রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক বাজেট বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রাজ্যগুলি খয়রাতির প্রকল্পে যে-পরিমাণ খরচ বাড়াচ্ছে, তা কতটা দেশের সামগ্রিক আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক? মূলধনী ব্যয় কমিয়ে এসব কল্যাণমূলক প্রকল্পে খরচ বৃদ্ধি জনগণের উপকারেই বা লাগছে কতটা? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
খয়রাতি বা রেউড়ি নিয়ে বিতর্কের মাঝে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেশের সব কটি রাজ্যের বর্তমান আর্থিক বছরের (২০২৪-’২৫) বাজেট বিশ্লেষণ করে তার তথ্য প্রকাশ করেছে। এ বছরের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই তথ্য সংবলিত বইটি ঘিরে ওয়াকিবহাল মহলের বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। কারণ, এই বইয়ে মিলছে কোন রাজ্য খয়রাতিতে কত টাকা খরচ করছে। খয়রাতি করতে গিয়ে কোন রাজ্যের আর্থিক অবস্থা কোন পরিস্থিতিতে রয়েছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে। খয়রাতির পর রাজ্যগুলির হাতে মূলধনী ব্যয় তথা উন্নয়নমূলক খাতে খরচ করার জন্য কী পরিমাণ অর্থ থাকছে, সেটা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রায় সাড়ে ৩০০ পাতার বইটি তথ্য পরিসংখ্যানে ঠাসা। সেসব তথ্য আরও বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা কিছু দিনের মধ্যেই রাজ্যগুলির আর্থিক অবস্থা ও সম্ভাবনার প্রকৃত ছবি তুলে ধরবেন।
রাজ্যগুলির উন্নয়নমূলক ব্যয় নিয়ে আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, সামগ্রিকভাবে এই ব্যয় সামান্যই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানীয় জল সরবরাহ, নিকাশি, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি কয়েকটি খাতে রাজ্যগুলি আদতে তাদের ব্যয় কমাচ্ছে। গ্রামোন্নয়ন ও নগরোন্নয়নে ব্যয় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রিপোর্টে লিখেছে, ‘কোভিড মহামারীর সময় রাজ্যগুলির আর্থিক অবস্থা যা হয়েছিল তার থেকে পরিস্থিতির প্রশংসনীয় উন্নতি ঘটেছে। কোষাগারগুলির স্বাস্থ্যের একটি স্থায়ী শ্রীবৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু প্রথামিকভাবে যেটা চাপের তা হল রাজ্যগুলির ভরতুকি খাতে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে কারণ হল কৃষি ঋণ মকুব, বিনামূল্যে বা বিপুল ভরতুকিতে বিদ্যুৎ পরিষেবা, পরিবহণ, গ্যাস সিলিন্ডার প্রদান ইত্যাদি। এছাড়া রাজ্যগুলি কৃষক, মহিলা ও যুবকদের নগদ অর্থ হস্তান্তরিত করছে।
রাজ্যগুলিকে এই ভরতুকি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং যুক্তিযুক্ত সীমার মধ্যে রাখতে হবে যাতে এই খরচগুলি কোনওভাবেই রাজে্যর উৎপাদনমূলক খাতে ব্যয়কে কমিয়ে দিতে না পারে।’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া হিসাবে ২০২২-’২৩ সালে রাজ্যগুলির মূলধনী ব্যয় দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন তথা জিডিপির ২.৫ শতাংশ ছিল। ২০২৩-’২৪ সালের সংশোধিত বাজেট অনুমানে সেটা সামান্য বেড়ে জিডিপির ২.৮ শতাংশ হয়েছে। ২০২৪-’২৫ সালের জন্য বাজেটে রাজ্যগুলির এই ব্যয় রেখেছে জিডিপির ৩.১ শতাংশ। যদিও বাজেট বরাদ্দ দিয়ে প্রকৃত ছবিটি সামনে আসে না। কারণ, বাজেটে যে-অর্থ বরাদ্দ হয়, বাস্তবে দেখা যায় খরচ তার থেকে অনেকটাই কমছে। রাজ্যগুলি খয়রাতি ও রেউড়িতে ক্রমশ বেশি অর্থ খরচ করছে বলে যে মূলধনী খাতে ক্রমশ ব্যয় কমাচ্ছে তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। তবে জিডিপির তুলনায় রাজ্যগুলি নিজেদের আর্থিক ঘাটতি একটা সীমার মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট জানিয়েছে, ২০২৪-’২৫ আর্থিক বর্ষের বাজেটে রাজ্যগুলি যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সামগ্রিকভাবে সব রাজ্যের আর্থিক ঘাটতি বিচার করলে তা জিডিপির ৩.২ শতাংশের মধ্যে আটকে থাকার কথা। ২০২৩-’২৪ সালের বাজেটের যে সংশোধিত অনুমান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই আর্থিক ঘাটতি জিডিপির ৩.৫ শতাংশে পৌঁছতে পারে।
