বোরিয়া মজুমদার: আইপিএলের নিলামে ‘মুম্বই ইন্ডিয়ান্স’ অর্জুন তেণ্ডুলকরকে (Arjun Tendulkar) কিনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সোশ্যাল মিডিয়ায় হইচই! আজকাল যা হয় আর কী, অর্জুনকে ট্রোল করা শুরু হল। কেউ কেউ তো অর্জুনকে স্বজনপোষণের ফলাফল হিসাবে চিহ্নিত করতেও দ্বিধা করল না।
সত্যি বলতে, অর্জুন এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কোনওভাবেই জড়িত নয়। হ্যাঁ, একথা ঠিক যে তাঁর পদবি ‘তেণ্ডুলকর’। কিন্তু এই বিষয়েও তাঁর কিছু করণীয় নেই। আর পাঁচজনের মতো তিনিও একজন সাধারণ পরিশ্রমী ক্রিকেটার, যিনি সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফি খেলে আইপিএল নিলামে নিজের নাম নথিভুক্ত করেছেন। কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজি যদি তাঁকে বেছে নিয়ে থাকে, তবে তা অর্জুনের সৌভাগ্য! কিন্তু আবারও বলছি, এই সিদ্ধান্তে তাঁর কোনও অবদান নেই। তাঁর দিকে আঙুল তোলার অর্থ মাহেলা জয়বর্ধনে, জাহির খান এবং রোহিত শর্মার (Rohit Sharma) মতো ক্রিকেটারদের অপমান করা, কারণ ‘মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে’র যাবতীয় ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত এঁরাই নিয়ে থাকেন। ব্র্যান্ড বিল্ডিংয়ের জন্যই যদি মুম্বই ইন্ডিয়ান্স তাঁকে দলে রাখতে চায়, তাহলে আমার মতে সেটা একটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। আইপিএল তো দিনের শেষে ব্যবসায়িক উদ্যোগ। সুযোগ পেলে তার সদ্ব্যবহার করার অধিকার প্রতিটি ব্র্যান্ডেরই আছে। শচীন ও অর্জুনকে একসঙ্গে হোর্ডিংয়ে রাখা একটি দুর্দান্ত প্রচারকৌশল, যা
যে কোনও ব্র্যান্ডকে এক অন্য মাত্রা দিতে পারে।
[আরও পড়ুন: কিশোর-বেদীর মতো প্রতিবাদী মানুষগুলি আজকের দুনিয়ায় কোথায় গেল?]
তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, অর্জুনকে চিরকাল ‘তেণ্ডুলকর’ পদবির বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। তাঁর কিংবদন্তি বাবার সঙ্গে তাঁর তুলনা অব্যাহত থাকবে, তাঁকে কাঠগড়ায় তোলা হবে স্বজনপোষণের সুবিধা নেওয়ার দায়ে। যে কলঙ্কলেপন খেলার শিকার তিনি হবেন, যে নেতিবাচকতা তাঁকে ঘিরে থাকবে– তা তাঁকে কখনওই নিজের ইচ্ছায় বাঁচার স্বাধীনতা দেবে না। তাই আমাদের এটুকুই চাহিদা, তাঁকে তাঁর মতো এগতে দেওয়া হোক, ব্যর্থতার স্বাদ পেতে দেওয়া হোক। আমাদের প্রত্যেকের মতোই অর্জুন তেন্ডুলকরেরও জীবনে ব্যর্থ হওয়ার অধিকার আছে। সে যা ভালবাসে, তা করতে চেয়েছে বলে তাঁকে আড়চোখে দেখা হবে? নিগ্রহ করা হবে তাঁকে? শচীন ও অঞ্জলির সন্তান হয়ে জন্ম নেওয়ার জন্য, তেণ্ডুলকর পরিবারে বেড়ে ওঠার জন্যতাঁকে মাশুল দিতে হবে: এটা মেনে নেওয়া যায় না!
