shono
Advertisement

Breaking News

Imran Khan

মুজিব থেকে ইমরান, লজ্জাও লজ্জা পায়

দেশের ‘আইকন’ হয়ে থাকতে পারতেন ইমরান।
Published By: Subhodeep MullickPosted: 04:42 PM Dec 03, 2025Updated: 05:54 PM Dec 03, 2025

নিজের পরিণতির জন‌্য দায়ী ইমরান খানও। বিশ্বজয় করে তিনি দেশের ‘আইকন’ হয়ে উঠেছিলেন। যুবকদের হার্টথ্রব। ১৯৮৩-তে কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের বিশ্বজয়ে মুষড়ে পড়েছিল পাকিস্তান। ইমরান তাদের স্বস্তি দিয়েছিলেন। শক্তি দিয়েছিলেন। তাঁর রাজনীতিতে আসা ভুল সিদ্ধান্ত। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক

Advertisement

দু’টি দৃশ্য দেখে শিউরে উঠি। সপরিবার গণহত‌্যার ৪৯ বছর পরে, দেশের সৃষ্টিকর্তার মূর্তির মাথায় প্রস্রাব করছে তাঁরই দেশের নবীন এক নাগরিক! হাজার-হাজার মানুষ সেই দৃশ‌্য দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন অম্লানবদনে। যেন ওটাই প্রস্রাব করার জায়গা।

দ্বিতীয় দৃশ্য আরও মর্মান্তিক। নিজের দেশকে যিনি বিশ্ব দরবারে বিজয়ী করলেন, পৃথিবীর মানচিত্রে বিজয়শিঙা ফুঁকে চোখে চোখ রাখলেন, তাঁকে নিক্ষেপ করা হয়েছে অন্ধ কারাগারে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অকথ্য অত্যাচারের পর তিনি ‘জীবিত’ না ‘মৃত’– কেউ জানে না। দেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিভার করুণ পরিণতি দেখে সরকার, আইন-আদালত, সুশীল সমাজ চুপ। বতর্মান মনে রাখেনি অতীতের গৌরবকে। সময় মনে রাখেনি, তাঁদের অসামান‌্য কৃতিত্ব। নির্দয় রাষ্ট্রযন্ত্রে রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বলি সোনার সন্তান। লজ্জাও বুঝি লজ্জা পায়!
বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ’-র নায়ক ‘বঙ্গবন্ধু’ মুজিবুর রহমান থেকে পাকিস্তানের বিধ্বসী ফাস্টবোলার বিশ্বকাপ ক্রিকেটজয়ী অধিনায়ক ইমরান খান (Imran Khan)– এই উপমহাদেশে দুই অসম সাহসী ও শক্তিধর মানুষের এই পরিণতির দেখে হতবাক হয়ে যেতে হয়।
১৯৭৫ থেকে ২০২৫– কেটে গিয়েছে

৫০ বছর। এই সময় ভারতে নানা ক্ষেত্রে অসংখ্য চরিত্রকে খুঁজে পাওয়া যাবে, যাঁরা হয় বিশ্বজয় করেছেন, নয়তো বিশ্বের দরবারে এই সুমহান দেশকে বন্দিত করেছেন। সেই তুলনায় পড়শি বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান অনেকটাই পিছিয়ে। তাদের বলার মতো তেমন কিছু নেই। জন্ম থেকে অস্থিরতা, মৌলবাদকে প্রশ্রয়, জঙ্গিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার জেরে দেশ দু’টির বুনিয়াদ নষ্ট হয়েছে তিলে তিলে। ভারত-বিরোধিতা মূলমন্ত্র করে তারা ডুবেছে স্বখাত সলিলে। প্রতিভার অন্বেষণ হয়নি, গুণী মর্যাদা পায়নি, বিকাশ হয়নি নবপ্রজন্মের। ফলে, দুই দেশে প্রকৃত ‘মহানায়ক’ মাত্র এই দু’জন। একজন মুজিবুর রহমান, যিনি দেশ স্বাধীন করেছিলেন। পাক-হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়জন ইমরান খান। যিনি ক্রিকেট মাঠে ভূমিকম্প ঘটিয়ে পাকিস্তানকে বিশ্বজয়ী করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর মুজিবকে দেখতে

কোটি কোটি মানুষ পথে নেমেছিলেন। আর, লাল গোলাপ পথে বিছিয়ে দেশে বরণ করা হয়েছিল ইমরানকে। তবে সেই ‘গরিমা’ অবশ‌্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দু’জনেই আপন দেশে অমর্যাদার শিকার। মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রায় সব শহরে মুজিবের মূর্তি ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। তঁার নামাঙ্কিত রাস্তা, কলেজ, হাসপাতালের পরিচয় পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে, গেরস্থবাড়িতে রাখা ‘বঙ্গবন্ধু’-র ছবিও সরিয়ে ফেলতে হয়েছে– পাছে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যায়!

