ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি প্রবেশিকার জন্য পড়ুয়াদের প্রস্তুতকারী কোটা-র কোচিং সেন্টারগুলির অবস্থা তথৈবচ। মাত্রাতিরিক্ত খরচ, আবাসনের অগ্নিমূল্য, পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতাজনিত আত্মহত্যা ক্রমে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা ‘বিকল্প’ খুঁজে নিচ্ছে পাটনা, নয়াদিল্লি, লাতুর, মুম্বই, রাজকোট, বরোদা, সিকার এবং লখনউয়ের মতো শহরে। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
প্রতি বছর কোটা শহরে ছুটে আসা পড়ুয়াদের জন্য ভারতের রাজস্থানের এই গরম, ধুলোময় শহরটির বর্তমান অবস্থা যেন পারফরম্যান্সের একটা ‘প্রেশার কুকার’। রাজস্থানের দক্ষিণাংশে চম্বল নদীর তীরে অবস্থিত কোটা এখন পরিচিত ভারতের ‘কোচিং ক্যাপিটাল’ হিসাবে। ছাত্রছাত্রীদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি নিয়ে সেখানে একগুচ্ছ কোচিং সেন্টার হাজির। কয়েক দশক ধরে জয়েন্টে বাজিমাত করতে এই সেন্টারগুলি পড়ুয়াদের প্রধান ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে। এই শহর সম্পর্কে ‘মিথ’ বা অতিকথা এমনই– এখানকার কোচিং সেন্টারগুলি ছাত্রছাত্রীদের এমনভাবে প্রস্তুত করে দিচ্ছে যে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রবেশিকা পরীক্ষায় নিশ্চিত সাফল্য। সেই নিশ্চিত সাফল্যের স্বাদ পেতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে অভিভাবকেরা কোটায় পাঠাচ্ছে সন্তানদের।
এমনিতে শহরটি এমন একটি অঞ্চলের বাণিজ্যকেন্দ্র যেখানে তুলো, বাজরা, গম, ধনে এবং তৈলবীজ জন্মায়। আবার শিল্পের মধ্যে রয়েছে তুলো এবং তৈলবীজ মিলিং, টেক্সটাইল বয়ন, পাতন, দুগ্ধজাতকরণ এবং ধাতব হস্তশিল্প। আর রয়েছে ‘কোটা স্টোন’ নামে এক ধরনের পাথর, যা বাড়ির মেঝে এবং দেওয়ালের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এসবকে ছাপিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে কোটার অর্থনীতিতে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে শিক্ষাকেন্দ্র, যেখানে আইআইটি-জেইই এবং মেডিক্যাল এনট্রান্স পরীক্ষায় চমৎকার ফল মেলে। শহরে ঢুকলে চোখে পড়বে একের পর এক বিল বোর্ড, হোর্ডিং যাতে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের সাফল্যের খতিয়ান। কোন-কোন প্রবেশিকা পরীক্ষায় কারা শীর্ষ স্থান পেয়েছে তাদের মুখ দেখিয়ে বিজ্ঞাপন। এসব সেন্টারকে ভিত্তি করে আলাদা এক অর্থনীতি গড়ে উঠেছে কোটায়। কিন্তু এবার সেই অর্থনীতিতে ধাক্কা খাওয়ায় নয়া সংকটে শহরটি।
[আরও পড়ুন: পাক-ক্রিকেটকে বাঁচাতে দরকার গম্ভীরের মতো শক্ত ধাতুর কোচ, চর্চা বর্ডারের ওপারেই]
বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, কোটার কোচিং শিল্পকে ঘিরে অর্থনীতির মূল্য প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা। গড়ে শিক্ষার্থী-প্রতি কোচিং ফি বাবদ বছরে অন্তত এক লক্ষ টাকা খরচ। তাছাড়া সেখানে থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য খরচ নিয়ে আরও দেড় থেকে দু’লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে ছাত্রপিছু খরচের অঙ্কটা গিয়ে দঁাড়ায় বছরে আড়াই-তিন লক্ষ টাকা। আর পড়ুয়া যদি ‘হাই-প্রোফাইল হস্টেল’ বা পিজি (পেয়িং গেস্ট) আবাসনে থাকে, তাহলে খরচ তিন লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়! দেশজুড়ে ছাত্রছাত্রীদের কোটার কোচিং সেন্টারের প্রতি আকর্ষণের জেরে রাজস্থানের এই শহরের ইদানীং বসবাসের খরচ বছরের পর বছর উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে দেখা গিয়েছে। ‘কোচিং হাব’ বাইরে থেকে আসা পড়ুয়াদের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় প্রতিটি আবাসিক সম্পত্তি ভাড়ার আবাসনে রূপান্তরিত হয়েছে। মোটের উপর প্রতি মাসে প্রায় সাত থেকে আট হাজার টাকা পড়ুয়া-প্রতি চার্জ করে বাড়ির মালিকেরা।
সেখানে হঠাৎ কোচিং ক্যাপিটালে মন্দার বাজার! যেখানে মোট দু’-লক্ষের উপর ছাত্র ভর্তি হত বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে, সেখানে এক বছরে সংখ্যাটা নেমে এসেছে ১.২ লক্ষে– অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নামকরা কোচিং প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষক ও কর্মীদের বেতন কমাতে বা তাদের অন্য কোনও শাখায় বদলি করতে বাধ্য হয়েছে। বেতন গড়ে ২০-৪০ শতাংশ কমানো হয়েছে। পাশাপাশি মাথায় হাত হস্টেল-আবাসনের মালিকদেরও। প্রশ্ন উঠছে– কোটা ‘ব্র্যান্ড’ কি তাহলে তার চিরাচরিত ঔজ্জ্বল্য হারাতে বসেছে?
