নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুসের শাসনের আট মাস অতিক্রান্ত। অথচ
বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও টলমলে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতি সবই অস্পষ্ট। এরই মধ্যে দানা বাঁধছে অন্তর্দ্বন্দ্ব, দাবি উঠছে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের। শিরে সংক্রান্তি– আসন্ন নির্বাচন। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।

পরিচিত কথা ধার করে বলি, ‘ক্রোনোলজি’ অনুযায়ী ঘটনা-পরম্পরা নজর করুন। বিশ্লেষণও। বাংলাদেশের কপালে অদূরভবিষ্যতের কোন ছবি আঁকা হচ্ছে, হয়তো তা বুঝতে ভুল হবে না।
শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর ছাত্রনেতারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুসকে। আট মাসের দিকে এগিয়ে চলেছে তাঁর শাসন, অথচ দেশ এখনও টলমলে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতি কিছুই স্পষ্ট নয়। আইনের শাসন নেই বললেই চলে। সবকিছু কবে থিতু হবে কেউ জানে না। ক্ষোভ-বিক্ষোভ চুঁইয়ে পড়ছে সর্বত্র। প্রত্যাশা-পূরণে ছাত্র নেতৃত্ব সফল হবে তেমন আশার আলোও দৃশ্যমান নয়।
ফলে হতাশা বাড়ছে। অরাজকতাও।
এই পরিস্থিতিতে পারদের মতো ফুটে বেরচ্ছে মতপার্থক্য। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। ছাত্রনেতাদের মধ্যেও মতানৈক্য স্পষ্টতর হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিপদের সংকেত দিচ্ছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্র নেতৃত্বর সংঘাত। গত রোববারের রাতটা ছিল গুজবের। সামাজিক মাধ্যম সরগরম ছিল সামরিক শাসন কায়েম ও জরুরি অবস্থা জারি নিয়ে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর সবকিছু যখন ঘেঁটে গিয়েছে– পুলিশ, আমলাশাহি, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন নড়বড়ে, তখন একমাত্র স্থির ও অচঞ্চল সেনাবাহিনী। সেই বাহিনীর প্রধান প্রকাশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানিয়ে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন প্রথম দিনেই। ছাত্রনেতৃত্ব তা পছন্দ করেনি। তড়িঘড়ি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতার রাশ তুলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য তারা প্রাণের বাজি ধরেনি। দল গড়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই।
এত দিন যা ছিল তলায়-তলায়, অন্তর্লীন, হুট করে তা এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ছাত্রনেতারা সরকারে থেকেই দল গড়েছে। গাছ ও তলা দু’জায়গাতেই তাদের জোরালো উপস্থিতি। এর পরিণতি কী, বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতেও তা নিয়ে জল্পনা চলছে। কারও কারও ধারণা, ছাত্রসমাজের অপরিপক্বতা, অন্তর্কলহ ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে শাসক হিসাবে টিকে থাকার
অদম্য তাগিদ সেনানীদের বাধ্য করতে পারে এগিয়ে আসতে। সেই পটভূমি প্রস্তুত হচ্ছে।
এই ধারণা সত্যি হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিতভাবে আরও একবার ব্যাহত হবে। কিন্তু সম্ভবত এই প্রথমবার সেজন্য কেউ সেনাকর্তাদের অপরাধী ঠাওরাবে না। আট মাসে দেশটার যা হাল হয়েছে, তাতে বরং গণতন্ত্রপ্রিয় বাংলাদেশি জনতা সেনাবাহিনীকে মুশকিল আসান ভাবতে পারে।
শুরুতে ক্রোনোলজির প্রসঙ্গ টেনেছিলাম। তার প্রথম অধ্যায় এই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি। ছাত্রনেতাদের সতর্ক করে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেদিন প্রথম প্রকাশ্যে বলেন– নিজেদের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি ও কাদা ছোড়াছুড়ি অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। এতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের উপর জোর দিয়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন ‘ইনক্লুসিভ’ হওয়া দরকার। ছাত্রদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই-রা দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। তাদের ভুলচুক হতেই পারে। সেজন্য বিচারের মুখোমুখিও তাদের হতে হবে। কিন্তু এমন কিছু করবেন না, যাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে যায়।’
সেনাপ্রধানের সেদিনের ভাষণ অরাজক দেশের অসহায় নাগরিকদের আশ্বস্ত করেছিল। বাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির যে-চেষ্টা কোনও-কোনও মহল থেকে চলছিল, ওই দিন থেকে তা বন্ধ হয়। কিন্তু দু’টি বিষয় ছাত্র নেতৃত্বকে চিন্তিত রাখে। একটি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন, অন্যটি সেই নির্বাচনে আওয়ামি লিগকে অংশ নিতে দেওয়া। দু’টির কোনওটিই তাদের কাম্য নয়। তাদের লক্ষ্য, আগে সংস্কার, পরে ভোট। এবং সেই ভোটে ‘ফ্যাসিস্ট’ আওয়ামি লিগের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা।
