একটা বছর দশেকের বাচ্চা। তার প্রতি উপচে পড়ছে জনরোষ। কারণ তার আচরণ অমিতাভ বচ্চনের মতো বর্ষীয়ান অভিনেতার প্রতি অসম্মানজনক। তার ‘ঔদ্ধত্য’, অতিরিক্ত স্মার্টনেসে দর্শক বিরক্ত। কিন্তু তাই বলে কি তাকে ‘দুর্বিনীত’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে? বিদ্বেষের ঢেউ কী করে সামলাবে ছোট্ট ছেলেটি? লিখছেন অতনু বিশ্বাস।
অমিতাভ বচ্চন সঞ্চালিত ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ শীর্ষক জনপ্রিয় টিভি শো-র সিজন ১৭-র ‘দুর্বিনীত’ বালকটিকে নিয়ে তোলপাড় দেশ আর মিডিয়াকুল। সোশ্যাল মিডিয়াতেও উপচে পড়ছে আহমেদাবাদের বছর দশেকের এই বালকের প্রতি জনবিদ্বেষের স্রোত। অমিতাভর মতো এক বর্ষীয়ান সুপারস্টারের প্রতি তার তথাকথিত দুর্ব্যবহারের নিন্দায় পঞ্চমুখ নেট-নাগরিকরা। এমনকী, সাধারণ মানুষের অতি-সাধারণ আড্ডার পরিসরেও অনুরণিত হচ্ছে একই সুর। দুর্বিনীত ছেলেটিকে দোষারোপ করা হচ্ছে তার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্যও।
বিশেষজ্ঞরা এবং শিশু-মনস্তাত্ত্বিকরা বসে গেলেন ছেলেটির মনস্তত্ত্বর হিসাব কষতে। তার কার্যকারণের ব্যাখ্যায়। সে কেন এত অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখাবে? পরিশেষে ভুল উত্তর দিয়ে সে তো শূন্য হাতেই ফিরেছে ঘরে। তাতে জনগণের অনেকেই বেশ খুশি। ছেলেটি উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে তার আচরণের।
কিন্তু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, তার শাস্তি তো শেষ হয় না এখানে। বরং এটা কোনও শাস্তিই নয়– আরও অনেক বড় শাস্তির মুখে পড়েছে সে। সামাজিকভাবে ‘ব্রাত্য’ হয়ে যাওয়ার শাস্তি। ছেলেটির আচরণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকেই পর্যলোচনা করতে বসল আমাদের সমাজে এক সন্তানের প্রতি পিতা-মাতা এবং পরিবারের অন্যদের প্রশ্রয় এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতার প্রভাব। এ প্রসঙ্গেই বিশেষজ্ঞদের মুখে অনেকে প্রথমবার শুনল ‘সিক্স পকেট সিনড্রোম’ এবং তার প্রভাবের কথা। এক সন্তান যেখানে হয়ে ওঠে পরিবারের একচ্ছত্র সম্রাটের মতো। এই ছেলেটির স্বভাব এবং আচরণ যেন সেরকমই। এবং সেই সঙ্গে এই ছেলেটির তথাকথিত আচরণের উত্তরে অমিতাভর স্থিতধী আচরণও প্রশংসিত হচ্ছে সর্বত্র।
আমি অবশ্য এমনিতে কেবিসি দেখিনি দীর্ঘ দিন। এককালে অবশ্য দেখেছি এর কিছু এপিসোড। এবং ইংরেজিতে ‘হু ওয়ান্টস টু বি আ মিলিয়নিয়র’-এর বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু এপিসোডও দেখার সুযোগ হয়েছে এক সময়। আমেরিকা, কানাডা কিংবা ব্রিটেনের। সেখানে বিভিন্ন প্রতিযোগীর আচরণে উল্লেখযোগ্য অনেক ধরনের বৈশিষ্ট্যই থাকে বইকি। সে প্রেক্ষিতে এই বাচ্চা ছেলেটি এমন কী করল– সেটা বুঝতে গেলে তো দেখা দরকার তার সঙ্গে অমিতাভর কথাবার্তার অংশটুকু। এই হল এখনকার যুগের এক মস্ত সুবিধা। কোনও কিছুকেই আড়াল করার জো নেই। ইন্টারনেটের ভঁাড়ারে জমা থাকে প্রায় সব কিছুই। চট করে ভিডিওটা তাই দেখে নেওয়া গেল।