মুজিবুর রহমানের এই পরিণতির জন‌্য অবশ‌্য তাঁর কন‌্যা ও দল দায়ী। যিনি ‘জাতির পিতা’ রূপে স্বীকৃত, তাঁকে রাজনীতির তাস করে হাসিনা ও তাঁর দল ভোটে লড়াই করতেন। রাজনৈতিক প্রচারে ব‌্যানারে-ফেস্টুনে মুজিবুরের ছবি লাগিয়ে ভোট চাইত আওয়ামী লীগ। ফলে যেদিন উল্টোরথ শুরু হল, হাসিনা পালিয়ে গেলেন, কর্মীদের বাঘের মুখে ফেলে তাঁর মন্ত্রীবর্গও গা ঢাকা দিলেন, এবং তখন সব রাগ গিয়ে পড়ল ‘বঙ্গবন্ধু’-র নানা মূর্তি ও সৌধের উপর। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল ‘জাতির পিতা’-কে। মূর্তির মাথায় পড়ল প্রস্রাবধারা। সেদিনের সেই কাণ্ডকে ‘হুলিগানিজম’ অথবা ‘রাজাকারের অনাচার’ বলে লঘু করার চেষ্টা ধোপে টেকে না। আওয়ামী আমলে যাঁরা অত‌্যাচারিত হয়েছেন, চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন, ভোট লুঠ হতে দেখেছেন, তাঁরা যখন বদলার সুযোগ পেলেন– সামনে পড়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু’-র মূর্তিগুলিই। নেতারা তো প্রাণভয়ে পালিয়েছেন। ফলে রোষ সেদিকে গেল। যা হয়েছে– তার জন‌্য দায়ী জাতির পিতাকে ব‌্যবহার করার করুণ রাজনীতি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কুকর্মের ফল।

একইভাবে নিজের পরিণতির জন‌্য দায়ী ইমরান খানও। বিশ্বজয় করে তিনি দেশের ‘আইকন’ হয়ে উঠেছিলেন। যুবকদের হার্টথ্রব। ১৯৮৩-তে কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের বিশ্বজয়ে মুষড়ে পড়েছিল পাকিস্তান। ইমরান তাদের স্বস্তি দিয়েছিলেন। শক্তি দিয়েছিলেন। তাঁর রাজনীতিতে আসা ভুল সিদ্ধান্ত। ভেবেছিলেন, বাইশ গজের জনপ্রিয়তা রাজনীতির মাঠেও ফসল তুলবে। ক্রিকেট ভাঙিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার লোভ হয়তো তাঁকে পেয়ে বসেছিল। তাই নতুন দল গড়ে নামলেন। আশ্চর্য হলেও এটাই যে– সত্যি মানুষটাকে পাকিস্তানিরা এতটাই শক্তিশালী মনে করত যে, একদিন প্রধানমন্ত্রীও বানিয়ে দিল। কিন্তু এই পিচে বলে সুইং একটু যে বেশি! পাকিস্তানের মতো একটি অস্থির দেশ চালানো, অার ইংল‌্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ ফাইনালে নেতৃত্ব দেওয়া এক নয়। অচিরেই ‘ভিলেন’ হয়ে গেলেন ইমরান।