মোটামুটিভাবে এই দুই প্রশ্নে দেশটা এখনও দ্বিধাবিভক্ত। আগে ভোট, না আগে সংস্কার, সবচেয়ে বড় বিতর্ক এটাই। বিএনপি আগে ভোট চায়। তাদের দাবি, নির্বাচিত সরকারই ঠিক করবে সংস্কার কতটা হবে ও কীভাবে হবে। ছাত্র নেতৃত্ব চায় ফ্যাসিবাদ ও মুজিববাদের নিকেশ। সেজন্য প্রয়োজন সংস্কার, নতুন সংবিধান রচনা– তারপর নির্বাচন। সেই নির্বাচনও হবে আগে স্থানীয় পর্যায়ের, পরে সংসদের। আওয়ামি লিগকে ‘নিষিদ্ধ’ করার প্রশ্নে বিএনপি-র মত নেই। তারা অপরাধি লিগ নেতৃত্বের বিচার চাইলেও দল নিষিদ্ধকরণে আপত্তি জানিয়েছে। জামায়েত ইসলামি ভোট নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয়। তারা ব্যস্ত প্রতিষ্ঠান দখলের মাধ্যমে আদর্শ প্রতিষ্ঠায়, পাশাপাশি, ইসলামি শক্তিগুলির জোটবদ্ধতা।
এই বিতর্কে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পেন্ডুলামের মতো দুলছেন। কখনও তিনি জোর দিচ্ছেন ডিসেম্বরে ভোট করানোর উপর, কখনও সংস্কারে। সংস্কারকেও তিনি অল্প ও বেশির মধ্যে ভাগাভাগি করেছেন। এই পরিস্থিতিতে ১৯ মার্চ সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান দেখা করেন ইউনুসের সঙ্গে। ক্রোনোলজির দ্বিতীয় পর্ব ওটাই।
পরবর্তী পর্বগুলো একের-পর-এক দ্রুত ঘটে যায়। ২১ মার্চ ক্রোনোলজির তৃতীয় পর্ব। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপকে ইউনুস সাহেব বলেন, আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধের পরিকল্পনা তঁাদের নেই। তবে নেতাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবতা-বিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিচার হবে। সেই বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও হতে পারে। দ্বিতীয়ত তিনি জানান, সংস্কার কম হলে ভোট হবে ডিসেম্বরে, বেশি হলে পরের বছর জুনে।
আওয়ামি লিগ নিষিদ্ধ না-করা নিয়ে ইউনূসের বক্তব্যের রেশ কেটেছে কি কাটেনি, তোলপাড় করে দিলেন ছাত্রদের দল এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লা। সেই রাতে ফেসবুকে তিনি বললেন, রিফাইন্ড আওয়ামী লীগকে ফেরাতে সেনাবাহিনী তৎপর। ১১ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে ডেকে সেই চাপ তাঁদের দেওয়া হয়েছে, ভারত এই চক্রান্ত করছে। তবে আপস তঁারা করবেন না। ভারতের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা হবে। পরের দিন হাসনাতকে পাশে বসিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ করা হবে না বলে প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য নিন্দনীয়।
ইউনুস সাহেবকে যারা বরণ করে এনেছিল, তারা-ই প্রকাশ্যে তার নিন্দা করায় দেশবাসী হতচকিত। ঠিক তখনই আরও এক বোমা ফাটান ছাত্রনেতা ও উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করতে মোটেই রাজি ছিলেন না সেনাপ্রধান ওয়াকার। তাঁর যুক্তি ছিল, ইউনুস কনভিক্টেড। তাঁর নামে মামলা আছে। তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা করা যায় না। সেই আপত্তি ধোপে টেকেনি। আসিফ জানান, ওয়াকার উপদেষ্টা
হিসাবে ছ’জনের নামও প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁরা মানেননি।
১১ মার্চের ঘটনা দশ দিন পর কেন প্রকাশ করা হচ্ছে সেই জল্পনার মাঝেই ক্রোনোলজির পরের পর্ব। ২৩ মার্চ হাসনাতকে নস্যাৎ করলেন ছাত্রনেতা সারজিস আলম। তিনি জানান, সেনা সদরে তাঁদের ডাকা হয়নি। তিনি ও হাসনাত নিজেদের গরজেই গিয়েছিলেন। ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামি লিগের জন্য সেনাপ্রধান কোনও চাপও সৃষ্টি করেননি। সম্ভাবনা নিয়ে শুধু আলোচনা হয়েছে। সেনাপ্রধান কোনও রকম হুকুমও দেননি। সারজিস আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। এক, সেনাপ্রধানের পদত্যাগের দাবি তাঁরা করেন না। দুই, একান্ত আলোচনা প্রকাশ্যে আনা তাঁদেরই বিপদে ফেলবে। কেউ আর তাঁদের বিশ্বাস করবে না।
দেশটার ললাটলিখন কী, সেই চিন্তায় সবাই বিভোর। ভারতও। এই ডামাডোলে ইউনূস সাহেব ২৬ মার্চ চিন সফরে যাচ্ছেন। ১৭ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের বিদেশসচিব আমনা বালুচ, ২২ এপ্রিল বিদেশমন্ত্রী ইসহাক দার। ১৫ বছর পর ঢাকা ও ইসলামাবাদ ফের কাছাকাছি। ছাত্র নেতাদের ভারত-বিদ্বেষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইসলামি মৌলবাদ। ৩ ও ৪ এপ্রিল ব্যাঙ্ককে ‘বিম্সটেক’-এর আসরে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে আগ্রহী মুহাম্মদ ইউনূস। তঁার চোখে যঁারা দেশের ভবিষ্যৎ, সেনার চোখে সেই ছাত্ররা ‘অপরিপক্ব’। এই ‘সংঘাতের’ পরিণতি কারও জানা নেই। আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ। এখন সিটবেল্ট বেঁধে রাখার সময়।