এ কথা বলেছিলেন আসরানিজি। ওঁর মতে, হিরোরা যদি ইন্ডাস্ট্রিকে কঁাধে তুলে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন, তাহলে ক্যারেকটার আর্টিস্টরাও কাজ পাবেন। যে-মানুষটি অন স্ক্রিন সবাইকে হাস্যরসে ভাসিয়ে নিয়ে যেতেন, তিনি কিন্তু আসলে ছিলেন সিরিয়াস প্রকৃতির। স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু।
জগদ্ধাত্রী পুজোর আলোকসজ্জার খ্যাতি তো সর্বত্র। বছর দশেক আগে, ২০১৫-’১৬ হবে, এমনই এক জগদ্ধাত্রী পুজোর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অামার জীবনে এসে পড়েছিল আশ্চর্য এক বর্ণালি– বিশিষ্ট অভিনেতা আসরানিজির সঙ্গে সেদিন প্রথম আলাপ হয়। কবির ভাষায় বলতে গেলে– জুড়িয়ে গেল চোখ আমার, পুড়ে গেল চোখ।
শুনেছিলাম, উনি আসবেন। তাই অপেক্ষা করছিলাম– আমার অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পরেও। এলেন এক সময়। খুব লম্বা নন, কিন্তু সুঠাম চেহারা। সিরিয়াস ও কম্পোজড। অথচ ব্যবহারে বাহুল্য নেই। অহং নেই। কে বলবে, ইনি ‘শোলে’-র সেই কিংবদন্তি ‘আংরেজ কি জমানা’-র ‘জেলার’! স্ক্রিনে যেটুকু যখন ছিলেন, বোমার মতো ফেটে পড়েছিলেন। ‘অভিমান’ (১৯৭৩) সিনেমায় করা আসরানিজির রোলটিও আমার ভারি প্রিয়। ওরকম ধঁাচের একটি বাংলা সিনেমা করার চেষ্টা হয়েছিল। তবে রিলিজ হয়নি। সেই মুক্তি না পাওয়া ছবিতে অমন ধঁাচার চরিত্রটি আমি করেছিলাম। বেরল না ছবিটি, সে আপেক্ষ যাওয়ার নয়।
যাই হোক, আলাপ হল। প্রশিক্ষিত অভিনেতা তো বটেনই, মানুষটিও সুভদ্র। জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, ‘কী করেন?’ বললাম, ‘ছোটমোটো চরিত্রে অভিনয় করার চেষ্টা করি।’ এর উত্তরে সহাস্যে বলেছিলেন, ‘তব্ তো বড়া কাম করতে হো।’ মুহূর্তে পরিবেশটি সহজ হয়ে গেল।
এরপরে আসরানিজির সঙ্গে আমার দেখা মালদার চঁাচোলে। দিনে অনুষ্ঠান ছিল। শুনলাম, আসরানিজিও আসবেন। এই অনুষ্ঠান করাতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আর. জে. প্রবীণ। আমার আগে হয়ে গেল। মঞ্চ থেকে নেমে এসে দেখলাম, আসরানিজি এসেছেন। কনসেনট্রেট করছেন। একটু গম্ভীর। তারপর মঞ্চে গেলেন। অনবদ্য পারফরম্যান্স। আমি দেখছিলাম বসে-বসে। হঠাৎ উদ্যোক্তাদের একজন আমাকে একটি অনুরোধ করলেন– যদি একই গাড়িতে অাসরানিজি ও আমি মালদা ফিরে যাই– ঘণ্টাখানেকের পথ– আমার অসুবিধা হবে কী? অসুবিধা? আমার? ওঁর সঙ্গে যেতে? ছি ছি! কাজেই এ-প্রস্তাবে ‘না’ বলার প্রশ্ন নেই। এত বড় একজন শিল্পীর সঙ্গে একত্রে যাওয়া মানে তো অভিজ্ঞতা।
সেই যাত্রাপথ আমার জীবনে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। কত কিছু নিয়ে যে কথা হয়েছিল! কথায় কথায় বলেছিলেন– ‘জানো, হতে পারি মারোয়ারি পরিবারের সন্তান, কিন্তু আসলে আমি বাঙালি। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গেই তো ওঠাবসা করেছি।’ তারপর একটি অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলেন– এখানকার, মানে, বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ‘হিরো’-দের কী খবর? আমি সবিনয়ে জানাই যে, হিরোরা প্রত্যেকেই ভালো আছেন। মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছেন। প্রত্যেকেই এস্টাবলিশড কম-বেশি। কিন্তু ততক্ষণে আমার মধ্যেও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। জানতে চাইলাম– ‘স্যর, এ প্রশ্ন কেন করলেন?’