[আরও পড়ুন: যৌন হেনস্তার অভিযোগ! ডিরেক্টর্স গিল্ড থেকে সাসপেন্ড অরিন্দম শীল]
এদিকে, কোটার সর্বনাশে অনেকের পৌষ মাস। কোটায় ছাত্র হ্রাসের ঘটনা যখন ঘটছে, তখনই পাটনা, নয়াদিল্লি, লাতুর, মুম্বই, রাজকোট, বরোদা, সিকার এবং লখনউয়ের মতো শহরের বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির শাখাগুলো ভর্তি বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। যেমন, ইতিমধ্যে কোটা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সিকার সেই ছায়ায় বেড়ে উঠছে। শহরটিতে বেশিরভাগই রাজস্থান এবং নিকটবর্তী হরিয়ানার পড়ুয়ারা আসছে। সিকার কোচিং সেন্টারগুলি এই বছরের এনইইটি-র পরীক্ষায় যথেষ্ঠ ভাল ফল করেছে।
আলোর নিচে যেমন অন্ধকার থাকে, তেমনই কোটার কোচিং সেন্টারের অন্তরালে রয়েছে একের-পর-এক আত্মহত্যার কাহিনি। এখানে আসা ছাত্রদের যেসব চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার একটা অংশ মাত্র হল পরীক্ষা। বাকিগুলো বেশ জটিল বাস্তব জীবনে। অনেক অভিভাবকদেরই কোটায় পাঠানোর সামর্থ্য না-থাকলেও সন্তানকে সেখানে পাঠান ধার-দেনা করে। সুতরাং, ছাত্রদের পারফর্ম করাটা খুবই জরুরি হয়ে ওঠে।
আর তা না পারলে সেটা হয়ে ওঠে অসম্মানের। টাকা নষ্ট, বছর নষ্টের গ্লানি বইতে হয়। একটা প্রবল মানসিক চাপ নিয়েই তাদের এগতে হয়। তার উপর সেই সংগ্রামের দিনে নিত্যসঙ্গী একাকীত্ব। তারা জানে না তাদের প্রতিবেশী কে। ফলে, তারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন রুটিন মেনে ক্লাসে যেতে হয়, আর ক্লাসে বড় ব্যাচ থাকার কারণে শিক্ষকরা একজন শিক্ষার্থী কীভাবে অধ্যয়ন করছে তা নিয়ে দেখে উঠতে পারে না। এর ফলে মানসিক চাপ ভাগ করে নেওয়ার মতো মানুষ পারতপক্ষে খুঁজে পায় পড়ুয়ারা; কারণ আশপাশে তো প্রতে্যকেই মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রত্যাশা মোতাবেক পারফর্ম করতে না-পারলে লজ্জা-ভয়ের কারণে অনেক সময় তারা তাদের বাবা-মায়ের কাছেও মুখ খোলে না। ব্যর্থতার আশঙ্কায় আত্মহত্যার চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত, কোটায় অন্তত ১৩ জন পড়ুয়া আত্মহত্যা করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সংখ্যা গত বছর ছিল ২৬। ২০২২ সালে ১৫, ’১৯-এ ১৮ এবং ’১৮ সালে ২০ জন আত্মহত্যা করেছিল। মাঝে ২০২০ এবং ২০২১ সালে করোনার জন্য ‘অফলাইন’ ক্লাস বন্ধ থাকায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। কোটা-র বদলে ‘বিকল্প’ হিসাবে কেউ যদি তার নিজের শহর অথবা কাছাকাছি কোথাও পরীক্ষা প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে সে কেন ওই বিকল্প কেন্দ্রটিকে বেছে নেবে না?
[আরও পড়ুন: অবশেষে টনক নড়ল! জালিয়াতির দায়ে বিতর্কিত IAS পূজা খেদকারকে বরখাস্ত কেন্দ্রের]
ইতিমধ্যেই কোচিং সেন্টারগুলিও পড়ুয়াদের এই অনুভূতি বুঝতে পেরেছে এবং দেশে কেন্দ্র খোলার উদ্যোগে নিয়েছে। সেই লক্ষ্য থেকেই দেশের নামকরা কোচিং সেন্টারগুলি কোটার উপর চাপ কমাতে কৌশলগতভাবে অন্যত্র কেন্দ্র খোলার দিকে নজর দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় উচ্চমানের পরীক্ষাপ্রস্তুতির ব্যবস্থা করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট জায়গার কেন্দ্রগুলিতে ছাত্র-ভর্তির সংখ্যা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি, সেখানকার কর্তৃপক্ষরা অনুভব করেছে যে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে মানসিক সুস্থতা বজায় রাখাটাও জরুরি।
মতামত নিজস্ব
লেখক সাংবাদিক
sidmukh12@gmail.com