রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথের জন্য জীবন বিমার পলিসি করিয়েছিলেন! সেই আমলে ৬৫০ টাকার প্রিমিয়াম মানে অনেকটা টাকা। কিন্তু পুত্রের আর্থিক সুরক্ষার দুশ্চিন্তা তাঁকে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। আদতে পিতা-পুত্রর আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গির তফাত বিরাট। আর, এই দ্বৈরথেই শিল্পী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন। আজ, বৃহস্পতিবার রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। লিখছেন মানস ভট্টাচার্য।
১ আশ্বিন, ১৩১৬ বঙ্গাব্দ (ইংরেজি ১৯০৯ সাল)। রবীন্দ্রনাথের তখন ৪৮। জমিদারি ও বিদ্যালয়ের কাজের চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও ব্যক্তিগত কাজের তাগিদে সেদিন তিনি জোড়াসঁাকোর ঠাকুরবাড়িতে রয়েছেন। সেদিনই ‘সিটি অফ গ্লাসগো লাইফ ইনসিওরেন্স’ কোম্পানি থেকে ৪০ হাজার টাকার লাইফ ইনসিওরেন্স পলিসি কেনেন। এই পলিসি তিনি করিয়েছিলেন তঁার জীবিত পুত্রসন্তান রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে। পলিসির মেয়াদ ছিল ১৫ বছরের, ৬৫০ টাকার প্রিমিয়াম দিতে হত তিন মাস সময় অন্তর।
রবীন্দ্রনাথের সেই সময়ের আর্থিক পরিস্থিতির নিরিখে এই টাকার পরিমাণটা যে তার পক্ষে অস্বাভাবিক বেশি ছিল, তা বলা বাহুল্য। তখনও নোবেল প্রাইজ পেতে বেশ কয়েক বছর বাকি। নিজের স্বপ্নের আশ্রম-বিদ্যালয় পরিচালনায় দেখা দিয়েছে নিদারুণ আর্থিক অনটন। এই সমস্ত ডামাডোলের মধ্যেও এত বিশাল অঙ্কের জীবন বিমার পলিসি কেনা– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কোথাও ভীষণ অপরিচিত বলে মনে হয়। তিনি কবি-সাহিত্যিক, জীবনের কঠিনতম দুঃখকে জয় করে সাহিত্য রচনা করবেন, গান বঁাধবেন– এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু পুত্রের আর্থিক সুরক্ষার দুশ্চিন্তা পিতা রবীন্দ্রনাথকেও যে বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দঁাড় করিয়ে দিয়েছিল– ভাবলে অবাক হতে হয়। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের মনেও দ্বন্দ্বের সৃষ্টির করেছিল। এই মানসিক টানাপোড়েনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে সেদিন দেখা গিয়েছিল সংশয়, তঁার পরিচয় পাই সেই সন্ধ্যাবেলায় লেখা আর সুর দেওয়া একটি গানে–
‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর...।’
যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর?
আর পারি নে রাত জাগতে, হে নাথ, ভাবতে অনিবার।
আছি রাত্রিদিবস ধরে দুয়ার আমার বন্ধ করে
আসতে যে চায় সন্দেহে তায় তাড়াই বারে বারে।
তাই তো কারো হয় না আসা আমার একা ঘরে।
আনন্দময় ভুবন তোমার বাইরে খেলা করে।
তুমিও বুঝি পথ নাহি পাও, এসে এসে ফিরিয়া যাও,
রাখতে যা চাই রয় না তাও, ধুলায় একাকার।
কবির মনে প্রশ্ন জেগেছে– যা হারিয়ে যায়, তা তিনি কতকাল আর আগলে বসে থাকবেন। এই প্রশ্ন এত তীব্র ও আন্তরিক যে, গাইতে গাইতে ‘আগলে বসে রইব কত আর’-এর ‘আর’-এ গিয়ে যখন পৌঁছলেন, তখন সুরের মতো কবিমনও যেন অস্থির হয়ে উঠল। যেন কিছু একটা ভীষণ অনভিপ্রেত জিনিস তঁাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে– নাড়া দিয়ে, ঝাড়া দিয়ে, তার থেকে মুক্তি নেওয়ার আকুল প্রয়াস করছেন তিনি!