উনি যা বলেছিলেন, তা কখনও ভুলব না। ভোলার নয়। আসরানিজি বলেন– “দেখো, হিরোরা যদি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ উচ্চতায় যেতে না পারেন, তাহলে আমাদের মতো ক্যারেকটার আর্টিস্টরা কমার্শিয়াল সিনেমা থেকে হারিয়ে যাবে। অমিতাভ বচ্চন বা ধর্মেন্দ্রর মতো ‘হিরো’ যদি তৈরি না হত, তাহলে আমাদের মতো আর্টিস্ট কী করত? এঁরা তো ইন্ডাস্ট্রিকে আপন কঁাধে নিয়ে চলেছেন। তবে না আমরা ‘রোল’ পেয়েছি!”
বাঙালিদের প্রতি ওঁর অসম্ভব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। সেদিন বলেছিলেন অকপটে– ‘বড়ে বড়ে আর্টিস্ট সব তো বঙ্গাল সে হ্যায়।’ উনি কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভক্ত– শুনে আপ্লুত ও অবাক দুই-ই হয়েছিলাম। ‘এত দিন অভিনয় করেছেন, কী করে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতেন?’ এ প্রশ্ন তো উঠবেই। তবে নিজেকে নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে পছন্দ করতেন না। ভাঙতেন না বেশি। যে-মানুষটি অন স্ক্রিনে লোকজনকে হাস্যরসে ভাসিয়ে নিয়ে যান, সেই মানুষটি একটু সিরিয়াস প্রকৃতির।
হয়তো আরও বেশি আড্ডা দেওয়ার অবকাশ হলে আরও একটু বেশি চিনতে পারতাম। তবে একঝলকে দেখেও তো কিছু কিছু চরিত্রলক্ষণ অনুভব করা যায়! পরে অবশ্য আরও অনেক তথ্য জেনেছি ওঁর সম্বন্ধে। শুভাশিসদা বলেছিলেন আমাকে। আসরানিজির সঙ্গে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে ওঁর। শুভাশিসদার মুখে শুনেছি– আসরানিজির মনে প্রচণ্ড দুঃখ ছিল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করতে পারেননি বলে! বাঙালি পরিচালক ও শিল্পীদের প্রতি ওঁর সম্মানবোধ যে কত প্রবল, তা বুঝতে পেরেছিলাম। আসলে, সত্যজিৎ রায়ের আলোকচ্ছটা তো এমনই! নানা পাটেকরের নাম সত্যজিৎ রায়ের খেরোর খাতায় ছিল। অভিনয় করা হয়ে ওঠেনি। এটুকু শুনে নানা বলেছিলেন, অস্কার না-পাওয়ার দুঃখ রইল না!
যাই হোক, যে-কথা হচ্ছিল। কত বিচিত্র ধরনের সিনেমায় যে আসরানিজি অভিনয় করেছেন, ভাবলে তাক লেগে যায়। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের সিনেমার শৈলীর সঙ্গে যে-মানুষটি একাকার হয়ে যাচ্ছেন, সেই মানুষটিই আদ্যন্ত কর্মাশিয়াল সিনেমায় হাই পিচে অভিনয় করছেন। এই যে ফ্লেক্সিবিলিটি, এক রোল থেকে অন্য রোলে চলাফেরা করার অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্য– এর থেকেই প্রমাণ হয়– অভিনেতা হিসাবে কত উচ্চস্তরে তঁার আসন ছিল পাতা। মৃত্যু অনিবার্য, অমোঘ। তাও মৃত্যু কিন্তু আসরানিজিকে সেই আসন থেকে সরাতে পারবে না। দীপাবলির আলোকঝরনার আবহে বিদায় নিলেন, তবে যতবার আমরা তঁার অভিনয় দেখব, ততবার আলোয় ভরে যাবে আমাদের অন্তর।
(মতামত নিজস্ব)
