শত লাগাম ধরতে চাইলেও লাগামছাড়া হয়ে পড়াই সমাজ-সভ্যতা-জীবনের ধর্ম। ‘লাগাম’ ও ‘বেলাগাম’-এর সূক্ষ্ম পার্থক্য অনুভব করি আমরা?

রাসবিহারী অ্যাভিনিউর কাছের রাস্তা। ডাউন বালিগঞ্জ ট্রামটির চালক অনেকক্ষণ ধরে হেঁকে, চিৎকার করে, এমনকী তীব্র ধ্বনিতে ঘণ্টা বাজিয়ে সতর্ক করেও সুবিধে করে উঠতে পারেননি। পথচারী যেন সেদিন ইচ্ছে করেই পতঙ্গ হতে চেয়েছিলেন; ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলেন না-ফেরার অতলান্ত কৃষ্ণগহ্বরে। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু, সম্ভবত এমনই এক নক্ষত্রপতন, যা আগামী বহু যুগ পাঠকের মনে প্রশ্ন তুলবে– গতির লাগাম টানতে ব্যর্থ হওয়া ট্রাম, না কি পদচারণায় স্বেচ্ছা-বেলাগাম কবি, কে আসল ঘাতক?
লাগামহীন কি আমরাও হই না লাগাম পড়তে চেয়েও? যে ভালো না বাসলেও যাকে বোকার মতো ভালোবেসে যাই, জানি না কি– অবচেতনে বেলাগাম ভিক্ষে করে চলেছি তার করুণা? কাঙ্ক্ষিত ‘ইনসেনটিভ’-এর প্রাত্যাশায় তীর্থের কাক হয়ে অফিসে কাজের মাত্রা বাড়ানো, মাইনে না বাড়লেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে আপস, গাজা-ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রাস্তায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইজরায়েলের বোমাবর্ষণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প-ইলন মাস্ক জুটির অঙ্গুলিহেলনে বিশ্বরাজনীতির কম্পাঙ্কমাত্রার পরিবর্তন, গ্রিন হাউস এফেক্ট বৃদ্ধিতে পৃথিবীর উষ্ণতার বেসুরো বাড়, সংবাদপত্র খুললেই ধর্ষণ-নৃশংস খুন-রিরংসার ‘স্টোরি’, নগ্নতা বেচে সমাজ মাধ্যমে লাইক-ভিউয়ার-সাবস্ক্রাইবার আর অর্থ উপার্জন, জীবনের প্রতিটা পরতে জড়িয়ে যাওয়া এআই-এর চোখরাঙানি– লাগাম ও লাগামছাড়ার দড়ি টানাটানিতে প্রতিটি একক ঘটনায় দেখা যাচ্ছে পাল্লা ভারী দ্বিতীয়েরই।
মাঝচৈত্রে তাপমাত্রার পারদ আট ডিগ্রি নিচে নামলেও লাগামহীনতার গতিতে দড়ি পড়ে না। ঠিক যেমন পর্যাপ্ত সাবধানতা অবলম্বন সত্ত্বেও কলকাতা মেট্রোকে গুণে যেতে হয় একের পর এক আত্মহত্যা রোধে ব্যর্থ হওয়ার খেসারত। আসলে, লাগামছাড়া ব্যাপারটাই এরকম। তথাকথিত লাগামকে, শৃঙ্খলাকে সে বাইপাস দেখিয়েই ছাড়বে। সুস্থিতিকে জড়িয়েই ছাড়বে অ্যানার্কির বোরখায়। সমাজ-সংসার, আমাদের মন-মনন-মস্তিষ্ক ও জবানের মেঘে ওড়া পক্ষীরাজের বাচ্চা ঘোড়া-কে তাই আমরা যতই লাগাম টেনে ট্র্যাকে আনার চেষ্টা করি না কেন, লাগামছাড়া যে সে কখনওই হয়নি বা হয় না বা হবে না, একথা বুকে হাত দিয়ে বলা চাপের! ঘোড়া সবসময় দন্তালিকা পরতে চায় না যে!
সম্প্রতি রাজ্যের শাসক দলের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর বিরোধী দলের শুভেন্দু অধিকারীর উদ্দেশে বলেছেন, “বারুইপুরের তৃণমূল সদস্যেরা শুভেন্দু অধিকারীকে ‘ট্রেলার’ দেখিয়েছিলেন। তাঁদের ধন্যবাদ। শুভেন্দু যেদিন মুর্শিদাবাদে ঢুকবেন, সেদিন মূল নাটক মঞ্চস্থ হবে। আসল ‘পিকচার’ দেখানো হবে।” দলের হুঁশিয়ারি ও সতর্কতার পরও বেলাগাম উসকানিমূলক মন্তব্যের জন্য দলের অন্দরেই আপাতত নিন্দিত হুমায়ুন। বিধায়কের প্রতি শাসক দলের এই অভিভাবক সূচক অবস্থানকে সাধুবাদ জানিয়েও প্রশ্ন জাগে– লাগাম ও লাগামছাড়ার পার্থক্য নিরুপণে নীতি পুলিশ হওয়ার যোগ্যতা আমরা হাসিল করতে পেরেছি তো আদৌ?