কবিমন জানে, যা হারানোর তা হারাবেই, সেগুলো হারানোর জন্যই আমাদের কাছে আসে। আমাদের মায়ার মন সেটা মেনে নিতে পারে না। হারানোর ধনকে সে আগলে বসে থাকতে চায়। মন যখন এইরকম পাহারা দিতে ব্যস্ত, তখন অন্য কেউ কাছে ঘেঁষতে বাধা পায়। দুয়ার বন্ধ দেখে সবাই ফিরে যেতে যায়। ভিতরে কেউ প্রবেশ করতে গেলে তখন ‘সন্দেহে তায়’ তাড়িয়েও দিই।
অলক্ষ্য বেড়াজালে তখন একলা ঘরে বন্দি, আর জগৎও আপন নিয়মে বইতে থাকে। ঘরের বাইরে জগৎজুড়ে আনন্দলীলা। ‘আনন্দময় ভুবন তোমার বাইরে খেলা করে’– এই লাইনটুকু গেয়ে নিয়ে যখন ‘তুমিও বুঝি পথ নাহি পাও’ গাইতে যাওয়া হয়, তখন সুর আগের ‘খেলা করে’ অংশটা থেকে আনন্দে উদ্বাহু হয়। তা আনন্দ-নীড়ের চূড়া পেরিয়ে ভেঙে যায় ‘তুমিও বুঝি পথ নাহি পাও’-এ এসে। জীবনের পরম পাওয়ার ধন ঠিকানা সন্ধান করে একসময় যখন কাছে আসতে চায়, তখন দেখে দুয়ার বন্ধ। সে ধন ‘এসে-এসে ফিরিয়া’ যায়। অন্যদিকে, যে নশ্বরকে বুক দিয়ে আগলে রাখা হয়, একদিন তা বুকের আগল ঠেলে চলে যায়, ‘ধুলায় একাকার’ হয়ে যায়।
কোনও এক সজাগ মুহূর্তে মনে উপলব্ধি হয় যে, প্রিয়বস্তু যদি আপন নিয়মে হারিয়ে যাওয়ারই হয়, তাতে বাধ সাধি কেন? তাদের হারানোর ভয়ে আটঘাট বেঁধে নিজেই কেন ক্রমশ সমস্ত জগৎকে হারাতে বসি? কেন আঘাত বঁাচাতে গিয়ে সংবেদন হারাই? সজাগতার এই মুহূর্ত কখনও কখনও জীবনে আসে।
দিনটি ছিল শরতের। ছেলের আর্থিক নিরাপত্তার রক্ষার ভয়ে ভীত হয়ে তঁার নিশ্চয়ই খটকা লেগেছিল এই ব্যাপারটায় যে, সম্পর্কজাল নয়, টাকার উপর নির্ভর করছে তঁার ছেলের জীবনের সুরক্ষা। এই ভাবনাকে তঁার মনের কোনও এক সজাগ মুহূর্তে ভীরুতার মতো ঠেকেছিল। সেই ভীরুতার বর্ণনা করতে গিয়ে তঁাকে লিখতে হল– ‘আছি রাত্রিদিবস ধরে দুয়ার আমার বন্ধ করে’, ‘আসতে যে চায় সন্দেহে তায় তাড়াই বারে বার’, বা ‘তাই তো কারো হয় না আসা আমার একা ঘরে।’ মনের এই অবস্থায় প্রয়োজন ছিল একটি বিশ্বাসের অবলম্বন, তাই মৃত্যুজনিত শূন্যতার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ তঁার সন্তানের জন্য সন্ধান করে গিয়েছেন একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ের। সংসার জীবনের এই ভার আজীবন কবিকে বহন করে যেতে হয়েছে।
ঝগড়ু, জোড়াসঁাকোর ঠাকুরবাড়ির অনেক দিনের পুরনো চাকর, সেখানে তঁার প্রভাব-প্রতিপত্তিও বেশ ছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথকে খুবই ভালবাসতেন। বলতেন, (কবির) এই বুড়ো বয়সে কোথায় একটু আরাম করবেন তা না ‘বিশ্বভারতী’ না কি যেন তার জন্যে একেবারে পাগল হয়ে উঠেছেন, সারা ‘পিথিমী’ দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। এত সহ্য হয় না, যত সব সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড! অথচ কবিকে তঁার সন্তান রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের জন্য শেষ পর্যন্ত প্রাণের শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী থেকে সাময়িকভাবে সরে থাকতে হয়েছিল শ্রীনিকেতনে। তিনি দুঃখ করে বলতেন, ছেলে-মেয়েদেরই ঠিকমতো মানুষ করতে পারলেন না, আশ্রম-বিদ্যালয় চালিয়ে আর কী লাভ! তঁার এই হাহাকার বিশ্বভারতীতে রথীন্দ্রনাথের কয়েকটি কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে।
বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসার পরে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর সব ভার কবি রথীন্দ্রনাথের কঁাধে তুলে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, রথীন্দ্রনাথ হয়তো কবির ভাবনা বুঝতে সক্ষম হবেন, বিশ্বভারতীর দায়িত্ব পেলে তিনি সুচারুভাবে তা পরিচালন করতে পারবেন। পুত্র হিসাবে পিতার প্রতি সম্মান ও যত্নের কোনও ত্রুটি না থাকলেও বিশ্বভারতী পরিচালনার ক্ষেত্রে রথীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কবির এত দিনের সাধনার যে বিস্তর ফারাক দেখা দিয়েছিল, যা কবির কাছে নিদারুণ যন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠে। রামানন্দবাবুকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কত অন্যায় হচ্ছে বুঝেও তঁার চুপ করে থাকা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। ‘দক্ষিণায়ণ’ বাড়ির নামের সঙ্গে তাল রেখে ‘উত্তরায়ণ’ তৈরি হলে রবীন্দ্রনাথ ব্যঙ্গ করে বলতেন, ও আসলে ‘প্রত্যুত্তরায়ণ’! সাজাহানকে তঁার ছেলে যেমন জেসমিন টাওয়ারে বন্দি করেছিল, তেমনই ‘উদীচী’-র সামনে জুঁই ফুলের লতা লাগিয়ে রথীন্দ্রনাথও তঁার জন্য জেসমিন টাওয়ার নির্মাণ করেছেন! হৃদয়ে কতটা যন্ত্রণায় রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ এই দুঃখবিদ্ধ পরিহাস করেছিলেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। ‘উদয়ন’ প্রয়োজনের তুলনায় অতিকায় করে তৈরি হওয়ার পরেই আশ্রমের ইতিউতি বড় বড় বাড়ি তৈরির একটা হিড়িক পড়ে যায়। কবির স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে প্রকৃতি ও মাটির বাড়ির আড়াল করে দিকে দিকে সুউচ্চ প্রাসাদোপম ঘর নির্মাণ ও কৃত্রিম বাহারি ফুলের বাগানের ব্যবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথ মনে মনে এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে, শেষ জীবনে তঁার প্রাণের শান্তিনিকেতন ছেড়ে বারবার মংপু, কালিম্পং, আলিপুর, বরানগরে তঁার অন্য প্রিয় মানুষদের সংসারে চলে গিয়েছিলেন বলে অনেকের অভিমত।
পিতা-পুত্রের এই দ্বৈরথে পড়ে শিল্পী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। বিখ্যাত পিতার ছায়া সবসময় তঁাকে তাড়িয়ে ফিরেছে। পিতার আদেশে কৃষিবিজ্ঞান পড়তে গিয়েছেন বিদেশে, ফিরে এসে বিবাহ করেছেন পিতার পছন্দের একটি বিধবা মহিলাকে। স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বিদেশ ভ্রমণে সঙ্গে গিয়েছেন পিতা রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতীর নানা আর্থিক ও আইনগত বিষয়ে সদা ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। শান্ত মুখশ্রীর অন্তরালে হৃদয়ের আগ্রহ বাইরে প্রকাশ করার সুযোগ কদাচিৎ পেয়েছেন। তঁার কর্মের মধ্যে দিয়ে যেটুকু সুযোগ তিনি পেয়েছেন, সেখানেই শিল্পীসত্তার পরিচয় রেখেছিলেন। ‘শিল্পী’ শব্দটির তাৎপর্য বহু দূর প্রসারিত
করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন যাপন-শিল্পী। শেষ জীবনে পিতার সমস্ত ছায়া থেকে দূরে সরে থাকতে চেয়ে নীরবে চলে গিয়েছেন দেরাদুনে নিভৃতবাসে। তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন নিরহং, নিবেদনময় শিল্পী।
(মতামত নিজস্ব)
