করণ থাপারকে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে ভোট বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কিশোর দাবি করেছেন টেলিভিশনে, ইউটিউবে ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদির দর্শক উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০১৯-এর মতো মোদির প্রতি সমর্থনের ঢেউ এবার নেই। যে-কারণে ভোটের হার কমছে। অর্থাৎ, ভাবমূর্তির ক্ষয় ঘটছে। ভোট রাজনীতি যদি এখন এই ভাবমূর্তির যুগেই ঢুকে থাকে, তাহলে মোদির ভাবমূর্তির এই উল্লেখযোগ্য ক্ষয় কি বিজেপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণ্ডি পার করে দিতে পারবে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
ভারতের ভোটের রাজনীতি ‘এজ অফ ন্যারেটিভ’ থেকে ‘এজ অফ ইমেজেস’-এ এসে দাঁড়িয়েছে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ, কোনও একটি রাজনৈতিক স্লোগান বা বক্তব্যর উপর দাঁড়িয়ে আর ভোট হয় না। ১৯৮৯ সালে ধুন্ধুমার ভোট দেখা গিয়েছিল ‘বোফর্স দুর্নীতি’ ঘিরে। ৪০০-র বেশি আসন থাকা একটা সরকার শুধুমাত্র একটা ‘ন্যারেটিভ’-এর মুখে দাঁড়িয়ে উড়ে গেল। ১৯৯৬ সালে পি. ভি. নরসিংহ রাওয়ের সরকারের ক্ষেত্রেও প্রায় একইরকম ঘটনা ঘটেছিল। একের পর এক স্ক্যাম সরকারটাকে ডুবিয়ে দিয়েছিল।
২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের তরফে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’, ‘ফিল গুড’ ইত্যাদি ‘ন্যারেটিভ’ খাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা বুমেরাং হয়ে ফিরে অাসে। সরকারের তৈরি করা ‘ন্যারেটিভ’-এর সঙ্গে সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা মেলাতে পারেনি। স্বল্প সঞ্চয়ের প্রকল্পগুলিতে কয়েক শতাংশ সুদ কমে যাওয়া মানুষকে ভোটের দীর্ঘ লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। মুখ থুবড়ে পড়েছিল বাজপেয়ী সরকার।
[আরও পড়ুন: ‘দুঃখজনক ঘটনা’, ভূমিধসে বিধ্বস্ত পাপুয়া নিউ গিনিকে সাহায্যের আশ্বাস মোদির]
ভারতীয় রাজনীতিতে ‘ন্যারেটিভ’-এর যুগ সম্ভবত এই শতকের গোড়াতেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ২০০৪-এর ভোটের ফল প্রকাশের পর সোনিয়া গান্ধীর অন্তরাত্মার ডাক দেশ দেখেছিল। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার হেলায় ছেড়ে দিলেন তিনি। ‘ন্যারেটিভ’-এর যুগ থেকে ‘ইমেজেস’ তথা ভাবমূর্তির যুগে প্রবেশ করল দেশের রাজনীতি। মনমোহন সিংয়ের এক দশকে অর্থনীতি নিশ্চিতভাবে এগিয়েছে। ১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রী মনমোহনের হাত ধরে যে লাইসেন্স ও পারমিট-রাজের অবসান ঘটেছিল, এক দশক পরে এসে তার সুফল দেখেছে দেশ। আর্থিক বৃদ্ধির হার দুই অঙ্কে পৌঁছেছিল। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সুষ্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল। আর্থিক বৃদ্ধির উচ্চ হারের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছিল মাথাপিছু আয়। ১০০ দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষা আইন-সহ দেশের বড় বড় সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প এই সময়েরই ফসল। মনমোহন জমানা যখন মধ্যগগনে, তখন বিশ্বজুড়ে দেখা গিয়েছিল মহামন্দা। কিন্তু, ২০০৮-এর সেই মন্দার আঁচ লাগেনি ভারতের গায়ে।