এবং বেশ দ্বিধায় পড়লাম আমি। বেশ কয়েকবার দেখার পরেও আমি কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না যে, বালকটি ঠিক কোথায় এমন ‘দুর্বিনীত’ আচরণ করল, যাতে তাকে তুলোধোনা করা যায় এমন আচ্ছা করে। একেবারে শুরুতে সঞ্চালক অমিতাভ যখন প্রতিযোগিতার নিয়ম বলছেন, তঁাকে থামিয়ে দিয়ে বালকটি বলে উঠল, সে সেটা জানে, বহুবার শুনেছে। সত্যি বলতে কী, এই প্রতিযোগিতার এপিসোডগুলি যখন দেখতাম, প্রতি প্রতিযোগীকেই সঞ্চালকের এই নিয়ম বলার ফলে একই কথা বারবার শুনতে আমারও বিরক্তিকরই লাগত।
তবে কিনা পরিণতমনস্ক দর্শক জানে যে, এটা এই ‘শো বিজনেস’-এর একটা অঙ্গ। তাই তারা এতে উত্তেজিত হয় না– বিরক্ত হলেও ঘটে না তার বহিঃপ্রকাশ।
পরিণত প্রতিযোগীও সেটা জানে। ঠিক যেমন বিমানের নিত্যযাত্রী প্রতিবার যাত্রার শুরুতে নিরাপত্তার নিয়মাবলি শোনে, কিংবা মন দিয়ে শোনে না। কিন্তু ‘জানি’ বলে থামিয়ে দিতে যায় না। কারণ, সবাই তো নিত্যযাত্রী নয়, এবং তা বলা বিমানকর্মীদের কাজের মধ্যে পড়ে। অবশ্য এক বালকের সেই ধীরস্থির আচরণ নাও থাকতে পারে। বিশেষ করে ভিডিও ক্লিপিং দেখে মনে হল শিশুটি একটু অশান্ত, ছটফটে। সেটা স্বাভাবিকতার গণ্ডির মধ্যে পড়ে, না কি তা মনোবিদের দু’-হাতের আওতায়– সেটা অবশ্য আমার বোধের অগম্য।
একই বিষয় দেখা গেল, প্রতিযোগিতার প্রশ্নগুলির ক্ষেত্রেও। শেষ প্রশ্নটি ব্যতিরেকে ছেলেটি চারটি বিকল্প দেখতেই চাইছে না। অবশ্য উত্তরগুলি সহজ, তার জানা হয়তো, তাই সে চটপট উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। আসলে দর্শকের কাছে কিংবা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একটা মূল আকর্ষণ তো মহাতারকা অমিতাভ রসিয়ে রসিয়ে বিকল্পগুলি বলবেন, সে নিয়ে বলবেন দু’-চারটে আনুষঙ্গিক কথাও। তঁার সেই প্রকাশভঙ্গি তো ‘শো’-এর অন্যতম বড় আকর্ষণ। সেটা দেখার সুযোগ না-থাকলে তো দর্শকেরও মুশকিল। যাই হোক, আমার কিন্তু বালকটির আচরণের মধ্যে ছটফটে ভাব আছে বলে মনে হয়েছে– যা বৃহত্তর ক্ষেত্রে উদ্বেগের প্রকাশভঙ্গিও হতে পারে বইকি। কিন্তু তার মধ্যে আমি অন্তত দুর্বিনীত আচরণ কিছু খুঁজে পেলাম না। বরং আমার তো মনে হল, একটি শিশুর ক্ষেত্রে এ ধরনের আচরণ সমাজ প্রশ্রয়ই দেয়। এবং বড় হয়ে এই শিশুর ‘স্বাভাবিক’ মানুষ হতে সমস্যা হওয়ার কারণ দেখি না। এই যেমন, এই কেবিসি-র আসরেও শিশুটি যখন প্রথম দিকে ছটফটে ভাব দেখিয়ে কথা বলছে অমিতাভর সঙ্গে, উপস্থিত দর্শক কিন্তু করতালি দিয়ে উৎসাহই দিয়েছে তাকে। তাই দর্শকও তাকে প্রাথমিক ভাবে প্রশ্রয় দিয়েছে– এমনটা ধরে নিতেই হবে। হঠাৎ করে উল্টো সুরে গাইতে শুরু করলে দশ বছরের শিশুটি কোথায় যায়!
