দুলাল দে: কোনও প্রতিযোগিতায় টানা ৬ ম্যাচে হারছে ইস্টবেঙ্গল(East Bengal)! আট থেকে আশি, লাল-হলুদ সমর্থকদের কাছে কল্পনার অতীত। শুধু সমর্থকদের কথা বলি কেন, লাল-হলুদ জার্সিতে খেলে যাওয়া প্রাক্তন ফুটবলাররা ভাবতেই পারছেন না, একটা সময় যে দলের বিরুদ্ধে খেলার আগে প্রতিপক্ষ ফুটবলাররা দশবার ভাবতেন। সেই টিমকেই আজ যে কেউ আসছে আর হারিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে! এরকমই একজন লাল-হলুদের ঘরের ছেলে প্রাক্তন ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া। যিনি শুধু ইস্টবেঙ্গলের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতাই নন, লাল-হলুদের বহু সাফল্যের অংশীদার। সিকিমের বাড়ি থেকে ইস্টবেঙ্গলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স নিয়ে কথা বলার সময় তাঁর গলায় ঝড়ে পড়ছিল একরাশ কষ্ট।
প্রশ্ন: আপনাদের সময় অবশ্য আইএসএল ছিল না। আই লিগ বা অন্য কোনও প্রতিযোগিতায় ইস্টবেঙ্গল টানা ৬ ম্যাচে হারছে, কোনওদিন শুনেছেন না দেখেছেন?
বাইচুং: কী বলছেন? আমাদের সময়ে ইস্টবেঙ্গলকে টানা ৬ ম্যাচে হারাবে- এরকম দুঃসাহস কোনও দল স্বপ্নে দেখার সুযোগ পেয়েছে? খুব খারাপ সময়ও যখন চলছে, তখনও হয়তো সবচেয়ে বেশি দু’ম্যাচে হেরেছি। টানা ৬ ম্যাচে হার অবিশ্বাস্য! ভাবতেই পারছি না আমি।
প্রশ্ন: আপনি যদিও দলের সঙ্গে যুক্ত নন, তবুও আপনার নাম যেহেতু বাইচুং ভুটিয়া, ইস্টবেঙ্গলের এই ব্যর্থতা নিয়ে আপনার থেকে আর ভালো কে ব্যাখ্যা দিতে পারবে?
বাইচুং: দেখুন, দলের সঙ্গে জড়িত না থাকলে ড্রেসিংরুমে কোনও সমস্যা আছে কি না, বলা সম্ভব নয়। যেমন আমি জানি না, দলের কোনও ফুটবলারকে চোট থাকা অবস্থাতেও কোচ খেলাতে বাধ্য হচ্ছেন কি না। এই তথ্যগুলি দলের সঙ্গে জড়িত না থাকলে বোঝা সম্ভব নয়। তবে দূর থেকে ম্যাচ দেখে একজন প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে ইস্টবেঙ্গলের খেলার টেকনিক্যাল অ্যানালিসিস তো করতেই পারি।
প্রশ্ন: সেটাই বলুন।
বাইচুং: আমার সবচেয়ে অবাক লাগছে ডিফেন্সিভ অর্গানাইজেশন দেখে। একটা দল কতটা অর্গানাইজড, প্র্যাকটিসে কতটা ট্যাকটিক্সের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, তা ম্যাচে বুঝতে পারবেন ডিফেন্সিভ অর্গানাইজেশন দেখে। ফরোয়ার্ড বা মিডফিল্ড অনেক সময় নানা পরিকল্পনা, ট্যাকটিক্স নিয়ে খেলা শুরু করলেও, পরিস্থিতি অনুযায়ী বদলে যায়। আক্রমণের অনেক ফুটবলার, ব্যক্তিগত স্কিল দিয়ে ম্যাচের পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। কিন্তু একটা দলের ডিফেন্সিভ অর্গানাইজেশনে বদল আসে না। ইস্টবেঙ্গলের এই ডিফেন্সিভ সিস্টেম দেখে আমি স্তম্ভিত। ডিফেন্সের কোনও শেপ নেই। কেউ কাউকে ব্যালান্স করছে না। আইএসএলের মতো খেলায় এরকম বাচ্চাদের মতো ডিফেন্সিভ সিস্টেম ভাবা যায় না। কার্লেস কুয়াদ্রাত কি প্র্যাকটিসে ডিফেন্সিভ অর্গানাইজেশন ঠিক করেননি?
প্রশ্ন: আর আক্রমণ?
বাইচুং: ডিফেন্সিভ অর্গানাইজেশন বলতে আমি শুধু ডিফেন্ডারদের কথা বলছি না। প্রতিপক্ষ যখন বল ধরছে, পুরো দলটা তখন ডিফেন্সিভ শেপে চলে যাবে। টিভিতে ওড়িশা এফসি ম্যাচটা দেখছিলাম। ইস্টবেঙ্গল মিডফিল্ডের ভিতর থেকে কীভাবে ওড়িশার ফুটবলাররা একের পর এক থ্রু বাড়াচ্ছিল। কীভাবে মিডফিল্ডের ডিফেন্সিভ অর্গানাইজেশন এত খারাপ? আধুনিক ফুটবলে প্রতিপক্ষ এতটা জায়গা কিছুতেই পাবে না। রয় কৃষ্ণা কীভাবে এত ফাঁকায় বল পেল?
