নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক রাশিয়া সফর নিয়ে ক্রুদ্ধ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তবে পুরনো জোট নিরপেক্ষতার স্মৃতি উসকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ভারতের এই অবস্থানে আমেরিকা ও ইউরোপের খুশি হওয়া উচিত। পাশাপাশি, রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার মাধ্যমে চিনা-ড্রাগনের শ্বাসও খানিক প্রতিহত করা সম্ভব ভারতের পক্ষে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
ছোটবেলায় সার্কাসে দেখতাম, একটি সুদীর্ঘ দড়ির উপর সাইকেলে চেপে হাতে লম্বা লোহার রড নিয়ে চলেছে দু’জন। আবার ওদের দু’জনের উপর এক পাটাতনে চেয়ার রেখে উপবিষ্ট তৃতীয় খেলোয়াড়। তার হাতেও একটি লাঠি। আনুভূমিকভাবে লাঠিগুলো রেখে তিনজনেই চলেছে দড়ির উপর দিয়ে। এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত। করতালিতে মুখরিত সার্কাসের ময়দান। একেই তো বলা হয় ‘ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট’।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এখন ঠিক এই কঠিন কাজটাই করতে হচ্ছে। হ্যাট্রিক করার পর নরেন্দ্র মোদির বিদেশনীতির নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে গিয়েছে। পঁাচ বছর পর তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করলেন। হাজারো ক্যামেরার সামনে পুতিন-মোদি আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন। মনে রাখতে হবে, গত মাসেই পুতিন উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে সে দেশের সর্বশক্তিমান প্রেসিডেন্ট কিম জং উন-কে জড়িয়ে ধরেন। সে আলিঙ্গন দেখে বেজিং খুশিতে ডগমগ ছিল। এবার মোদি-পুতিনের আলিঙ্গন দৃশ্য দেখে বেজিং উদ্বাহু নৃত্য করছে না। তবে বেজিংয়ের চেয়েও বেশি ভ্রুকুটি কুঞ্চিত আমেরিকার। বাইডেনের বিদেশ দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বললেন– ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্ব নিয়ে দিল্লির কাছে আমরা নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। রাশিয়ায় গিয়ে মোদি কী বক্তব্য রাখছেন, সেদিকে আমরা নজর রেখেছি।
ভারত-ইউক্রেন সম্পর্ক
নরেন্দ্র মোদি রাশিয়া যাওয়ার আগে অবশ্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও একপ্রস্থ বৈঠক সারেন। এবার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণের কিছু দিন পরেই মোদি ‘জি৭’ বৈঠক করতে গেলেন ইতালিতে। জি৭ ক্লাবে রাশিয়া নেই। আগে এটি ছিল জি৮। রাশিয়া এই ক্লাব থেকে বহিষ্কৃত হয় ২০১৪ সালে। ১৯৯৭-এ তারা এই রাজনৈতিক ফোরামে যুক্ত হয়। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের পর রাশিয়ার সদস্য পদ অনির্দিষ্টকালের জন্য খারিজ করে দেওয়া হয়। ’৯৭-এ রাশিয়া যুক্ত হওয়ার পর সেটি জি৭ থেকে জি৮ হয়, রাশিয়ার বহিষ্কারের পর জি৮ আবার জি৭ হয়ে যায়। রাশিয়ার অনুপস্থিতিতে ইতালিতে জি৭ বৈঠকে আলোচনা হল ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে। ইউক্রেনকেও সেখানে বিশেষ অামন্ত্রণ জানানো হয়। আবার ভারত জি৭-এ সদস্য না হলেও বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে মোদি গেলেন। ফোরামের বৈঠকের পাশাপাশি তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টজেলেনস্কির সঙ্গেও বৈঠক করলেন। মোদি-জেলেনস্কির আলিঙ্গনের ছবি ইতালি থেকে বহুল প্রচারিত হল। এরপর কূটনীতির ভারসাম্য রক্ষা করতে মোদি হাজির হলেন মস্কোয়। পুতিন-মোদি আলিঙ্গনে উষ্মায় ফেটে পড়লেন জেলেনস্কি। জেলেনস্কির মন্তব্য– বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নেতা একজন খুনি এবং অপরাধী নেতাকে আলিঙ্গন করছেন! বেশ কঠোর বিবৃতি সন্দেহ নেই।
মোদি-পুতিন নরম-গরম
মোদির এই মস্কো-সফর অত্যন্ত জরুরি ছিল পুতিনের কাছে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পরেও এ বিশ্বে পুতিন যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি, সেটার প্রমাণ দেওয়া ছিল বিশেষ জরুরি। তাই ইলেকট্রিক গাড়িতে পুতিন নিজেই মোদি ও আরও দু’জন প্রতিনিধিকে পিছনে বসিয়ে নিয়ে গেলেন তঁার বাসভবনে। এই ছবি সেদিনই ‘ভাইরাল’ হয়ে গেল দুনিয়ায়। রাশিয়া পৃথিবীকে দেখাল, ন্যাটো যতই বৈঠক ডাকুক, বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত আসলে আমাদের পাশে।
