সাম্যময় হালদার: "সকলি ফুরায়/ ফুচকার প্রায়/ পড়ে থাকে শালপাতা।" এই শালপাতাই আমাদের স্মৃতি! তবে কিনা সেকালে শুধু ফুচকার ক্ষেত্রে নয়, 'ঘুগনি-পাত্র'ও ছিল শালপাতা। পুজোমণ্ডপের আশপাশ অস্থায়ী ডেকার্স লেন হয়ে উঠত। টক-ঝাল-নোনতা গন্ধে ম-ম চত্বর। পাঁচ বা দশ টাকাতেই বাজিমাত। নরম শালপাতার উপর গরম ঘুগনি ঢেলে দিত দোকানি। সেই সময়টাকে ফুচকা যুগ, মতান্তরে ঘুগনি যুগ বললেও ভুল বলা হয় না। কারণ পিজ্জা-বার্গার-পাস্তার মতো বিদেশি হামলা নেই। এমনকী মোগলাই খানা বিরায়ানিও মেলে কলকাতায় নির্দিষ্ট কিছু ঐতিহ্যশালী দোকানে। অতএব, তখনও ঘুগনির দাপট শহরতলি মধ্যমগ্রামে। তবে কিনা সেরাটা বাড়িতেই তৈরি হত। বারো ঘর এক উঠোনের জেঠি-কাকির সংসারে, সেই বেঁচে থাকার কোনও কোনও সন্ধ্যায় ন-জেঠি দুরন্ত ঘুগনি তৈরি করতেন।
কে না জানে বাইরের খাবারের সঙ্গে ট্যাকের সম্পর্ক সুগভীর। এদিকে আমরা ছিলাম গরিবের এট্টু উপরের লোক। বাপ মরা ছজনের সংসারে ছোটদের জন্য মহার্ঘ ছিল পাঁচ বা দশ টাকা হাত খরচ। তথাপি গত শতাব্দীর নয়ের দশক যেহেতু তাই মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, রিলস, সেলফি, ইউটিউব নেই। ব্রান্ডেড জামা-ঘড়ি-সানগ্লাস নেই। নেই পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা বিউটি পার্লার। শপিং মলও গায়েব! ফলে যত রাজ্যের গরিব এবং ডিগ্ল্যামারাস চিজ জীবিত এজীবনে। যেমন, বই-আড্ডা-উঠোন-নাম পাতাপাতি-গানের লড়াই-মাঠ-ফুটবল...। জিনিসের দামও অনেকটা রোগা। তাই হাফপ্যান্ট ছেলে পুজোর সময় দাপটে গিয়ে দাঁড়ায় মধ্যপাড়ার মাঠে, মণ্ডপ ঘেঁষে অস্থায়ী দোকানের সামনে। ঝাল-ঝোল ঘুঘনি দিয়ে সে ষষ্টী-সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী দিব্য চেটেপুটে খায়। আহা জীবনের স্বাদে একটু যা ঝাল বেশি!
পুজোর সময় হোক বা বছরের অন্য কখনও ন-জেঠির ঘুগনিতে ঝাল থাকত পরিমাণ মতো। ডাল ভেজানো থেকেই টের পেতাম রান্নাঘরে আনন্দের আয়োজন হচ্ছে। মন ভালো করা এক বাটি ঘুগনির সঙ্গে সন্ধেবেলা দেখা হত আমাদের। উপরে পেয়াঁজ আর লঙ্কা কুচি। ঘরের ঘুগনিতে অবশ্যই মশলা কম থাকত। স্বাদও হত ঘরোয়া। আসলে ন-জেঠির তৈরি ঘুগনি, রাঙাকাকির তৈরি পিঠে, মায়ের তৈরি নাড়কেল নাড়ু তো কেবল খাবার নয়, তা আসলে 'একান্ন' ভেঙে যাওয়া নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারে হাতের পরে হাত রাখার, বেঁধে থাকার শেষ চেষ্টা। আজ আর সে দায় নেই সময়ের! তাছাড়া ব্র্যান্ড না হলে লোকে আর ঘুগনিও খাচ্ছে না। যতই মা-কাকি-জেঠির তৈরি ঘুগনিতে নিখাদ ভালোবাসার ফ্লেভার থাকুক।