বিনোদ ঘোষাল: আচ্ছা, সুখ বিষয়টা কি নস্ট্যালজিক? মানে বলতে চাইছি, যখনই আমরা কোনও সুখের কথা ভাবতে বসি তখনই কেন অতীত মনে পড়ে? বর্তমানে শুধুই কি দুঃখ আর অসুখ? ব্যাস! পৃথিবীর যে কোনও মানুষকে জিজ্ঞাসা করুন আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কোনটা? সে বলবে তার বাল্যকালের কথা। অন্তত শতকরা নব্বই ভাগই তাই বলবে। অথচ কথায় বলে মানুষের যৌবনকাল নাকি জীবনের সেরা সময়। তাহলে সে কেন যৌবনকে ছেড়ে শৈশবকে ধরে?
আসলে শৈশবের মধ্যে মিশে থাকে এক যৌথ জীবন। অনেকগুলি মানুষ ঘিরে থাকে তাকে। আর মানুষ যেহেতু মূলত সমাজবদ্ধ জীব, সে একা থাকতে চায় না। একা থাকতে পারে না। তাই জীবনের যে সময়টায় তার চারপাশে অনেকে ঘিরে থাকে, যারা তাকে ভালোবাসে, স্নেহ করে, এবং সেই স্নেহ-ভালোবাসার মধ্যে কোনও স্বার্থ নেই, কোনও দেওয়া-নেওয়া নেই। গোপন অ্যাজেন্ডা নেই, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। হয়তো সেই কারণেই শৈশব এত প্রিয়, এত আপন, এত ভালোবাসার। যৌবনকালে শক্তি আছে, উচ্ছ্বাস আছে, মুক্তি আছে, কিন্তু তার সঙ্গে রয়েছে দায়িত্ব। তার সঙ্গে রয়েছে অসুখের বোধ, কষ্ট-যন্ত্রণার অনুভূতি, বিচ্ছেদের তাপ। হয়তো সেই কারণেই যৌবনকালটা ভালোয়-মন্দয় মেশানো খানিক। আর আমাদের মতো যারা যৌবন কাটিয়ে প্রৌঢ়ত্বের দিকে ঝুঁকেছি তাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে ওই শৈশবের ঝুমঝুমি, যা একানে কখনও একা একা নাড়িয়ে মনে করতে চাই ফেলে আসা, না ফিরে পাওয়া নিজের বাল্যস্মৃতি।
এই যে এতখানি গৌরচন্দ্রিকা তা কেবলমাত্র মূল কথাটি নিয়ে বলার আগে কিছুটা প্রস্তুতি। কারণ যে বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসেছি তা হল বাঙালির দুর্গাপুজোয়(Durga Puja 2024) যৌথতার গুরুত্ব বা অবদান কতখানি। না এই নিয়ে আমি কোনও থিসিস খাড়া করতে চাইছি না। কোনও পরিসংখ্যান, সমীক্ষা ইত্যাদি দিয়ে লেখাটি খামোখা ভারী করে তুলতেও চাইছি না। বলতে চাইছি স্রেফ কিছু মনের কথা। প্রতি বছর পুজো এলেই আমার মনে পড়ে যায় নিজের শৈশবের কথা। আর শৈশব মানে একগাদা বন্ধুবান্ধব তো বটেই, সঙ্গে আমার মেজো জেঠু, সেজো জেঠু, ন জেঠু এবং আমার মোট সাতজন জ্যাঠতুতো দিদির কথা। আমার সহোদরা দিদিকে ধরলে অবশ্য সংখ্যাটা আট। এবং অবশ্যই দুই জ্যাঠতুতো দাদা। আমার মোট পাঁচজন জেঠু ছিলেন, আমার বাবা সর্বকনিষ্ঠ। আবার আমাদের বাড়ির মোট এগারোজন ভাইবোনের মধ্যে আমিই ছিলাম সবথেকে ছোট। এই পাঁচ জেঠুর মধ্যে দুজন ছিলেন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। আমার জন্মের বহু আগেই তাঁরা সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। তাই আমি কোনওদিন তাঁদের চোখে দেখিনি। কিন্তু বাকি তিন জেঠু এবং দাদা-দিদিদের আমি প্রাণভরে পেয়েছি। আমার তিন জেঠুই কলকাতায় থাকতেন, একমাত্র আমরাই থাকতাম মফস্বলে। তাই পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়া সকলের সঙ্গে দেখা হত দুর্গাপুজোর সময়। আমার ঠাকুমা থাকতেন আমাদের মফস্বলের বাড়িতে।