ক্ষমতা হারানোর পর জেলযাত্রা। প্রাসঙ্গিকতা এখন এমনই হারিয়েছেন যে, তিনি বেঁচে আছেন না কি মরে গিয়েছেন, তা নিয়ে পাকিস্তানের মানুষের কোনও হেলদোল নেই। কাঁদছে শুধু পরিবার। অকপটে বলতে পারি, ইমরান খানের আমিও একসময় ‘ফ‌্যান’ ছিলাম। টিনএজে ইমরানকে দুশমন মনে করতাম ঠিকই। কিন্তু আশ্চর্য এক সম্ভ্রম ঝরে পড়ত। পাকিস্তানি হলেও তাকে ঘৃণা করা যেত না। যেমন, বোলিং রান-আপ, তেমন তার গতি। ততোধিক নজরকাড়া ইমরানের অধিনায়কোচিত চোখ, শক্ত চোয়াল। মর্দ হো তো অ‌্যায়সা। মাঠে ‘হিম‌্যান’ হয়ে ওঠা সহজ কাজ নয়। প্রতিভা এমনই এক চুম্বক, যা দেশ-কালের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাঁর আকর্ষণ বিশ্বজনীন। অার সেজন‌্যই তো আমরা বিজাতীয় পেলে, মারাদোনা, মেসি, রোনাল্ডোর ফ‌্যান। তাঁদের জয়ে হাসি, পরাজয়ে চোখে জল। ইমরান ছিলেন তেমনই এক মানুষ।

১৯৯২ বিশ্বকাপে ভারতের বিদায়ের পরে পাকিস্তানের জন‌্য বিশ্বজয়ের দরজা খুলে যায়। তারা কিন্তু শুরু থেকে একদমই ভাল খেলতে পারছিল না। গ্রুপ লিগে ভারতের কাছে হেরেও যায়। কিন্তু নানা সমীকরণে শেষমেশ সেমিফাইনালে উঠে পাকিস্তান, এবং আর পিছন ফিরে তাকায়নি। পর-পর দু’টি ম‌্যাচ জিতে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে টিমকে চ‌্যাম্পিয়ন করেন ইমরান। সেদিন বিশ্ব দেখেছিল ‘নেতৃত্ব’ কাকে বলে। ব্রিটিশদের চোখে চোখ রেখে ম‌্যাচ হাতের মুঠোয় নেয় টিম ইমরান। ব‌্যস, ওই অবধি, তারপর ৩৩ বছর কেটে গিয়েছে, পাকিস্তান আর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে কিছুই করতে পারেনি!

কার্যত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া দু’টি দেশ যে ভাল নেই তা এই দু’টি ঘটনা প্রমাণ করে। খাদ‌্য-বস্ত্র, শিক্ষা-বেকারত্ব ইত‌্যাদি সমস‌্যাকে আড়াল করতে ক্রমাগত ভারত-বিরোধিতাকে পাথেয় করে দুই দেশে রাজনীতির পাশাখেলা হয়ে আসছে। বরাবর পাকিস্তানের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে জঙ্গিরা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারে পিছনেও রয়েছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের মদত। স্বাভাবিকভাবেই দু’টি দেশে ‘গণতন্ত্র’ বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের শেখ হাসিনা থাকার সময় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান হয়েছে। অনেককে জেলে ভরা হয়। হাসিনা ভারতপন্থী বলে বারবার তঁাকে খুনের চেষ্টা করা হয়। তিনি পালিয়ে যেতেই কারাগারের তালাচাবি খুলে জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। গটগট করে বেরিয়ে তারা জনসমুদ্রে মিশে যায়। অপরদিকে, পাকিস্তানে একের-পর-এক রাষ্ট্রপ্রধানদের মৃত্যু হয়েছে ফ্র‌্যাঙ্কেস্টাইনের দৈত্যর হাতেই। ১৯৫১ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীকে জনসভার মধ্যে গুলি করে মারা হয়। দু’বারের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকেও মিছিলে বোমা গুলি মেরে হত‌্যা করা হয়েছিল। তাঁর পিতা প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় একতরফা রায়ে। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়া-উল-হক রহস‌্যজনকভাবে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। প্রতিটি হত‌্যার নেপথ্যে জঙ্গিদের প্রত‌্যক্ষ যোগাযোগের খবর রয়েছে। এমন একটি দেশে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে জেলে পচিয়ে মারা হবে সেটাই স্বাভাবিক।

ভুল ইমরানের। কেন রাজনীতিতে এলেন? দেশের ‘আইকন’ হয়ে থাকতে পারতেন। অনেক সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতেন। অন্ধ কারাগার নয়, সিংহাসনে থাকতেন রাজার মতো। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, মুজিব-ইমরানদের বরাবরের বধ‌্যভূমি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • নিজের পরিণতির জন‌্য দায়ী ইমরান খানও।
  • তাঁর রাজনীতিতে আসা ভুল সিদ্ধান্ত।
  • ভেবেছিলেন, বাইশ গজের জনপ্রিয়তা রাজনীতির মাঠেও ফসল তুলবে।
Advertisement