‘তারকার সন্তান’ মানেই জীবন তাঁর কাছে গোলাপ বিছানো রাস্তা, এটা আদ্যন্ত ভুল ধারণা। অনেকে মনে করেন, তারকার ঘরে যারা জন্মায়, তাদের কাছে সবকিছুই সহজলভ্য। আর এই বোধ থেকেই এক ধরনের বৈরী-বোধ ও নৈরাশ্য জন্ম নেয়। ক্রিকেট মাঠে অর্জুন যা কিছু অর্জন করবেন নিজের কৃতিত্বে, তা হয়তো কখনও উপভোগ করার সুযোগই তিনি পাবেন না। সত্যি বলতে কী, তিনি যে রাস্তাতেই হাঁটুন, সমালোচনা আর সামাজিক নিন্দা তাঁর কপালে আছেই। ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনও পেশা যদি তিনি বেছে নিতেন, তাহলে লোকে বলত, ‘ও কোনও কাজের নয়। শচীন তেণ্ডুলকরের (Sachin Tendulkar) ছেলে হয়ে ক্রিকেট খেলল না!’ আর তাঁর পদবি তাঁকে ভোগাবে জেনেও তিনি যখন ক্রিকেট বেছে নিলেন, তখন কী করা হল?তাঁকে ট্রোল করা হল, নির্বিচারে আক্রমণ করা হল।
আমাদের প্রত্যেকের উচিত, অন্তত একবার নিজেকে তাঁর অবস্থানে রেখে বিবেচনা করা। ভাবুন তো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রশিক্ষণ করার পর যদি আপনাকে বলা হয়, ‘এই কঠোর পরিশ্রম আদৌ তোমার যোগ্যতার মানদণ্ড নয়। নেহাত তোমার বাবা শচীন তেন্ডুলকর, তাই তোমার এত রোয়াব’-তাহলে আপনার মনের অবস্থা কী হবে? অর্জুন এই মুহূর্তের সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার না হতেই পারেন, এমন হতেই পারে, তিনি হয়তো তাঁর কেরিয়ারে সামান্য সাফল্যই অর্জন করতে পারলেন, হয়তো কখনও ভারতের হয়ে খেলার সুযোগ তিনি পেলেন না, তাঁর বাবার রেকর্ডও তাঁর কাছে অধরা থাকল; কিন্তু তা’ বলে নিজের ইচ্ছায় ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে বাধা কোথায়?
আমাদের সামনে ‘স্যর’ ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের ছেলের উদাহরণ রয়েছে। ‘ব্র্যাডম্যান’ পদবির ভার বইতে না পেরে, জন তাঁর পদবি বদলে ব্রেডসন করে ফেলেন। যদিও তিনি এমন এক সময় ও পারিপার্শ্বিকের মধ্যে বড় হয়েছিলেন, যখন সোশ্যাল মিডিয়ার আস্ফালন ছিল না। বর্তমানে সময়ে যখন মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কীয় সচেতনতা বাড়ছে, আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত- এই অগুনতি ট্রোল অর্জুন তেণ্ডুলকরের মনে কী প্রভাব ফেলতে পারে? এর ফলে কি তিনি অসহায় বোধ করবেন, অবসাদ দানা বাঁধবে তাঁর মনে? নেতিবাচকতা এবং হতাশা সহ্য করতে না পেরে কি তাঁকে নিজের প্যাশন জলাঞ্জলি দিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করতে হবে?