প্রশ্ন: যে পারছে হারিয়ে দিচ্ছে। ইস্টবেঙ্গলকে কি তাহলে এখন আর ভারতীয় ফুটবলে বড় দল বলা যাবে না?
বাইচুং: ইস্টবেঙ্গল তার কৌলিন্য হারিয়ে ফেলেছে, এটা বলব না। ইস্টবেঙ্গলের এই দুর্দশা দেখে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। আমরা যখন খেলতাম, ভিনরাজ্যের দলগুলি আমাদের বিরুদ্ধে খেলতে এলে বিমানবন্দরে নামার পর থেকে পা কাঁপা শুরু করত। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলতে হবে, এই ভাবনা থেকে মাঠে নামার আগে ঘন ঘন বাথরুমে চলে যেত। কী হয়ে গেল ভাবতেই পারছি না! অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, লিগে কোনও দল ব্যর্থ হতে থাকলে অন্য দলগুলি তখন টার্গেট করে ফেলে। ফুটবলাররা আরও হতাশগ্রস্ত হয়ে ভুল করতে শুরু করে। এখনকার ইস্টবেঙ্গলের ঠিক সেটাই হয়েছে। সবাই এখন ভাবছে, ইস্টবেঙ্গল মানেই তিন পয়েন্ট নিশ্চিত। তবে এটা ঠিক এরকম হারে ইস্টবেঙ্গল নামক ব্র্যান্ডের একটা ক্ষতি তো হচ্ছেই। ক্লাবের স্পনসররাও এই ক্ষতি এড়াতে পারবেন না। সমর্থকদের জন্য সত্যিই খারাপ লাগছে।
প্রশ্ন: এই পরিস্থিতি থেকে তাহলে বার হওয়ার উপায়টা কী?
বাইচুং: দেখুন, এই পরিস্থিতির জন্য আমি কর্তাদের একটুও দায়ী করব না। এই মরশুমে ইস্টবেঙ্গল কর্তারা যে দল গঠন করেছেন, গত চার বছরে দেখা যায়নি। ইস্টবেঙ্গলের থেকে অনেক অনেক খারাপ দল লিগ টেবিলে উপরে রয়েছে। আমার শুধু মনে হচ্ছে, কুয়াদ্রাত প্রি-সিজনে এই দলটাকে নিয়ে করেছেনটা কী? মাঠের ভিতর খুব ইজি ‘শেপ’ পর্যন্ত দলটা বজায় রাখতে পারছে না।
প্রশ্ন: অস্কার ব্রুজো এই দলটাকে সমস্যার বাইরে নিয়ে যাবেন কী করে?
বাইচুং: দেখুন, শেষ পর্যন্ত ফুটবল খেলাটা অঙ্ক। তবে ইস্টবেঙ্গলে এখন ফুটবলারদের অঙ্ক শেখানোর আগে মানসিকভাবে তৈরি করতে হবে। যাতে ওরা অঙ্ক শেখার আগ্রহ ফিরে পায়। সঙ্গে ড্রেসিংরুমটা তৈরি করতে হবে। মানে, ফুটবলারদের আগে মানসিকভাবে জেতার ক্ষিদেটা তৈরি করতে হবে। তারপর টেকনিক্যাল দিক মেরামত করতে হবে। একটা-দু’টো ম্যাচ জিতলেই আবার পুরনো জায়গায় চলে আসবে ইস্টবেঙ্গল। এত বড় ক্লাব। এত ঐতিহ্য, এক-দু’দিনে শেষ হয়ে যায় না।
প্রশ্ন: আপনাদের দলের সঙ্গে এখনকার দলের পার্থক্যটা ঠিক কোথায়?
বাইচুং: আবার বলছি, আমি এই দলটার ড্রেসিংরুমে কোনওদিন ঢুকিনি। তাই দলের পরিবেশ সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। যা মন্তব্য করছি, সবটাই মাঠে দেখে। তাতে মনে হয়েছে, এই দলটায় একজনও নেতা নেই। সেই স্ট্রং ক্যারেক্টর নেই, যে ড্রেসিংরুমে বক্তব্য রাখলে পরিবেশ বদলে যেতে পারে। যে মাঠে দলের সামনে দাঁড়ালে দলের অন্য ফুটবলাররা তাঁর কথায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। পুরো দলটা কেমন জানি কেঁপে আছে। ইস্টবেঙ্গলের চরিত্রের সঙ্গে যা একেবারেই মানানসই নই। অন্তত আমরা যারা আগে ইস্টবেঙ্গল জার্সি পরেছি, তারা তো ভাবতেই পারছি না, এটা কোন ইস্টবেঙ্গল?