রাজ্যগুলি যখন ‘খয়রাতি’ বা ‘রেউড়ি’ দিতে গিয়ে নানারকম প্রকল্পে খরচ বাড়াচ্ছে, তখন আর্থিক ঘাটতি একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে পারা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নির্বাচনী পরিভাষায় ‘খয়রাতি’ ও ‘রেউড়ি’ বলা হলেও, রাজ্যগুলির বাজেটে এই সমস্ত প্রকল্পকে ‘কল্যাণমূলক সামাজিক প্রকল্প’ হিসাবে দেখা হচ্ছে। এই কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি কতটা দেশের সামগ্রিক আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক সেই বিতর্ক থামছেই না। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন নতুন বছর শুরুর অাগে একটি সর্বভারতীয় দৈনিককে ফের জানিয়েছেন, দেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে রাজ্যগুলির মূলধনী ব্যয় কমিয়ে এসব কল্যাণমূলক প্রকল্পে খরচ বৃদ্ধি কতটা জনগণের উপকারে লাগছে, তা বিচার করা প্রয়োজন। কারণ, যখনই রাজ্যগুলি তাদের সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে বেশি টাকা সামাজিক প্রকল্পগুলিতে ব্যয় করছে, তখন বাজেটে টান পড়ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলিতে। অথচ এই মুহূর্তে দেশের সামনে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হল জনগণের দক্ষতা বৃদ্ধি। দেশবাসীকে কাজেকর্মে দক্ষ না করা গেলে উৎপাদন ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব নয়। উৎপাদন ক্ষেত্রে যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। সেই যন্ত্র পরিচালনার জন্য দেশবাসীর দক্ষতার দরকার রয়েছে।
নতুন বছরের প্রাক্কালে অর্থনীতিবিদরা দেশের আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। কারণ শেষ পঁাচটি ত্রৈমাসিকের মধ্যে চারটিতেই দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে ছিল। আর্থিক বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের উপরে না-নিয়ে যেতে পারলে দেশে বেকারত্ব কমানো যাবে না।
এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই যে, ভারতের অর্থনীতির সামনে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা বেকারত্ব। কয়েক দিন আগে বলা হচ্ছিল, নরেন্দ্র মোদির আমলে দেশে বেকারত্ব ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে। বর্তমানে সেই বেকারত্বের পরিমাণ অারও বেড়েছে বই কমেনি। সংগঠিত ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে চাকরির সংখ্যা কমে চলেছে। এই জায়গা থেকে মুক্তি পেতে উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রের দ্রুত বিকাশ প্রয়োজন। উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রে বিকাশ ঘটতে পারে সরকারি স্তরে মূলধনী ব্যয়বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। পরিকাঠামোয় সরকারি খরচ বৃদ্ধি পেলে বাজারে চাহিদা যে ঘাটতি রয়েছে, তা মিটতে পারে। কারণ এই খাতে সরকারের ব্যয় বাড়লে বেসরকারি লগ্নি আরও বেশি পরিমাণে আসবে। রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমেও দেশে উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রে চাহিদা বাড়ানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজারের যা পরিস্থিতি, তাতে চাইলেই রফতানি বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব নয়।
এর সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও যোগ রয়েছে। ২০২৪ সালে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেই ভারতের অনুকূলে ছিল না। ২০২৫ সালে পরিস্থিতির কতটা পরিবর্তন ঘটবে, তা বলা যায় না। জানুয়ারি মাসেই ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ট্রাম্পের আমলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে আমেরিকার নীতি কী হবে, তা নিয়ে দোলাচল ও সংশয় রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধে যদি শুল্কের দেওয়াল তোলে, তাহলে রফতানি বাণিজ্য আরও মার খাবে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে কিছু সুবিধাও দিতে পারে। কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে থেকে ভারতকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। তার জন্য সবসময়ই পরিকাঠামো ও মূলধনী ব্যয়বৃদ্ধি জরুরি। এক্ষেত্রে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যগুলিরও ভূমিকা থাকছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশ করা তথ্য ও পরিসংখ্যান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা নিঃসন্দেহে রাজ্যগুলির জন্য আরও কিছু নীতির প্রস্তাব দেবেন। এই প্রস্তাবগুলি কী ধরনের হতে পারে, তা এখন অপেক্ষা করে দেখার। রাজ্যগুলি কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি নিয়ে যে-ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তা কতটা অর্থনীতির পক্ষে ভাল হচ্ছে, সেটা নিখুঁতভাব বিবেচনা করা উচিত। শুধু ভোটের লক্ষ্যে জনকল্যাণমূলক নীতি গ্রহণ করলে তা দেশের সামগ্রিক আর্থিক বিকাশের পক্ষে সবসময় ভাল নাও হতে পারে।