পুজোর কিছুদিন আগে থেকে এক একদিন এক এক জেঠু সপরিবার আসতেন ঠাকুমা এবং আমাদের সকলের জন্য নতুন জামাকাপড় নিয়ে। তিন জেঠুর মধ্যে ন জেঠুর সঙ্গে আমার সখ্য ছিল সবচেয়ে বেশি। আমার যত আবদার ন জেঠুর কাছে। কী সুন্দর পাঞ্জাবি, টিশার্ট নিয়ে আসত আমার জন্য! তার পর পুজোয় সপ্তমী বা অষ্টমীর দিন আমরা সপরিবার চলে যেতাম ন জেঠির বাড়িতে। ন জেঠু সরকারি আধিকারিক ছিল। সরকার থেকে গাড়ি পেত। সাদা অ্যাম্বাসাডর। এখন বললে কেউ বিশ্বাস করবে কি না জানি না, ওই গাড়িতে ড্রাইভার বাবা, জেঠু, মা, ন মা, চার দিদি এবং আমি মানে মোট দশজন ঢুকতাম। কী করে অ্যাডজাস্ট হত খোদায় মালুম। যাই হোক যদি হয় সুজন গাড়ির ভেতর দশজন। রাবণ একা দশটা মাথা অ্যাডজাস্ট করে জীবন কাটিয়ে দিলেন আর আমরা একটা অ্যাম্বাসাডরে দশজন অ্যাডজাস্ট করতে পারব না!
ওইটুকু বয়সে কষ্টবোধ ছিল না। বড়দেরও মনে হয় অত কষ্ট হত না, কিন্তু আনন্দ হত ঢের। কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্কের ঠাকুর দেখা, রেস্তরাঁয় খাওয়াদাওয়া। তার পর রাতে জেঠুর বাড়িতেই থেকে যাওয়া। পরদিন আবার সবাই মিলে বাগবাজারে গুরুবাড়ির দুর্গাপুজো অ্যাটেন্ড করা। সেখানে আমার সব জেঠু এবং দাদা-দিদিরাও চলে আসত। সারাদিন গুরুবাড়িতে হইহই। উপলক্ষ দুর্গাপুজো। ধুপধুনো-নতুন জামার গন্ধ, ঢাকের বাদ্যি, ধুনুচি নাচ আর আমার বাবা-জেঠু-মা-জেঠিমা-দাদা-দিদিরা মিলে কী তুমুল গল্প! সে যেন শেষই হত না। অষ্টমীর সারাদিন গুরুবাড়িতে কাটিয়ে দুপুরে ভোগ খেয়ে আমরা সবাই মিলে যেতাম বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপুজো দেখতে। ঠাকুর দেখার থেকে ওই মেলা আমাকে বেশি টানত। আর ওই আলো ঝলমলে রাস্তা আমাকে মাতাল করে দিত। আর ভালো লাগত আমাদের পুরো পরিবারের এই একত্র হওয়া। আমার কাছে তাই দুর্গাপুজো মানেই ছিল যৌথতা।
কিন্তু শুধুই কি পারিবারিক মিলন? না, তা নয়, আমার ছোট মফস্বলের মধ্যেও ছিল দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এক ভিন্নতর মিলনমেলা। জেঠু-জেঠিমা দাদা-দিদিদের সঙ্গে যেমন আমাদের দেখা হত বছরে মাত্র কয়েকবার। তার মধ্যে দুর্গাপুজোয় সবথেকে বেশি, কিন্তু আমার পাড়ার প্রতিদিনের বন্ধুরা, আমাদের পাড়াতুতো দাদা-দিদি-কাকু-কাকিমা-জেঠু-জেঠিমারাও পুজোর কটা দিন কেমন যেন নতুন হয়ে উঠত। সবাই যেন আরও আন্তরিক, আরও আপন। কী ভালো যে লাগত! পাড়ার ক্লাবের বারোয়ারি পুজোর মণ্ডপে বন্ধুরা সারাদিন প্রতিমার সামনে বসে আড্ডা দিতাম। ক্যাপবন্দুক ফাটাতাম। নতুন জামা-প্যান্টের গন্ধের সঙ্গে ক্যাপ ফাটার পোড়া গন্ধ... সঙ্গে মণ্ডপের ধুনো-ফুল-পাতার গন্ধ মিশে এক অলৌকিক পরিবেশ রচিত হত। ইচ্ছে করত বন্ধুদের আরও বেশি ভালোবাসি। আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।