এ তো গেল পুতিনের প্রেক্ষিত! কিন্তু ভারত? মোদি কেন মস্কো গেলেন? ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রেম তো এখন ইতিহাস; নেহরু থেকে ইন্দিরা– ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ পর্বের ইতিহাস। তবে সত্যি কথা বলতে কী, এখনও কিন্তু রাজ কাপুরের ‘সর পে লাল টোপি’ গানের স্মৃতি অমলিন।
রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বিচার করলে ভারতের প্রয়োজন সস্তায় রুশ যুদ্ধাস্ত্র। আর দরকার তেল। আর তাই যতই আমেরিকার চাপ থাকুক, ভারত এই ভারসাম্য রক্ষার সার্কাসে যে সফল– তাই প্রমাণ করছে। এদিকে, রাশিয়ায় গিয়ে মোদি আবার প্রকাশে্য যুদ্ধবিরোধী বক্তব্যও রেখেছেন।
২০২১ সালে দিল্লিতে মোদি-পুতিন বৈঠক হয়। এরপরই ২০২২ সালে শুরু হয়ে যায় ইউক্রেন যুদ্ধ। আমেরিকা ও ইউরোপ ভারতকে প্রকাশ্য রাশিয়া-বিরোধী অবস্থান নিতে চাপ দেয়। ন্যাটোর শক্তি ইউক্রেনের পাশে। ২০০০ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী রাশিয়ার সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ স্বাক্ষর করেন। ২০২৪-এ ৮-৯ জুলাই মস্কো সফরেও ভারতের হয়ে মোদিও সেই ট্র্যাডিশন বজায় রাখলেন। কাজটা মোটেই সহজ নয়। আবার মস্কো গিয়ে মোদি পুতিনকে একান্তে যা বলেছেন, তা প্রকাশে্যও বলেন– নিরপরাধ শিশুর মৃতু্য হৃদয়বিদারক। তাই যুদ্ধের ময়দানে কোনও সংকটের সমাধান খেঁাজা যায় না। মস্কোয় নৈশভোজের পর তিনি আরও বলেন– শান্তি ফেরানো প্রসঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বক্তব্য শুনে তিনি আশাবাদী। তঁার সাধু উদে্যাগে ভারত সমস্তরকম সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।
রাশিয়া শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির পথে যাবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত।তবে মোদি পুরনো জোট নিরপেক্ষতার স্মৃতি উসকে দিয়েও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাতে আমেরিকা ও ইউরোপের তো খুশি-ই হওয়া উচিত।
‘আঙ্কল স্যাম’ কী চাইছে
মোদি মস্কো গেলেন আর ১০ জুলাই বুধবার ন্যাটোর ‘ওয়াশিংটন সামিট’ হয়ে গেল। সেই সম্মেলনে ইউক্রেনকে আরও সহযোগিতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভারের প্রস্তুতি। যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে ন্যাটো কেন ভাবতে যাবে? ভারত ন্যাটোর সদস্য হয়নি, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক-ছেদেরও কোনও প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু মোদি আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক অপরিবর্তিত রাখতে চান। আমেরিকায় এখন ভোটের রাজনীতি সরগরম। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রার্থী হবেন না কি অন্য কেউ? না কি বারাক ওবামার স্ত্রী মিশেল? ট্রাম্পের পক্ষেই এখন হাওয়া– বলছে নানা নির্বাচনী সমীক্ষা। আর তাই মোদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কেও কিঞ্চিৎ ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে এগচ্ছেন। আবার, চিনের সাম্প্রতিক আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণবাদী নীতির মোকাবিলায় ভারতের প্রয়োজন আমেরিকাকে। আমেরিকা-চিনের দ্বৈরথে ভারত-মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক সহযোগিতা খুবই প্রাসঙ্গিক।
ভারত-চিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
