সুমিত বিশ্বাস, বারাণসী: পাঁচ বছর, ১০ বছর নয়। ২৫৬ বছর ধরে বিসর্জন ছাড়া একই মাতৃপ্রতিমায় পুজো হয়ে আসছে পুরাতন দুর্গাবাটিতে। প্রতিমায় থাকা খড়, কাদা, বাঁশ, সুতো কোন কিছুই নষ্ট হয়নি। উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে এই অপরিবর্তিত দুর্গামূর্তিতে এবারও প্রথা মেনে পুজো হবে। নিত্য পুজো হলেও মা উমার আগমনে বারাণসীর পুরাতন দুর্গা বাটি বা দুর্গা বাড়ি নবরূপে সেজে উঠছে।
ঠাকুরদালানে চলছে চুনের প্রলেপ। ধুলো, আস্তরন সরিয়ে ঢাকে কাঠি পড়ছে। ঝাড়বাতি থেকে সরানো হচ্ছে ঝুল। যেন নতুন চেহারায় সেজে উঠছে বারাণসীর সবচেয়ে প্রাচীন বনেদি পরিবারের দুর্গাপুজোর (Durga Puja 2023) পরিমণ্ডল। এই পুজোর যোগ যে রয়েছে বাংলার সঙ্গে। হুগলির জনাই রোডের মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো বারাণসীতে চলে গিয়েছিল। কী কারণে ওই পুজো কাশীতে গেল, তা জানা নেই ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের।
সময়টা ১৭৬৭। সে বছরই বারাণসীতে ওই পুজো প্রথম শুরু হয়। উত্তরপ্রদেশের ওই শহরের মদনপুরা এলাকায় একচালার প্রতিমা গড়ে মাকে পুজো দেওয়া হয়। মহাষষ্ঠীতে বোধন হয়ে চারদিন ধরে সমস্ত নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে মায়ের পূজো চলে। তবুও দশমীতে ঘটে গেল অলৌকিক ঘটনা। মাকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য মাতৃপ্রতিমা তোলার চেষ্টা করলেন ওই পরিবারের সদস্যরা সহ অনেকেই। কিন্তু শত চেষ্টাতেও নড়ানো গেল না মায়ের মূর্তি। একেবারে পাথরের মতো বসে রইলেন দশভূজা। হইচই বেঁধে গেল ওই দুর্গাবাটিতে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র মদনপুরা, লাগোয়া বাঙালিটোলা সহ সমগ্র বারাণসীতেই। ভিড় বাড়তে লাগল দুর্গাবাটিতে।
[আরও পড়ুন: Durga Puja 2023 Weather Update: মহালয়া-পুজোয় সম্ভাবনা নেই দুর্যোগের, বঙ্গবাসীর জন্য সুখবর দিল হাওয়া অফিস]
তবে ওই রাতেই মুখোপাধ্যায় পরিবারের কর্তা দেবীর স্বপ্নাদেশ পেলেন, “আমি এখানে থেকেই কাশী বাস করব। আমাকে এখান থেকে সরানোর চেষ্টা যেন না করা হয়।” মুখোপাধ্যায় পরিবারের কর্তা ওই স্বপ্ন পাওয়ার পর আর মাকে সরানোর চেষ্টা করা হয়নি। মায়ের ওই প্রতিমাতেই বছর বছর ধরে পুজো হয়ে আসছে। কিন্তু মাটির তৈরি মূর্তি ২৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কিভাবে অক্ষত রয়েছে তা জানা নেই মায়ের সেবাইত থেকে ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যদের। এ যে অলৌকিক ঘটনা তা জানে এই প্রাচীন শহর। ফলে এই পুজোর মাহাত্ম্যই আলাদা।
এই শহরের সকল মানুষ জানেন, পুরাতন দুর্গা বাটির মা উমাকে ঘিরে এমন ইতিহাস। ওই পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, পুজোর সময় কেবল নতুন গয়না ও শাড়িতেই সেজে ওঠেন দেবী। ৫-৬ বছর পর মূর্তিতে শুধু রঙের প্রলেপ পড়ে এই যা।বর্তমানে ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সোনালি মুখোপাধ্যায় পুজো নিয়ে একটি কথাও বলতে চাননি। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই ওই ঠাকুরদালানে থাকা একটি বড় নোটিশ বোর্ডের দিকে আঙুল দেখিয়ে দেন। সেই বোর্ডেই এই পুজোর কিছুটা ইতিহাস রয়েছে। দেবী দুর্গা ওই মুখোপাধ্যায় পরিবারের কর্তাকে স্বপ্নে বলেছিলেন, তাকে যেন ছোলা-গুড় দিয়েই পূজো দেওয়া হয়। ফলে পুজোতে ছোলা-গুড় থাকবেই।
মায়ের বর্তমান সেবাইত রীনা পাল বলেন, “হুগলির জনাই রোডের এই পুজো বারাণসীতে যখন ১৭৬৭ সালে প্রথম শুরু হয়। সেই বছর দশমীতে মাকে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু এক ইঞ্চিও সরানো যায়নি এই মাতৃপ্রতিমা। মা স্বপ্নে জানিয়েছিলেন, তিনি কাশীতেই থাকতে চান। এরপর থেকেই চিরস্থায়ী হয়েছে মায়ের কাশীবাস। মায়ের নির্দেশ মতো ছোলা-গুড় দিয়ে পুজো করা হয়।” বাংলার বনেদি বাড়ির পুজোর মতোই মুখোপাধ্যায় পরিবারের আত্মীয়রা পুজোর সময় দুর্গা বাটিতে পা রেখে উৎসবে মাতেন। হয় নানান অনুষ্ঠান। কাশীর এই ঠাকুরদালানে মহাষষ্ঠী থেকেই ভিড় উপচে পড়ে। মা দুর্গার পাশেই রয়েছে বিষ্ণুর কালো পাথরের মূর্তি। যা এক হাজার বছরের প্রাচীন। ২৫০ বছরের বেশি মাটির এই দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে বিষ্ণুর ওই মূর্তি দেখতেও বারাণসীর দুর্গাবাটিতে পর্যটকদের ভিড় জমে রোজ।
দেখুন ভিডিও: