মাধ্যমিক পরীক্ষা-শেষের 'উদযাপন' বই ছিন্ন করে। জেলায় জেলায় এক ছবি। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই কি তবে লুকিয়ে এই গ্রন্থঘৃণার বীজ?

পরীক্ষা-শেষে আনন্দের উৎসব এমনও হতে পারে? মাধ্যমিক পরীক্ষা, জীবনের প্রথম অ্যাকাডেমিক পরীক্ষা, শেষ হতেই একদল ছাত্র মেতে উঠল উল্লাসে। এবং সেই উল্লাস শেষ পর্যন্ত পৌঁছল তার চূড়ায়: বই-খাতা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে রাস্তায় উড়িয়ে দেওয়ার মত্ততায়! এবং এই একই উন্মত্ত সেলিব্রেশন দেখা গেল আলিপুরদুয়ার, বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগনা, মালদা, কলকাতার বাগুইআটিতে। ছাত্রদের বই ছেঁড়ার এই 'মহোৎসব' অনেক দ্রষ্টার মধ্যে জাগিয়েছে এই আঁতকে ওঠা প্রশ্ন: যে-ছাত্রদের এতটুকু মায়া-মমতা, ভালবাসা-শ্রদ্ধা নেই বইয়ের প্রতি, যে-বই পড়ে তারা মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য তৈরি হয়েছে, তারা কেমন ছাত্র?
শিক্ষা তাদের নিয়ে গিয়েছে কোন মূল্যবোধে? পরীক্ষা দেওয়া মানে কি বই থেকে মুক্তি? বইয়ের মতো 'আপদ'-মুক্তির আনন্দ বোঝাতেই কি বই-ধ্বংসের এই পাবলিক প্রদর্শন?
বারাসতের এক ছাত্র অবশ্য বইয়ের প্রতি তার রাগ ব্যাখ্যা করেছে একেবারে অপ্রত্যাশিত স্পষ্টতায় এই ভাষায়: বইগুলো সঙ্গে রেখে কী লাভ হল? এমন কড়া গার্ড যে বই বের করে টুকতেই দিল না। যে-বই টোকার কাজে লাগে না, সে-বই রেখে কী লাভ? তাই কুচিকুচি করে রাস্তায় উড়িয়ে দিয়েছি।
আশ্চর্য করল একটি বিষয় বই ছেঁড়ার ধুম সর্বত্র; পশ্চিমবঙ্গের সব জেলায় জেলায়। এমন কাজের নেপথ্যে কি তবে একই ভাবনা কাজ করেছে আলিপুরদুয়ার থেকে বীরভূম থেকে উত্তর ২৪ পরগনা থেকে মালদা থেকে কলকাতায়? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই কি লুকিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই গ্রন্থঘৃণা বা গ্রন্থ-অনীহার বীজ?
অনেক ছাত্রছাত্রীই মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য তৈরি হয় কোচিং ক্লাসে বা প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাওয়া প্রশ্নোত্তর পড়ে। বইয়ের সঙ্গে তাদের সে-অর্থে সম্পর্কই গড়ে ওঠে না ছেলেবেলা থেকে। বইয়ের কোনও জায়গা নেই তাদের জীবনে মোবাইল-প্রমত্ততার মধ্যে। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক না-গড়ে ওঠার আরও এক বড় কারণ হল, অনেক ছাত্রছাত্রীই ক্লাস নাইন পর্যন্ত পাস-ফেলের চ্যালেঞ্জ ছাড়াই ক্লাসে উঠে যায়। সুতরাং তাদের বইয়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগই-বা কোথায়?
এর ফল হয় মারাত্মক। যখন তারা, অবশেষে, জানতে পারে মাধ্যমিক উতরে যেতে বই পড়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হবে, তাছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই, তখন অচিরেই বই তাদের জীবনে হয়ে দাঁড়ায় বড় বালাই। যেন বইয়ের মতো 'শত্রু' আর হয় না। যত ক্রোধ ঘৃণা গিয়ে পড়ে এই 'পরম শত্রু' বইয়ের উপর। অনেকে হয়তো ভেবে ছিল, পরোয়া নেই, পরীক্ষায় বই নিয়ে গিয়ে দেদার টোকা যাবে। এ বছর সে-গুড়ে বালি জুটেছে অনেকের ভাগ্যে। সুতরাং মাধ্যমিক শেষে ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই বই ছিঁড়ে রাস্তায় উড়িয়ে দিয়ে বইমুক্তির উৎসব যাপন করেছে। বই ছিঁড়ে কুচিকুচি করে পরিত্রাণের উদযাপন---এই হয়তো সোজা উত্তর।