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: ‘সাধারণ মানুষ হতচ্ছাড়া জীব’]
এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে শচীন তেন্ডুলকরের সঙ্গে আমার একটা কথোপকথন। শচীনকে যারা চেনেন, তাঁরা জানেন, তিনি সচরাচর রেগে যান না। আমাদের কথা চলতে চলতে যখন অর্জুনের কথা উঠেছিল, শচীন গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি ওকে ক্রিকেট খেলতে বলিনি। কিন্তু ওকে নিজের স্বপ্ন অনুসরণ না করে অন্য কিছু করতে বলার আমি কে? আগাম ব্যর্থতার কথা ভেবে ও কেন নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে পিছপা থাকবে? আমি যখন বড় হয়ে ক্রিকেট খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তখন আমার বাবা-মা কি আমাকে বাধা দিয়েছিলেন? তাঁরা কি কখনও আমাকে বলেছিলেন, নিজের পছন্দমতো না এগতে? আমার যা ইচ্ছা, তাই করার অনুমতি যদি আমি পেয়ে থাকি, তাহলে অর্জুনের জন্য নিয়ম আলাদা হবে কেন? ও আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো নিজের প্যাশনের কথা শুনেছে, যে খেলা ও ভালবাসে, সেই খেলাই বেছে নিয়েছে। এমনটাই তো হওয়া উচিত! হার-জিত, সাফল্য বা ব্যর্থতার সঙ্গে ক্রিকেটকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার কোনও যোগসূত্র নেই।’
দৃঢ় প্রত্যয় থেকে কথাগুলো বলছিলেন শচীন। কেবলমাত্র তাঁর ছেলে হওয়ার কারণে অর্জুনকে নিয়মিত ট্রোলড এবং উত্ত্যক্ত হতে হয়, এটা তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া সত্যিই কষ্টকর। অর্জুন ছাড়াও এই বছর আইপিএলে এমন অনেক নতুন খেলোয়াড় রয়েছেন, ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলি যাদের ২০ লক্ষ টাকা গড়-দাম দিয়ে টিমে নিয়েছে। তাহলে শুধুমাত্র অর্জুন তেন্ডুলকরকেই কেন ট্রোলের শিকার হতে হচ্ছে? অর্জুনকে লক্ষ্য করে কটাক্ষের তির ছোড়া এবং সেই নোংরা খেলায় শচীনকে টেনে আনা মারফত প্রত্যেকে যেন একটা তাৎক্ষণিক গৌরব অর্জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। নৈতিকভাবে তারা কতটা খাঁটি, তা প্রদর্শন করার চেষ্টায় মেতেছে সবাই। শচীন একা নন। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘সিডব্লিউজি’র জন্য পুলেল্লা গোপীচাঁদের মেয়ে গায়ত্রী যখন নির্বাচিত হন, তখন গোপীচাঁদের বিরুদ্ধেও স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছিল। অথচ নির্বাচনী বৈঠকে যখন গায়ত্রীর নাম ওঠে, গোপী কিন্তু তখনই নিজেকে আলোচনা থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।
চিকিত্সকের ছেলে-মেয়েরা কি চিকিৎসক হয় না? শিক্ষাবিদরা কি তাঁদের সন্তানদের শিক্ষক অথবা অধ্যাপক হওয়ার জন্য উত্সাহিত করেন না? ভারতে এমন অনেক সংগীতশিল্পী আছেন, যাদের বাবা-মা-ও সংগীত জগতে আছেন। তাহলে কেন তারকাদের সন্তানদের সঙ্গে এই ধরনের ভিন্ন ব্যবহার? কেন আমরা তাঁদের মর্যাদাহানি করাটাকে অধিকার হিসাবে দেখি? এ জাতীয় ট্রোল যারা করে, তারা নিঃসন্দেহে কাপুরুষ। নিজেদের পরিচয় প্রকাশ্যে আসবে না জেনে, পর্দার আড়ালে থেকে এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ করে চলে তারা। আবার এরাই শচীন সামনে এলে একটা ছবি তোলার জন্য মুখিয়ে থাকে। এরা আদতে ভণ্ড! প্রতিনিয়ত এরা দেশের সঙ্গে, মানবতার সঙ্গে অন্যায় করে চলেছে। এবং এ জন্যই এদের নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন রয়েছে। এদের মোকাবিলা করার একমাত্র পথ বিবেচনা ও যুক্তি দিয়ে বিরোধ করা। এদের মতামতের বিরোধী-ভাষ্য তৈরি করা, এবং নিজেদের বিশ্বাস তুলে ধরা। অর্জুন তেন্ডুলকরকে যারা আক্রমণ করছে, যদি তাদের মুখোশ খোলার প্রয়োজন হয়, তাহলে তা করতে পিছপা হলে চলবে না।