‘এসসিও’-র ২৪তম বার্ষিক সম্মেলনটি হয়ে গেল কাজাখস্তানে, ৩ ও ৪ জুলাই। ‘এসসিও’ অর্থাৎ, ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’। চিন হল এই সংস্থার বড়দাদা। রাশিয়া, চিন ছাড়া এই সংগঠনের রাষ্ট্রপ্রধানদেরই আসার কথা। চিন, রাশিয়া এমনকী পাক প্রধানমন্ত্রী সেই সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও নরেন্দ্র মোদি কিন্তু গেলেন না। পাঠালেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করকে। এটি বহুপাক্ষিক মঞ্চ, দ্বিপাক্ষিক নয়। পাকিস্তান অনেক দিন থেকেই আশা করে বসে, সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এলে পাক প্রধানমন্ত্রী তঁার সঙ্গে একবার কথা বলবেন। এই মঞ্চে যেহেতু চিনের অাধিপত্য, তাই আমেরিকা এ সংস্থাকে কোনওভাবেই গুরুত্ব দিতে নারাজ। ‘জি২০’ সম্মেলনের আগে দিল্লিতে এসসিও বৈঠকে হোতা ছিল ভারত। সেবারও মোদি জি২০ সম্মেলনকে গুরুত্ব দিলেও এসসিও বৈঠকটি সারেন ভার্চুয়াল মাধ্যমে।
আসলে মোদি চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ধীরে ধীরে শান্তি প্রক্রিয়ায় যেতে আগ্রহী। এ নিয়ে এখনও তাড়াহুড়ো
করতে চাইছে না।
লন্ডন ও প্যারিসের কাহিনি
লন্ডনে কনসারভেটিভ পার্টি চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। আর্থিক হাল শোচনীয়। আবার লেবার পার্টিও পুরনো রাস্তা বদলে অভিবাসনের প্রশ্নটিকে কনসারভেটিভ পার্টির মতোই গুরুত্ব দেয়। লেবার পার্টি সেখানে সংসদে ‘চারশো পার’ করে এক সাংঘাতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ঋষি সুনকের বিদায়ের পর ভারতের আশা– নতুন উদ্যমে ব্রিটেন এখন ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে যাবে। লেবার পার্টি অতীতের কাশ্মীর নিয়ে মোদি সরকারের নীতির বিরোধিতা করে। ৩৭০ ধারা উচ্ছেদ নিয়েও তাদের দলীয় অবস্থান ছিল মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু এবার ভোটের আগে ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয় ভোটারদের কথা ভেবেই সম্ভবত লেবার পার্টি অবস্থান বদলে জানায় যে, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
এদিকে, ফ্রান্সে বামপন্থীরা বিপুল ভাল ফললাভ করেছে। ভারত মনে করে, ইউরোপের সার্বিক অবস্থান থেকে
ফ্রান্সও তাদের নীতিতে বদল আনবে না। ভারতের সঙ্গে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা সম্পর্কও অটুট থাকবে।
চিনা ড্রাগন
এবার ভোটের আগেই মোদি বিদেশি এক সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, ভারত চিনের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। আসলে আমেরিকার ভৌগোলিক দূরত্ব ভারত থেকে অনেকটা। কিন্তু চিন ভারতের প্রতিবেশী। তাই আমেরিকা চিনের সঙ্গে যতই সংঘাতের হুমকি দিক, আসলে ভারত মনে করে চিনের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনার রাস্তাতেই যেতে হবে। চিন যতই আক্রমণাত্মক কৌশল নিক, চিনেও আর্থিক মূল্যবৃদ্ধি-মুদ্রাস্ফীতি তীব্র। এ অবস্থায় দু’দেশের মধে্য আলোচনাই একমাত্র পথ, যুদ্ধ কখনওই নয়। চিন, পাকিস্তান ও রাশিয়া একটি অক্ষ তৈরি করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারত বন্ধুত্ব রক্ষা করে চিনা ড্রাগনের শ্বাসকেও প্রতিহত করছে।
পাকিস্তানের অবস্থা শোচনীয়। তবে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তানে ফেরার পর বর্তমান শরিফ সরকারের সঙ্গেও ধীরে ধীরে আলাপ-আলোচনার আবহ তৈরি হচ্ছে। দু’-দেশের হাই কমিশন অফিস আবার চালু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জাতীয় নিরপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে আবার তঁার পূর্বতন পদে মনোনীত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পাক সেনার সঙ্গে অজিত ডোভাল ‘ট্র্যাক-টু’ কূটনীতি সক্রিয়।
ভারতের অভিন্ন বিদেশনীতি
তাই, আবারও বলছি, নরেন্দ্র মোদির কাজটা সহজ নয়। তবু দক্ষতার সঙ্গে তিনি ভারসামে্যর কূটনীতি করছেন। মোদি মস্কো গিয়ে নিজেই বলেছেন, মাথায় লাল টুপি রুশি হলেও ‘দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’। ভারতের সর্বভৌম স্বার্থ নিয়েই মোদি এগচ্ছেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় একদা আমাকে বলেছিলেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা দলের যতই ঝগড়া হোক, বিদেশনীতি হওয়া উচিত দেশের সার্বিক হিতের কথা মাথায় রেখে। ঐকমতে্যর ভিত্তিতে এক অভিন্ন নীতি।
মোদির এই প্রয়াস তাই প্রশংসনীয়। এই বিদেশনীতিকে বিজেপি-তৃণমূল, কংগ্রেস-সিপিএমের প্রিজমে নয়, দেশের স্বার্থের নিরিখে দেখা প্রয়োজন।