ভারত-বাংলাদেশের ‘সোনালি অধ্যায়’ প্রায় তলানিতে। হিন্দু নিপীড়ন নিয়ে ভারতের ন্যারেটিভটি হল– উদারপন্থী হাসিনার অনুপস্থিতির কারণেই বাংলাদেশ উগ্র-ইসলামি মৌলবাদের ছেঁকায় জেরবার। অন্তর্বর্তী সরকার সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেননি। আস্থা অর্জন করতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলাও নেই বললেই চলে। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
চার মাস আগেও ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল ‘সোনালি অধ্যায়’। এক-একটি বছর ঘুরত, সম্পর্কের উচ্চতাও বাড়তে থাকত। সেই সম্পর্ক ঝুপ করে এতটা তলিয়ে যাবে কেউ ভাবেনি। ’৬২-র যুদ্ধের পর ‘হিন্দি-চিনি ভাই-ভাই’ স্লোগানের যে-দশা হয়েছিল, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়ের হাল এখন প্রায় তেমন। মেরামত কত দিনে হতে পারে, এখনই আন্দাজ করা কঠিন।
যদিও দুই দেশ-ই জানে অন্যের সান্নিধ্য কত প্রয়োজন! দু’জনই একে-অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনন্তকাল। একজনকে ছাড়া অন্যজন প্রায় অসম্পূর্ণ। এপাশের হাসি ওপাশে হিল্লোল তোলে, ওপাশের কান্নায় এপাশের মন ভারাক্রান্ত হয়। ভাগ্যলিপি এমনই যে, একজন খারাপ থাকলে অন্যজনের ভাল থাকা মুশকিল। অথচ ৫ আগস্টের পর এ এক নতুন সন্ধিক্ষণ। অবিরাম চলছে পারস্পরিক দোষারোপ। এ আঙুল তুলছে ওর দিকে, ও এর দিকে। বহুমুখী সম্পর্কে বেড়ে চলেছে বহুমাত্রিক জটিলতা। বিষিয়ে উঠছে বাতাস। আবহ। দৃষ্টিতে ঝরছে ঘৃণা। সাম্প্রদায়িকতার আগুনে রুটি সেকা হচ্ছে। দুই দেশেই।
তালি কখনও এক হাতে বাজে না। তুড়ি দিতেও দু’টি আঙুল লাগে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাই দোষের ভাগী দু’পক্ষই। কেউ বেশি, কেউ কম। এই বাস্তবতা স্বীকার করে অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে তাকানো জরুরি। সেই বোধোদয়ের উপর ঝুলে থাকছে সম্পর্কের প্রবাহ। যত দ্রুত তা হবে, ততই মঙ্গল। সবার।
অথচ এখনও কাটাছেঁড়া চলছে। দুই দেশ তার মতো করে মেলে ধরছে অভিযোগের ডালা। পরিস্থিতি মোকাবিলার গরজ অদৃশ্য। পালাবদলের পর চার মাস কাটতে চলছে, এখনও দুই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সরাসরি বাক্যালাপ নেই! সেপ্টেম্বরে রাষ্ট ্রসংঘে মুহাম্মদ ইউনূস পৌঁছনোর আগেই নরেন্দ্র মোদি ভারতে চলে এলেন। নভেম্বরে বাকু-তে জলবায়ু সম্মেলনে ইউনূস গেলেও মোদি গেলেন না। সরকারি পর্যায়ে আলোচনা এখনও পর্যন্ত দু’টি। আগস্টে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎ।
তারপর রাষ্ট্র সংঘে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বৈঠক। আগামী ১০ ডিসেম্বর দুই দেশের ‘ফরেন অফিস কনসাল্টেশন’-এর বৈঠক ঢাকায় হওয়ার কথা। সেই বৈঠক নিয়ে ভারত এখনও নীরব। বৈঠক হলে ড্যামেজ কন্ট্রোল হবে কি না জানা নেই। কারণ, বাংলাদেশ জানিয়ে রেখেছে, ওই আলোচনায় তারা হাসিনা প্রসঙ্গের অবতারণা করবে।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও ভারতে আশ্রয়লাভ সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথে প্রধান বাধা। রাজনৈতিক কারণেই ঢাকা ‘পতিত, স্বৈরাচারী’ হাসিনাকে ফেরত চায়। তঁাকে বিচারের মুখোমুখি করতে চায়। কিন্তু জানে, দিল্লি অন্তরায়। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা মনে করে, হাসিনার ‘স্বৈরতন্ত্রী’ হওয়ার নেপথ্যে ভারতের অবদান সবচেয়ে বেশি। এই ‘পারসেপশন’ বা ধারণা এতটাই দৃঢ় যে, ভারতই তাদের কাছে যত
নষ্টের গোড়া।
ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশের একাংশের মধ্যে ভারত-বিরোধিতা প্রবল। সেই বিরোধিতার মাত্রা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে দিন-দিন বেড়েছে। এই স্তম্ভের নিয়মিত পাঠকেরা স্মরণ করতে পারেন, বিরোধিতার কারণগুলি নিয়ে বহুবার সরকারকে সতর্ক করতে চেয়েছি। বারবার লিখেছি, ভারতকে ভাবতে হবে সম্পর্ক এত ‘মধুর ও মসৃণ’ হওয়া সত্ত্বেও ওদেশে ভারত-বিরোধিতার তীব্রতা কেন বেড়ে চলেছে। কেউ শোনেনি। শোধরানোর চেষ্টাও করেনি।
ভারত ভেবেছিল, হাসিনা-ই ওদেশে চিরস্থায়ী। তিনিই বাংলাদেশের ভাগ্য ও ভবিতব্য। হাসিনা ভেবেছিলেন ভারত তঁার চিরকালীন মুশকিল আসান। ভারতই শক্তির আধার। কোনও পক্ষই বুঝতে চায়নি ‘চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন নদে!’ হাসিনা ও তঁার দল ছাড়া ভারত আর কারও উপর কখনও ভরসা করেনি। অন্য কাউকে ক্ষমতাসীন দেখতেও চায়নি। হাসিনার জন্য অশান্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চল শান্ত হয়েছে। ইসলামি মৌলবাদ কোটরবন্দি থেকেছে। হাসিনার দৌলতে ভারত ‘ট্রানজিট’-এর অধিকার পেয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বহুমুখী বিস্তার ঘটেছে। কোনও-কোনও ক্ষেত্রে হয়তো একতরফাও। বিনিময়ে হাসিনা পেয়েছেন ভারতের প্রশ্নহীন রাজনৈতিক সমর্থন। গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে একের-পর-এক ভোট তিনি উতরেছেন। ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’ রা পর্যন্ত কাড়েনি। গত নির্বাচনের আগে পশ্চিমি দুনিয়া প্রশ্ন তুললে ভারত বরং তাদের বুঝিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামি মৌলবাদ ঠেকাতে গেলে হাসিনা ছাড়া গতি নেই। সেই তত্ত্ব যে নির্ভুল, শঙ্কা যে অমূলক ছিল না, বাংলাদেশের ‘নৈরাজ্যের ছবি’ মেলে ধরে ভারত এখন বিশ্বকে সেটাই বোঝাতে চাইছে। সংখ্যালঘুদের উপর ‘অত্যাচার’ ও ইসলামি মৌলবাদের দাপাদাপি নিয়ে ভারতের নিত্য অভিযোগ এই রাজনৈতিক ন্যারেটিভের আলোতেই দেখতে হবে।
হাসিনা যেসব কারণে ভারতের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, নয়া জমানার সেই বাধ্যবাধকতা নেই। হাসিনার পতনের সময় থেকে যা-যা ঘটেছে এবং এখনও কিছু-কিছু ঘটছে, তা দেখে বোঝা যায় ভারতের প্রতি সে-দেশের একাংশের ক্ষোভ কতটা তীব্র। সেই ক্ষোভ কতটা যুক্তিসংগত, কতটাই-বা আরোপিত, সে বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটা নিক্তি মেপে গড়ে তুলতে চায়। ‘উইন উইন’ সম্পর্ক। সমানে-সমানে। বড় তরফ ছোট তরফে নয়। কিন্তু তার আগে তারা চায় হাসিনাকে নিয়ে একটা ফয়সালায় আসতে। কেননা, তারা জানে, হাসিনার ভারতে থাকার অর্থ ঘাড়ের উপর শ্বাস ফেলা। এ-ও জানে, এই বিষয়ে ভারতের মাথা নোয়ানো অসম্ভব।
