দিল্লিতে এয়ার পিউরিফায়ারের বিজ্ঞাপন অ্যালিগরিদমে সবার উপরে। গাছের পাতা ধুলোয় আচ্ছন্ন। দম নিতে কষ্ট, জিভ বিস্বাদ, কাশি। এত কিছুর পরেও দিল্লিতে বায়ুদূষণ যেন বাৎসরিক ইভেন্ট! লিখছেন স্যমন্তক ঘোষ।
বছর পাঁচেক আগে প্রথম যখন বাড়িভাড়া নিয়ে দিল্লিতে পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থা করলাম, সে-ও ছিল এক শীতকাল। ভোরের দিকে ঘুমের মধ্যেই কাশি শুরু হত। কাশতে-কাশতে গলা শুকিয়ে রক্ত এসেছে, এমনও হয়েছে বহুবার। কাশি নিশ্চয়ই তামাকজনিত, এই ধারণা যখন ক্রমশ বদ্ধমূল হচ্ছে, তখন জানতে পারলাম, জীবনে একবারও সিগারেটে ঠোঁট না-রাখা মানুষেরও একইভাবে ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যায়, একইভাবে কাশতে-কাশতে, এই দিল্লির শীতে।
দিল্লির এই শীতকালীন দূষণ বিষয়টা যে আসলে ঠিক কী, তা কলকাতা বা দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে দিল্লি বিমানবন্দরে নামলেই বোঝা যায়। বিমানের দরজা খোলার সঙ্গে-সঙ্গে আচমকা চোখ জ্বালা করতে শুরু করে। গলার কাছে কিছু একটা জমে গেল বলে মনে হয়। জিভের উপর বিস্বাদ আস্তরণ। জ্বর হলে যেমন হয়। প্রথম-প্রথম এই সবকিছুতেই বড় দুর্ভাবনা হত। ঝিম মেরে থাকত শরীর। নেবুলাইজ করতে হত বারবার। সময়-সময় পাফ। আর এই সবকিছু উপেক্ষা করে, ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’ (একিউআই) খুঁজে-খুঁজে বিভিন্ন এলাকায় যেতাম খবর করতে। ধুলোর চাদরে ঢেকে থাকা দিল্লি, সূর্য উঠেও নিস্তেজ, ফ্যাকাসে ইন্ডিয়া গেট, গাছভর্তি ধুলো– এসব ছবি ওই সময়ই নেওয়া। ওই পয়লা বছর; দিল্লিকে যখন নিজের শহর বানানোর চেষ্টা চলছে।
যত দূর মনে পড়ছে, সাংবাদিক হিসাবে সে-বছর দিল্লির দূষণ নিয়ে একটি সিরিজ করেছিলাম। কথা বলেছিলাম বিশেষজ্ঞ, নেতা-মন্ত্রী, পরিবেশবিদ– প্রত্যেকের সঙ্গে। এর ঠিক এক বছরের মাথায় শিখে নিলাম আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।দূষণ নিয়ে কিছু খবর শেল্ফে তুলে রাখতে হয়। ওই যেমন ফি-বছর দুর্গাপুজোয় কাগজে কাগজে ছাপা হয়– শুভ-অশুভর লড়াই! প্রতি সরস্বতী পুজোয় বের হয় বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস ডে, প্রতি বিসর্জনে গঙ্গা দূষণ। ঠিক তেমনই দিল্লির দূষণ একটি বাৎসরিক বিষয়। প্রতি বছর শেল্ফ থেকে পুরনো খবর নামিয়ে একটু ঝেড়ে-বেছে নতুন করে চালিয়ে দেওয়া। এই লেখা যখন লিখছি, ঘরের এয়ার পিউরিফায়ার বলছে একিউআই ৩০০-র উপর! সকাল-বিকেল কাশি হচ্ছে, চোখ জ্বালা করছে, দম নিতে অসুবিধা হচ্ছে, জিভের উপর আস্তরণ পড়ে আছে, গলার কাছে অস্বস্তি। কিন্তু প্রথম বছরের মতো ওই কষ্টটা আর হচ্ছে না। দিনের-পর-দিন চোখে কম দেখলে কম দেখাটাই যেমন অভ্যাস হয়ে যায়, ঠিক তেমন।
দূষণে কম দেখাটা অভ্যাস করে নিয়েছে দিল্লিবাসী। মেনে নিয়েছেও বলা যেতে পারে। প্রতি বছর এই
দূষণের মরশুম এলে সরকার কিছু নীতিমালা প্রস্তুত করে। কিছু দিন এ নিয়ে টেলিভিশনের প্রাইম টাইমে জমজমাট আলোচনা চলে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে দেয়, এর ফলে কী ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে শরীরের। কিছু দিন আগে তো দেখলাম, একটি খবরের কাগজ একিউআই-এর হিসাব করেছে সিগারেট সূচকে! দিল্লিতে দূষণের মাত্রা দিন প্রতি সংখ্যায় ৪০টি (কোনও কোনও সূত্র বলছে ৭৫টি) সিগারেট খাওয়ার সমান। ক্রিয়েটিভ। এমন অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত পোস্ট, মিম, রিল ঘুরে বেড়াচ্ছে সমাজমাধ্যম জুড়ে। এয়ার পিউরিফায়ারের বিজ্ঞাপন অ্যালিগরিদমে সবার উপরে। হাসপাতালের বিজ্ঞাপনে ফুসফুস, নেবুলাইজার। তারপরেও মুখে মাস্ক বেঁধে বা না-বেঁধে ডেলিভারি পার্টনার বাইক হঁাকিয়ে দিনরাত এক করে খাদ্য জুগিয়ে চলেছে মধ্যবিত্তের পার্টিতে। রাস্তার বাচ্চাগুলো একইভাবে গাড়ির কাচে টোকা দিয়ে ভিক্ষে চাইছে। নার্সারির সদ্য প্রস্ফুটিত পাতাগুলো একইভাবে ধুলোয় মাখামাখি। বাড়ির সহায়িকার নাকের উপর চাদর, অনর্গল কাশি। অফিসে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের আবদার। ‘দূষণ-ছুটি’ যাপনকালে স্কুলের বাচ্চাদের পার্কে ক্রিকেট। সবকিছুই চলছে আগের মতো। গয়ংগচ্ছ চালে।
আসলে সব একইরকম থাকে রাজধানীতে। বদলায় না কিছু। দিওয়ালির রাতে বাজি বন্ধ হয় না। যারা ফাটায়, তারাই কাশে, বাচ্চাকে নেবুলাইজ করাতে হাসপাতালে ছোটে রাতবিরেতে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে খেত জ্বলতেই থাকে। দিল্লির ধারে অবৈধ পাথর-ক্রাশার, আর-একটু দূরে কারখানার কালো ধোঁয়া, ডিজেল লরির স্মোক পাইপ– সবই নিজের নিজের মতো করে বেঁচে-বর্তে আছে। ধরে নেওয়া যাক, দিল্লির দূষণ আসলে বিশ্বের সামনে এক তৃতীয বিশ্বের বিজ্ঞাপন–যা বেচলে কর্পোরেট থেকে এনজিও, সরকার থেকে বিশেষজ্ঞ, প্রত্যেকেরই পকেট ভর্তি হয়। যেমন, এই লেখার বিনিময়ে অধমেরও কিছু অর্থপ্রাপ্তি হবে!
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
abir.peace@gmail.com