ুন: কর্ণাটকের পর গুজরাট, ভারতে তৃতীয় ওমিক্রন আক্রান্ত ব্যক্তির হদিশ]
মর্গের কাছে আসতেই তিনি দেখলেন, গান্ধী মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেশ কিছুটা দূরের মসজিদ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ। তাঁদের কেউ মৃত, কেউ বা অজ্ঞান। কেউ বমি করছে। কেউ কেউ হাহাকার করচে একটু জল খেয়ে। আসলে শহরের জনবসতির একেবারেই ভিতরেই ছিল ইউনিয়ন কার্বাইডের ওই রাসায়নিক কারখানা। সেখানে তৈরি হত মিথাইল আইসোসায়ানেট। গভীর রাতে প্রায় ৪০ মেট্রিক টন মারণ গ্যাস লিক করে বেরতে থাকে। দ্রুত মিশে যায় বাতাসে। যেহেতু ওই গ্যাস ভারী, তাই তা দ্রুত জমে যেতে থাকে নিচের দিকে। ঘুমন্ত মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের ভিতরে চলে থেকে থাকে। আর অচিরেই শহর জুড়ে শুরু হয় মৃত্যুর সংক্রমণ।
শতপথীর কথায় ফিরি। তিনি হাসপাতালের বাইরের অচেতন মানুষদের ওই সারিকে টপকে দ্রুত ছুটতে ছুটতে এমারজেন্সি ইউনিটে পৌঁছে যান। গিয়ে দেখতে পান মর্গ উপচে পড়ছে মৃত মানুষে। সব মিলিয়ে তখনই সংখ্যাটা ৬০০ অতিক্রম করে গিয়েছে। বাথরুমে পর্যন্ত রয়েছে মৃতের স্তূপ। দু’টি সারিতে তাদের শোয়ানো রয়েছে। একেক সারিতে অন্তত ৩০ জন করে রয়েছে।
কেবল এইটুকু কল্পনা করলেই বোঝা যায়, সময় সময় ভয়ংকর দুঃসপ্নকে কত অনায়াসে হারিয়ে দিতে পারে বাস্তবের তীক্ষ্ণ দাঁত-নখ। ফালাফালা করে দেয় চেতনাকে। তবু তারই মধ্যে কাজ তো করতেই হয়। শতপথী বলছেন, ”যেভাবে বন্দিদের আমরা নম্বর দিই, সেভাবেই দেহগুলিকে নাম্বারিং করে ক্রমানুসারে ময়না তদন্ত করা শুরু করি। আমি ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট ও ইনটার্নদের প্রত্যেককে দশটি করে দেহ দিয়ে দিই। এবং তাদের নির্দেশ দিই মৃতদের শব ব্যবচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে সেই মৃত মানুষগুলির পোশাক, টিপ, প্রসাধনের বর্ণনাও লিখে রাখতে। হিন্দি, ইংরেজি, ওড়িয়া, মারাঠি- যে ভাষাতেই হোক, তা লিখে রাখতেই হবে।” আর তিনি একা? সব মিলিয়ে ৮৭৬টি মৃতদেহের ময়না তদন্ত করেছিলেন তিনি!
কেমন ছিল চোখের সামনে পোকামাকড়ের মতো মানুষকে মরে পড়ে থাকতে দেখে। একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের পেশাই তাকে এসব বিষয়ে আপাতনিস্পৃহ করে তোলে। কিন্তু ভোপালে সেদিন যা ঘটেছিল তা যে কোনও পেশাদারের হৃদয়কে মুচড়ে দিতে পেরেছিল। আজ শতপথী ৭৪ বছরের বৃদ্ধ। কিন্তু সেদিনের স্মৃতির ভার আজও তাঁকে আচ্ছন্ন করে তোলে। তিনি বলে ওঠেন, ”যখন আপনি চোখের সামনে শয়ে শয়ে মৃতদেহ শুয়ে থাকতে দেখেন, আপনিও ভিতরে ভিতরে মরে যেতে থাকেন একটু একটু করে। সেই সময় একটাই করণীয় থাকে। নিজেকে নিজের ভিতর থেকে চুরি করে নিয়ে কাজে ডুবিয়ে দেওয়া। কিন্তু পরের দিন আমি অন্তত দশ বার কেঁদে কেঁদে উঠছিলাম কাজের ফাঁকে।”
প্রায় চার দশক অতিক্রান্ত। আজও ন্যায়বিচার মেলেনি বলেই দাবি বহু আক্রান্তের। গোটা শহরটাকে একটা গ্যাস চেম্বার বানিয়ে তোলায় মূল অভিযুক্ত ইউনিয়ন কার্বাইডের সিইও ওয়ারেন অ্যান্ডারসন সেই যে দেশ ছেড়ে পালালেন, আর তাঁকে ভারতে ফেরানো যায়নি। ২০১৪ সালে মারাও গিয়েছেন তিনি। ফলে তাঁর বিচার অধরা রয়ে গিয়েছে চিরকালের জন্য। দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যাওয়া প্রায় হাজার চারেক মানুষ এবং কোনও না কোনও ভাবে শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সাড়ে পাঁচ লক্ষের বেশি মানুষের অভিযোগ, মৃতদের পরিবার তো বটেই তাঁরাও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পাননি।
সরকার বদলেছে। কিন্তু অসহায় মানুষের চোখের জল একই রকম নোনতা রয়ে গিয়েছে। ডাক্তার শতপথীর কথায়, ”যদি এই ট্র্যাজেডি শহরের সম্ভ্রান্ত মানুষদের এলাকায় হত, যেখানে শহরের মন্ত্রীরা বাস করেন তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা একেবারেই অন্য় রকম হত। এই ঘটনা যেখানে ঘটেছিল সেখানে বাস করতেন দিনমজুর দুঃখী মানুষরা। তাই চল্লিশ বছর পেরতে চললেও ন্যায়বিচার মেলেনি।”
এরপর আর কথা থাকে না হয়তো। তিক্ত সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে কেবল কবীর সুমনের গান বেয়ে আসা সেই প্রশ্নটিকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে আরও একবার, ”কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে, বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে?”