এটা ঠিক, পালাবদলের সময় সংখ্যালঘু হিন্দুরা আক্রান্ত হয়েছে। এখনও বিক্ষিপ্ত হামলা হচ্ছে। কিন্তু এটাও ঠিক, হিন্দুদের ঘরবাড়ি, মন্দির, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মুসলমানরা পাহারা দিয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসাব অনুযায়ী ৪ থেকে ২০ আগস্ট সংখ্যালঘুদের উপর ২ হাজার ১০টি আক্রমণ ঘটেছে, ২২ আগস্ট থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ৫৭টি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১ হাজার ৭০৫, জনসংখ্যা ৫০ হাজার। ৬৯টি মন্দির ভাঙচুর হয়েছে। এসব হামলার একটা কারণ অবশ্যই ধর্মীয় বিদ্বেষ ও লুটপাট। কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়া। ঐতিহাসিক কারণেই ওদেশের বেশিরভাগ হিন্দু আওয়ামী লীগের সমর্থক। এটাও ‘পারসেপশন’। যদিও আওয়ামী আমলেও হিন্দু নির্যাতন কিছু কম হয়নি।
ভারত হিন্দু-নিপীড়ন নিয়ে হইচই করছে হাসিনা-কেন্দ্রিক ন্যারেটিভ নির্ভুল প্রতিপন্ন করতে। বিশ্বকে বোঝাতে চাইছে, হাসিনাহীন বাংলাদেশ উগ্র-ইসলামি মৌলবাদের ছেঁকায় নিজে ঝলসাবে, প্রতিবেশীদেরও ব্যতিব্যস্ত করবে। কিন্তু অন্য বড় কারণ ভারতের শাসক দল বিজেপির রাজনীতি। উগ্র-হিন্দুত্ববাদের ধ্বজা তুলে রাখতে হলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হিন্দুদের হয়ে গলা তাদের ফাটাতেই হবে।
‘নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন’ (সিএএ) তারা এই কারণেই করেছে। কিন্তু বুঝছে না, এতে সবথেকে ক্ষতি হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের হিন্দুদেরই। তাছাড়া, তাদের চোখে যে-কারণে অন্তর্বর্তী সরকার দোষী, ভারতে তারা নিজেরাও কি তেমনই অপরাধী নয়?
ইউনূস সরকার কেন হাসিনার ভারতবাস ও সংখ্যালঘু প্রশ্নে ভারতীয় ‘অপপ্রচার’-এ এভাবে ডুবে রয়েছে? প্রধান কারণ নিজেদের অসহায়তা ঢাকা। এটা ঠিক, ১৫ বছরের ‘অপশাসন’ চার মাসে দূর হয় না। কিন্তু এটাও ঠিক, এখনও তঁারা সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেননি। আস্থা অর্জন করতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলা নেই বললেই চলে। মনোবলহীন পুলিশ ভরসা জোগাতে ব্যর্থ। ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল ফেরেনি। প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। বিদেশি লগ্নি মুখ ফিরিয়ে আছে। নৈরাজ্য দেশজুড়ে। গোদের উপর বিষফোড়া অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। হেমন্তের বাজারে চৈত্রের হলকা। ভারতের দিকে আঙুল না তুলে উপায় কী?
হাসিনা অধ্যায় শেষ। ওখানে আটকে না-থেকে বাংলাদেশকে এগতে হবে। বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে। ভারতকেও হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশকে মেনে নিতে হবে। বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। বুঝতে হবে, সম্পর্কটা দুই দেশের সরকারের সঙ্গে যেমন, তেমনই জনগণের সঙ্গেও। কোনও ব্যক্তিবিশেষ বা দলনির্ভর নয়।