পাড়ার দাদা-দিদিরা যেন ওই পুজোর দিনগুলোতে আরও সুন্দর হয়ে উঠত। বাবুনদা, বুগলুদা, শিবাণীদি, মৌলীদি, টিংকুদা, আরতি কাকিমা, নাড়ু জেঠু সবাই কেমন ঝকঝকে হয়ে উঠত। সবাই মিলে যখন অঞ্জলি দিতাম ঠাকুরমশাইয়ের বলা মন্ত্র বুঝতে না পারলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিবুজেঠু বা অজয়কাকা আমাকে মন্ত্রটা ভালোভাবে উচ্চারণ করিয়ে দিতেন। আমার অঞ্জলির জন্য ফুলের মধ্যে বেলপাতা না পেলে বন্ধু অর্ণব ওর নিজের থেকে খানিকটা ছিঁড়ে আমাকে দিয়ে দিত। অথচ সেই অর্ণবই স্কুলে নিজের টিফিন কারও সঙ্গে ভাগ করত না। এই যে পুজোয় সবাইকে অন্যভাবে পাওয়া, একসঙ্গে পাওয়া- এর স্বাদই ছিল আলাদা। শুধু বাল্যকাল নয়, কৈশোর, যৌবনের প্রাক্কালও ছিল এমনই বন্ধুবৃত্তে থাকা। তার পর বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ, বন্ধুরা যে যার নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমার দাদা-দিদিরাও নিজের স্বামী-স্ত্রী সন্তানদের নিয়েই জগৎ তৈরি করে ফেলল। বাবা-জেঠুরা একে একে চলে গেল। ফাঁকা হয়ে গেল জীবনের একটা হইহুল্লোড়ের দিক।
কিন্তু তাই বলে পুজো বন্ধ থাকল না। সে প্রতিবছর তার নিয়মে আসে। পাড়ার সেই পুজোতে এখনও সপরিবার অঞ্জলি দিতে যাই। কখনও দেখা হয়ে যায় পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। পাড়ার অনেক দিদিরাই এখানে আর নেই। অনেক জেঠু-কাকু-কাকিমাই কালের নিয়মে চলে গেছেন। যারা রয়েছেন অনেকে বয়সের ভারে আর ঘর থেকে বেরতে পারেন না। টের পাই হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছু। নিজের স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে কলকাতা শহরে ঠাকুর দেখতে বেরই প্রতিবছর। গুরুবাড়ির পুজো আর হয় না। বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসবের মণ্ডপে দাঁড়িয়ে ওই ভিড়ের মধ্যে খুঁজি আমার ন জেঠু, বাবাকে। ইচ্ছে করে আবার সেই আগের মতো হয়ে যাই। মা দুর্গার ছেলেমেয়েদের বয়স বাড়ে না, কিন্তু আমরা বড় হয়ে গিয়ে হারিয়ে ফেলি অনেক কিছু। ছোটবেলায় মনে করতাম বড় হওয়ার থেকে আনন্দের বুঝি আর কিছু নেই। আর আজ এই বড়বেলায় শুধু হেঁটে বেড়াই নিজের ছোটবেলার জগতে। ছোটবেলা মানেই জুড়ে জুড়ে থাকা আর ভাঙতে ভাঙতে টুকরো হয়ে একলা হয়ে যাওয়ার নামই বড়বেলা।