এবং এটাও তো ঠিক যে, বাচ্চাটিকে দেখে, তার সঙ্গে কথা বলে, এবং সম্ভবত তার ছটফটানি বুঝেই তাকে নেওয়া হয়েছে কেবিসি-তে। বাচ্চাটির ছটফটানি বুঝতে কিন্তু বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তাহলে কি তার তথাকথিত দুর্বিনীত আচরণের পিছনে তার দর্শক, তার পারিপার্শ্বিক, এদের ভূমিকাও যথেষ্ট নয়? এবং ভেবে দেখলে বোঝা যাবে যে, এখনকার যুগের অনেক ‘জেন আলফা’-ই এমন। সময় বদলেছে। বদলেছে প্রযুক্তি এবং তাদের জীবনধারার স্টাইল। তাদের বড় হয়ে ওঠার, খেলার সরঞ্জাম আর পদ্ধতিও। জেন এক্স, জেন ওয়াই, এমনকী জেন জেড-এর পক্ষেও এদেরকে পুরোপুরি বুঝতে পারা কঠিন বইকি।
তাই বলে এদেরকে চট করে ‘দুর্বিনীত’ বলে দাগিয়ে দিলে চলবে না। তথাকথিত সেই ‘দুর্বিনীত’ আচরণটা কিন্তু আমি অন্তত খুঁজে পেলাম না এখনও। সেটা আমার দেখার ভুল কি না কে জানে! হতে পারে যে, অধিকাংশ অন্য প্রতিযোগীর মতো বাচ্চাটির গদগদ শ্রদ্ধাশীল ভঙ্গিতে মহাতারকা সঞ্চালককে প্রতি পদক্ষেপে সম্মান না দেখানোটাকে ভালভাবে নেয়নি এই তারকা-বিধৃত দেশের ‘শ্রদ্ধাশীল’ জনতা।
তবে এখানেও প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। দশ বছরের এই বালকের কাছে ৮৩ বছরের বৃদ্ধ অমিতাভ বচ্চন ঠিক কে? তিনি যে একেবারেই রুপোলি পর্দার কিংবদন্তি ‘মহাতারকা’ নন এর কাছে, সেটা তো বুঝতে হবে। অমিতাভকে এই সমাজের অভিভাবক-স্থানীয় বলে ভাবারও কোনও কারণও ঘটেনি বালকটির। বরং শিশুটির কাছে তিনি এক প্রশ্নোত্তরের অনুষ্ঠানের বৃদ্ধ সঞ্চালক, যিনি সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যে রংচঙে পোশাক পরে টুথপেস্ট কিংবা মাথা ঠান্ডা হওয়ার তেলের মতো কিছু দ্রব্যের বিজ্ঞাপন করে থাকেন টিভিতে। ব্যস। যে সময়কালে অমিতাভ মাতিয়েছেন হিন্দি সিনেমার দুনিয়া, উপহার দিয়েছেন একের-পর-এক হিট ছবি, তার কোনও অনুরণন নাও পৌঁছতে পারে এই বালকের কাছে। তাই তার কথাবার্তাকে বিচার করতে হবে এখনকার দিনের ছঁাচে ফেলে। ছেলেটি অবশ্যই আর একটু ধৈর্য, একটু বেশি বিনয় আর শ্রদ্ধা দেখাতে পারত। কিন্তু তা দেখায়নি বলে তাকে যে একেবারে ‘ক্যানসেল কালচার’-এর শিকার হতে হচ্ছে সেটাও জনগণের ধৈর্য আর শৈশবের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব।
মানুষ এবং মিডিয়া যেন একেবারে কাঠগড়ায় তুলেছে বালকটিকে। এই ভয়াবহ ভাইরাল ‘ক্যানসেল কালচার’-এর ফলশ্রুতিতে বালকটির আগামী দিনগুলি কীভাবে কাটবে সে-কথা না ভেবেই। এই প্রবল জনবিদ্বেষকে অগ্রাহ্য করা বেশ কঠিন এমনকী প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্কদের পক্ষেও। সেখানে কীভাবে সেই বিদ্বেষের ঢেউকে সামলাবে ছোট্ট ছেলেটি? আমি তাই উদ্বিগ্ন শিশুটির পরবর্তী দিনগুলির কথা ভেবে। তার সামনে দীর্ঘ ভবিষ্যৎ। একটা কেবিসি-র অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার অভিশাপ যেন তাকে তাড়া না করে ফেরে পরবর্তী দীর্ঘ জীবনে। কিন্তু এই ক্যানসেল কালচারের জোয়ারে তার ভবিষ্যৎ জীবন যথেষ্ট পরিমাণে বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। স্টারডমের এই দেশে কে তাকে রক্ষা করবে? যে মিডিয়া মনোবিদদের দিয়ে শিশুদের মনস্তত্ত্বর বিশ্লেষণ করাচ্ছে, তারা কি ভূমিকা পালন করবে শিশুটির এই কঠিন সময়ে? যে অমিতাভর স্থিতধী আচরণ প্রশংসিত হচ্ছে, এক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকায় শিশুটির (মানসিক) নিরাপত্তার জন্য তঁার কোনও উদ্বেগ কিংবা সে সংক্রান্ত কোনও আবেদন বা বিবৃতি আছে কি না জানি না– আমার অন্তত চোখে পড়েনি এখনও।
ইউটিউবে কেবিসি-র ভিডিওটা আর একবার দেখি। একটা দশ বছরের বাচ্চাকে কীভাবে প্রবলভাবে খারাপ– খুব খারাপ– প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে চলে ‘চূড়ান্ত শ্রদ্ধাশীল’ জনগণ, সেটা বোঝার ব্যর্থ চেষ্টায়।
(মতামত নিজস্ব)
