shono
Advertisement
Happiness

সুখে থাকার আদর্শ রেসিপি কী?

ভারত 'অসুখী' কেন?
Published By: Biswadip DeyPosted: 03:57 PM Apr 03, 2025Updated: 03:57 PM Apr 03, 2025

বিশ্বের সুখী দেশগুলির তালিকায় ভারতের স্থান ১১৮তম। আর্থিক বৈষম্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্যর দুর্বল পরিকাঠামো, বেকারত্বের অভিশাপ মানুষকে অসুখী করে তুলেছে। দুর্নীতি নিয়েও রয়েছে মানুষের ক্ষোভ। কাজের জায়গা হোক বা আপাতদৃষ্টিতে ‘সুখী’ গৃহকোণ– অতিরিক্ত মানসিক চাপ মানুষকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। সুখে থাকার আদর্শ রেসিপি তাহলে কী?

Advertisement

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, “জোটে যদি মোটে একটি পয়সা/ খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’/ দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার/ ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!” ওই ফুলটি হল সুখের প্রতীক। একজন মানুষ কীসে সুখী হবে, বিচার করা বেশ জটিল। সেই জটিল বিষয়টি বিশ্লেষণের চেষ্টা চালিয়ে আসছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওয়েলবিয়িং রিসার্চ সেন্টার, গ্যালআপ গবেষণা সংস্থা এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের সাসটেনেব্‌ল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক।

গত ২০ মার্চ, ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবসে’ বিশ্বের সুখী দেশগুলির ক্রমতালিকা প্রকাশিত হয়েছে। গত সাত বছরের মতো এবারও তালিকায় প্রথম স্থান দখলে রেখেছে ফিনল্যান্ড। এরপর আছে ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইডেন ও নেদারল্যান্ডস। ভারতের স্থান ১১৮তম, আর ১৪৭টি দেশের মধ্যে সর্বশেষ স্থানটি পেয়েছে আফগানিস্তান। সুখের সূচকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অবনমন অব্যাহত আছে, এ-বছর দেশটির র‍্যাঙ্ক ২৪, ব্রিটেন আছে একধাপ আগে ২৩তম জায়গায়। ভারতের ক্ষেত্রে আক্ষেপের কথা হল– মাথাপিছু আয়, সুস্থ আয়ুষ্কাল, দক্ষ প্রশাসন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতায় অনেক পিছিয়ে থাকা দেশ পাকিস্তানও সুখের নিরিখে অনেকটা এগিয়ে। গতবারের তুলনায় একধাপ পিছিয়ে গেলেও এবার তাদের র‍্যাঙ্ক ১০৯। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের ‘সোশ্যাল সিস্টেম’ ভারতের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। ২০২৫ সালে ভারতের অবস্থানের ২০২৪ সালের তুলনায় (১২৬তম) কিছুটা উন্নতি ঘটলেও, সামগ্রিকভাবে ভারতীয়রা অসুখী– এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

ভারত অসুখী কেন?
এটা অনস্বীকার্য ভারতের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে, এ-ও বলা যায় না। জনবহুল এই দেশে মানুষের একাকিত্ব তুলনামূলকভাবে কম, পরিবার প্রথা এখনও সুদৃঢ়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সামাজিক স্বীকৃতি সুস্পষ্ট, তবে আর্থিক বৈষম্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্যর দুর্বল পরিকাঠামো, বেকারত্বের অভিশাপ মানুষকে অসুখী করে তুলেছে। সুখসূচকে ভারতের পিছিয়ে থাকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, দুর্নীতি নিয়ে মানুষের ক্ষোভ। দেশে একের পর এক ঘটে চলা স্ক্যাম, সরকারি অফিসে ঘুষের অবাধ প্রচলন, যখন-তখন মন্ত্রী, আমলা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক চুনোপুঁটিদেরও গোপন আস্তানায় তল্লাশি চালিয়ে পাহাড়প্রমাণ বেআইনি টাকার সন্ধান– বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিষয়গুলি সুখ মাপনে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে গিয়েছে। এছাড়া কাজের জায়গায় প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা এবং অসম্ভব চাপ, সঙ্গে সামাজিক ও পারিবারিক চাপ মানুষকে অতিরিক্ত মাত্রায় অসহিষ্ণু করে তুলছে। চুঁইয়ে পড়া ব্যর্থতা, বিষাদ, অবসাদ, অশান্তি মানুষকে অসুখী করে তুলছে।