কিন্তু সেই মনমোহনের সরকারও ২০১৪-তে ধসে গেল ভাবমূর্তির সংকটে। ‘দুর্বল প্রধানমন্ত্রী’– এই তকমা সেঁটে গিয়েছিল মনমোহনের মুখচ্ছবির সঙ্গে। তাঁর সরকারকে দাগিয়ে দেওয়া হল নীতিপঙ্গুত্বে ভুগতে থাকা একটি সরকার হিসাবে। ২০১৪ সালে বিরোধীদের সামনে কোনও ‘ন্যারেটিভ’ ছিল না। গণতন্ত্রে খুব চালু ‘ন্যারেটিভ’ হল দুর্নীতি, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি। 'জরুরি অবস্থা'-র সময় গণতন্ত্র বাঁচানোর স্লোগান দেওয়ালে ছেয়ে গিয়েছিল। রাজীব গান্ধী বা নরসিংহ রাওয়ের আমলে দুর্নীতির অভিযোগ প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি সব রাজনৈতিক বক্তব্য ও অভিযোগকে ছাপিয়ে ভোটের প্রচারের মূল চালিকাশক্তি হতে পারেনি। পরিকাঠামোয় ভাল কাজ এবং নিজের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি বাজপেয়ীকে রক্ষা করতে পারেনি। ভোটের ‘ন্যারেটিভ’-এর সামনে তঁাকে পরাজয় মানতে হয়। গত দু’-দশকে এই ছবিটা ধীরে-ধীরে বদলে গেল।
[আরও পড়ুন: যাবজ্জীবন সাজা থেকে মুক্তি, খুনের মামলায় হাই কোর্টের নির্দেশে স্বস্তিতে রাম রহিম]
রাজনীতির এই আমূল বদলে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যোগাযোগ প্রযুক্তি ও প্রচারমাধ্যমের। যারা অবিরাম এই ভাবমূর্তি গড়ছে ও ভাঙছে। সোনিয়ার ভাবমূর্তি যদি ২০০৯ সালে দ্বিতীয় ইউপিএ-কে ক্ষমতায় ফিরিয়ে থাকে, তাহলে মনমোহনের ‘দুর্বল প্রধানমন্ত্রী’ ভাবমূর্তি নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের পতনের মূলে। অাবার ২০১৯-এ যে নরেন্দ্র মোদির ‘৫৬ ইঞ্চির ছাতি’ সম্পন্ন ‘শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী’-র ভাবমূর্তি যে বিজেপিকে ৩০০ পার করিয়েছিল, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। স্মার্টফোনের বিস্তার এই ভাবমূর্তি নির্মাণে প্রধান সহায়ক। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোটি-কোটি 'ফলোয়ার' বা অনুসরণকারী নেতাকে সহজে মহামানবের অাসনে বসিয়ে দিচ্ছে। বিরোধী দলের হাজারো ‘ন্যারেটিভ’ এই ‘মহামানব’ সুলভ ভাবমূর্তির সামনে তুচ্ছ।
২০২৪-এর লোকসভা ভোটের মধ্যে দাঁড়িয়েও এই ‘ভাবমূর্তি’-র রাজনীতিতে ভরসা শাসক ও বিরোধীদের। ভাবমূর্তি নির্মাণে ২০১৯-এ মোদির হাতিয়ার ছিল পেশিবহুল জাতীয়তাবাদ। ২০২৪-এর গোড়ায় ‘বিশ্বগুরু’ ভাবমূর্তি নির্মাণে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ভোট যত এগিয়েছে তত হিন্দুদের ‘মসিহা’ হিসাবে তিনি নিজেকে তুলে ধরছেন। বিরোধীরাও প্রধানমন্ত্রীর এই ‘ধর্মগুরু’ ভাবমূর্তিকে নিশানা করেই প্রচারকে শক্তিশালী করছে। কয়েক দিন আগে সমাজমাধ্যমে করণ থাপারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভোট বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কিশোর চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ২০১৯-এর তুলনায় টেলিভিশনে, ইউটিউবে ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদির দর্শক উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। কিশোরের দাবি, ‘মোদিকে ঘিরে উন্মাদনার তীব্রতা কমেছে।’ সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ২০১৯-এর মতো মোদির প্রতি সমর্থনের ঢেউ এবার নেই। যে-কারণে ভোটের হার কমছে। অর্থাৎ, ভাবমূর্তির ক্ষয় ঘটছে।
[আরও পড়ুন: রাতের অন্ধকারে বুনো শিয়ালের হামলা মুর্শিদাবাদের হাসপাতালে! জখম ১০]
ভোট রাজনীতি যদি এখন এই ভাবমূর্তির যুগেই ঢুকে থাকে, তাহলে মোদির ভাবমূর্তির এই উল্লেখযোগ্য ক্ষয় কি বিজেপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণ্ডি পার করে দিতে পারবে? মূল্যবান এই উত্তরের জন্য অার সাতদিনের মাত্র অপেক্ষা। তবে এখনও একদফা ভোট বাকি। মোদির ভাবমূর্তি গড়ার প্রক্রিয়াও থেমে নেই। সম্প্রতি, বাগবাজারে মায়ের বাড়িতে প্রার্থনা ও বিবেকানন্দ রোডে স্বামীজির ভিটে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর রোডশো এই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ।