বিশ্বজুড়ে এখন নতুন আতঙ্ক ‘ডিপফেক’। কেন্দ্রীয় স্তরে একে বাগে আনতে নানা নিষেধ-নিয়ম ধার্য করা হচ্ছে। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ কি যথেষ্ট?
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ বা ‘এআই’ এখন আর কল্পনা মাত্র নয়। এটি এখন বাস্তব এবং তা প্রায় সবার আয়ত্তে চলে এসেছে। এআই ঢুকে পড়েছে রাজনীতি, নির্বাচনী প্রচার এবং জনমত গঠনের পরিসরেও। বিহার বিধানসভা নির্বাচনের মুখে নির্বাচন কমিশন এআই-নির্ভর বা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ছবি, ভিডিও ও অডিও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর নির্দেশিকা জারি করেছে। কমিশনের বক্তব্য স্পষ্ট বক্তব্য, এই ধরনের ‘সিনথেটিক’ বা ‘ডিপফেক’ কনটেন্ট শুধু নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ন্যায্যতার ক্ষতি করে না, বরং গণতন্ত্রের ভিত্তিও নাড়া দেয়।
প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছরে প্রযুক্তির হাত ধরে এমন সব ভিডিও ও ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিকরা এমন কিছু বলছেন বা করছেন, যা বাস্তবে কখনও ঘটেনি। এই ‘ভুয়া’ চিত্রনাট্যই হয়ে উঠেছে ‘ডিপফেক’ রাজনীতির নতুন অস্ত্র। কমিশন বলেছে, এই ধরনের উপাদান ‘ইলেকটোরালি সেনসিটিভ মেসেজ’ ছড়িয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করছে, মিথ্যা প্রচার বাড়াচ্ছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে দুর্বল করছে। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকও ইন্টারনেটে এআইয়ের অপব্যবহার ঠেকাতে পদক্ষেপ করেছে। ২০২১ সালের তথ্যপ্রযুক্তি (মধ্যস্থ সংস্থা নির্দেশিকা ও ডিজিটাল মিডিয়া নৈতিকতা কোড) বিধিতে নতুন সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে– সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি বাধ্যতামূলকভাবে এআই-সৃষ্ট বা পরিবর্তিত কনটেন্টে দৃশ্যমান ‘ওয়াটারমার্ক’ বা লেবেল দিতে হবে। অন্যথায় তাদের ‘সেফ হারবার’ সুরক্ষা হারানোর আশঙ্কা থাকবে। অর্থাৎ, ভুয়া কনটেন্টের দায় কেবল ব্যবহারকারীর নয়, সংস্থার উপর বর্তাবে। কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই শীর্ষ এআই সংস্থাগুলির সঙ্গে আলোচনায় বসেছে এবং প্রযুক্তিগতভাবে মেটাডেটার সাহায্যে এআই কনটেন্ট শনাক্ত করার ব্যবস্থা সম্ভব বলেই দাবি করেছে।
এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৬২ শতাংশ বড় সংস্থা ইতিমধ্যেই অন্তত একটি এআই-ভিত্তিক আক্রমণের শিকার হয়েছে, যেখানে তাদের কোনও আধিকারিকের কণ্ঠস্বর বা মুখ নকল করে প্রতারণা করা হয়েছে। ভারতে এর প্রভাব আরও স্পষ্ট। চলচ্চিত্র-নির্মাতা করণ জোহর, অভিনেত্রী ঐশ্বর্য রাই বচ্চন এমনকী বহু জনপ্রিয় রাজনীতিকও আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন নিজেদের নাম, মুখ ও কণ্ঠের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রশ্ন একটাই– এই নিয়ন্ত্রণ কি যথেষ্ট? প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়ম তৈরি করা-ই শেষকথা নয়, সেটির বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
একই সঙ্গে শিল্প, ব্যঙ্গচিত্র বা সৃষ্টিশীলতার পরিসর যাতে সংকুচিত না হয়, সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, গণতান্ত্রিক সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও দায়িত্ব– দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল। এআইয়ের যুগে তথ্যের স্বচ্ছতা ও উৎস যাচাই নিশ্চিত করা এখন রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিত। তবে, কেবল উপ-আইন বা প্রশাসনিক নির্দেশের মাধ্যমে নয়, সংসদে আলোচনার মাধ্যমে এই নীতিগুলি গণতান্ত্রিক বৈধতা দেওয়া সমান জরুরি।