যুদ্ধদীর্ণ দেশে সুখের রেসিপি
তাৎপর্যপূর্ণভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলি সুখের নিরিখে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। লক্ষণীয়ভাবে উন্নতি করেছে ইজরায়েল। তাদের স্থান অষ্টম। আমেরিকা, ইউরোপের বহু দেশকে ছাড়িয়ে তালিকায় একদম উপরদিকে জায়গা করে নিয়েছে। জঙ্গি হামলা, লাগাতার যুদ্ধ, অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামলে ইরাকবাসীদের সুখে থাকার মূল কারণ তারা বৃহত্তর পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে থেকে অনেক বেশি নিরাপত্তা বোধ করে। এছাড়া তাদের খাওয়া, পরা, বাসস্থানের জন্য উদ্বিগ্ন হতে হয় না, এসবের দায়িত্ব দেশের সরকারের। এটাই যুদ্ধের আবহে বাস করেও তাদের সুখে থাকার রেসিপি।

উত্থান মেক্সিকো ও পুয়ের্তো রিকো-র এই দু’টি দেশই তালিকায় প্রথম দশটি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উত্থানের মূল কারণ হল, দেশ দু’টির তরুণ প্রজন্ম দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চূড়ান্ত আশাবাদী। ফলে শিক্ষা ও কর্মসূত্রে দেশত্যাগের প্রবণতাও তাদের মধ্যে কম। আবার, পরিবারের আকার সুখের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। পুয়ের্তো রিকো এবং মেক্সিকোয় চার থেকে পঁাচ সদস্যের পরিবার পরিলক্ষিত হয়। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সুখ পরিবারের সদস্যর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি বৃহত্তর সুখের পরিচায়ক।

আমেরিকা ও ব্রিটেন পিছচ্ছে
হিসাব বলছে, ২০২১ সাল থেকে সুখের হিসাবে এই দুই দেশের অবস্থান ক্রমশই নিম্নগামী। এ-বছর সেটা নেমে দঁাড়িয়েছে ব্রিটেনের ২৩, এবং আমেরিকার ২৪তম। এই পিছিয়ে থাকার মূল কারণ বলা হচ্ছে, একাকিত্ব। যতই মাথাপিছু আয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিকাঠামোয় বিশ্বের অন্যান্য দেশকে টেক্কা মেরে এগিয়ে থাকুক না কেন, আমেরিকা, ব্রিটেন দুই দেশেই মানুষের একাকিত্ব, দুর্বল পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো সুখের হিসাবে দেশ দু’টিকে ক্রমশ পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অ্যালকোহলের অত্যধিক ব্যবহার, আত্মহত্যা, হতাশার মৃত্যু সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটিয়ে জীবন সম্পর্কে মানুষের চরম বিরাগের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আমেরিকা ও ব্রিটেনে তরুণ প্রজন্মও অনিশ্চয়তা এবং একাকিত্বে ভুগছে। তাদের মধ্যে কাজ হারানোর আতঙ্ক বাড়ছে। আধুনিক প্রজন্ম দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাশ হয়ে পড়ছে, এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংশয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া সুখের এক চিরন্তন ছবি। গত দুই দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একা খাবার খাওয়া মানুষের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও ছবিটা আলাদা নয়।

শেষে আফগানিস্তান ১৪৭টি দেশের শেষতম স্থানটি আফগানিস্তানের দখলে। এর অন্যতম কারণ হল, সেদেশে মহিলাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরাধীনতার শৃঙ্খল পরানো হয়েছে। তালিবানি শাসন মহিলাদের স্বাধিকারের উপর বিধিনিষেধের কঠিন-কঠোর বর্ম পরিয়ে রেখেছে, যার অন্যথা হলেই কঠোর শাস্তি, এমনকী মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে যুদ্ধ, জঙ্গি কার্যকলাপ, অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এবং অর্থনৈতিক ক্রমঃপতন। রাজনৈতিক দুর্নীতি, ব্যর্থ শাসনব্যবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং মানবিক অধিকার রক্ষার সংকটের কারণে আফগানিস্তানের সঙ্গে তালিকার একদম শেষের দিকে জায়গা করে নিয়েছে লেবানন, হাইতি, ভেনেজুয়েলা এবং জিম্বাবুয়ের মতো দেশগুলো।

সুখবৃদ্ধির জন্য করণীয়
‘সুখ সূচক’ নির্ণয়ের সমীক্ষায় কোনও দেশের মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত কি না, একসঙ্গে বসে খাবার ভাগ করে খায় কি না, বিপদে একে অপরের পাশে দঁাড়ায় কি না, সম্পূর্ণ অচেনা সহনাগরিকের প্রতি কতটা যত্নশীল ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়। এই সমীক্ষায় একটা মডেল প্রশ্ন থাকে, ‘তোমার দেশে মানিব্যাগ হারিয়ে গেলে সেটা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা? বা, কার কাছ থেকে সেটা ফেরত পাওয়ার আশা করো?’ প্রতিবেশী, অচেনা মানুষ, না পুলিশ? যদি উত্তরটা প্রতিবেশী হয়, তাহলে বুঝতে হবে সমাজে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস অটুট আছে। উত্তর অচেনা কেউ হওয়ার অর্থ, সেই বিশ্বাস বৃহত্তর ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়, আর পুলিশ বা প্রশাসনের ফিরিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের উপর নাগরিকদের ভরসা ও বিশ্বাস প্রমাণ করে। আর উত্তর যদি তিনটেই হয়, তার অর্থ সুখের নিরিখে দেশটির স্থান অনেক উপরে।

কবির মতে, খিদে মিটে গেলে মানুষ ফুল কেনার মধ্যে দিয়ে সুখের সন্ধানে ফেরে। তাই জাতীয় উৎপাদন বা স্বাস্থ্য-শিক্ষা পরিকাঠামোর উন্নয়নই শেষ কথা নয়, অন্যের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া, প্রিয়জনদের সঙ্গে একত্রে বসবাস, পারস্পরিক সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা, বাড়িতে আত্নীয়-বন্ধুজনের আনাগোনা, বৃদ্ধ বয়সে এবং অসুস্থতার সময় পরিবারের মানুষের পাশে থাকাও সমানভাবে জরুরি। তারপরও আছে স্বাধীনতা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, আর্থিক বৈষম্য হ্রাস, সামাজিক ভেদাভেদ দূরীকরণ, পারস্পরিক সহৃদয়তা, সহমর্মিতা এবং সদ্‌ব‌্যবহারের মতো বিষয়গুলি।

অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক এগিয়ে থেকেও নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, হংকং, সিঙ্গাপুর, মুম্বই মেট্রো শহরে মানুষ জীবনের সর্বক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান চাপের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। সমীক্ষার ফল জানাচ্ছে, নগরায়ন একদিকে কর্মসংস্থান ও পরিষেবার জোগান দিলেও, একইসঙ্গে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও পরিবেশ দূষণ বাড়িয়ে মানুষকে অসহিষ্ণু এবং অসুখী করে তুলছে। প্রযুক্তির দুনিয়ায় মানুষে মানুষে বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। পুলিশ, প্রশাসন, রাষ্ট্রের প্রতি ভরসা কমছে। তাই শুধু জিডিপি বা কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ঘটালেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারা যাবে ততই মঙ্গল। অন্যথায়, পিছনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে একসময় সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়বে।

(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • বিশ্বের সুখী দেশগুলির তালিকায় ভারতের স্থান ১১৮তম।
  • আর্থিক বৈষম্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্যর দুর্বল পরিকাঠামো, বেকারত্বের অভিশাপ মানুষকে অসুখী করে তুলেছে।
  • সুখে থাকার আদর্শ রেসিপি তাহলে কী?
Advertisement