গায়ক জুবিন গর্গের মৃত্যু যেন এক ফিনিক্সগাথার উত্থান দেখাল। তাঁর অন্ত্যেষ্টি যাত্রা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অন্ত্যেষ্টি যাত্রা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ড’-এ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিবিধ ধর্ম-জাতি, লিঙ্গ-ভাষাভাষির মানুষ বন্ধ রেখেছে তাদের দোকান, বাজার, আনন্দের অনুষ্ঠান। চোখের জল ফেলেছে হৃদয়বেদনায়। কিন্তু কোন জাদুবলে বিনিসুতোয় একসঙ্গে গ্রথিত হল কোটি-কোটি মানুষ? লিখছেন গৌতম সাহা।
রাজনীতি, ধর্ম, জাতি, শ্রেণি, ভাষা– সব ঘিরেই সমাজ ও সামাজিক মাধ্যম জুড়ে শুধু ঘৃণা আর বিভেদ। এমনই এক অস্থির, নিষ্প্রভ সময়ে গায়ক জুবিন গর্গের মৃত্যুর পরে তাঁর জীবনের নানা দিক উন্মোচিত হল সামাজিক মাধ্যমেই। অবাক হয়ে দেখলাম, প্রতিবেশী রাজ্য অসম– বিভেদ আর ঘৃণার রাজনীতিতে যারা ঐতিহাসিকভাবেই বিভক্ত– কী অদ্ভুত ভালবাসা ও সংহতির দৃষ্টান্ত রাখল জুবিন গর্গের মৃত্যুর শোকপালনে। সারা দেশ দেখল, ‘বিবিধের মাঝে মিলন’, ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’– এগুলো আর নিছক শব্দবন্ধ নয়, বাস্তবিকই হওয়া সম্ভব। কী ছিল সেই জাদুকাঠি যা দিয়ে এত মানুষকে সত্যিই এক করা যায়, প্রাণিত করা যায় সৎ কাজে? বৃহত্তর মানব সংহতির দিকে দু’-এক পা এগিয়ে যাওয়া যায়?
জাদুকাঠি ১
বিএসসি পাঠরত বছর উনিশের একটি ছাত্র কলেজের প্রিন্সিপালকে বলছে– আমি পড়াশোনা ছেড়ে গানবাজনা নিয়ে থাকব, বড় আর্টিস্ট হব। কলেজ ছাড়ার ঠিক পরের বছরই সে তার দু’টি মিউজিক অ্যালবাম ‘অনামিকা’ ও ‘গানে কি আনে’ প্রকাশ করে অসমের নবীন ও প্রবীণ প্রজন্মকে মুগ্ধ করল, এবং সেই বছরই সে তার নিজের কলেজে ফিরে এল; তবে এবার ‘বিশেষ অতিথি’ হয়ে।
বহুল পরিচিত জুবিনের জীবনকাহিনির এই অংশটুকু। তবু তা প্রতিবার রূপকথার মতো শোনায়। প্রায় ১২টি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন তিনি। শুধু অহমিয়া গানেই নয়, ছিলেন সব ধরনের গানে পারদর্শী। অসমের পড়শি পশ্চিমবঙ্গে তখন এক নতুন ধারার বাংলা ছবি চলছে, নতুন নায়কদের হাত ধরে। দরকার নতুন ধরনের কণ্ঠ। স্কুলে বাংলা পড়া, অসমের বাঙালি কলোনিতে থাকা জুবিন বাঙালি দর্শক-শ্রোতাদের সেই চাহিদা মেটালেন অনায়াসে। দিলেন অসংখ্য বাংলা হিট গান। বলিউড থেকে ডাক পড়ল। জুবিনের প্রথম দিকের হিন্দি গান ‘গ্যাংস্টার’ ছবির ‘ইয়া আলি...’ জিতে নিল বলিউডের ‘ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড’। অচিরেই হয়ে উঠলেন বলিউডের
‘হামিং কিং’। শুধু হিন্দি, বাংলা, অহমিয়া, ওড়িয়া নয়; গাইলেন তামিল, তেলুগু, মালয়ালম, পূর্ব ভারতের আঞ্চলিক ভাষা মিলিয়ে প্রায় ৪০টি ভাষায় ৩৮ হাজার গান! ভূপেন হাজারিকার পর অসম-সহ উত্তর-পূর্ব ভারত পেল তাদের নতুন সফল সাংস্কৃতিক আইকন। কিন্তু এই আইকন সবার চেয়ে আলাদা। মুম্বইয়ের পেশাদার জীবন, ট্রাফিক জ্যাম, জুবিনের দম বন্ধ করে দিত। অসমের নদী, জঙ্গল, খোলা প্রকৃতি আর মানুষের টানে তিনি ফের ফিরে যেতেন নিজভূমে, অসম।
জাদুকাঠি ২
অসমের মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখল, যে-বলিউডের সাফল্যকে শিল্পীরা পাখির চোখের মতো লক্ষ করে, তাও ত্যাগ করে নিজের মাটিতে ফিরে আসা যায়। অহমিয়া সংগীত, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য অসংখ্য গান গেয়ে, সুর দিয়ে, অভিনয়, সংগীত ও চিত্র পরিচালনা করে সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতির ওতপ্রোত অংশ হয়ে উঠলেন জুবিন গর্গ। তঁার সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা অহমিয়া সংগীত, চলচ্চিত্রকে দিল এক অন্য উচ্চতা। অহমিয়া চলচ্চিত্রের প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘মিশন চায়না’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র মতো বড় বাজেটের ছবি প্রযোজনা করে জুবিন বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। নতুন পরিচালক রিমা বোরার প্রামাণ্য চিত্র ‘ইকোস অফ সাইলেন্স’-এ সংগীত পরিচালনা করেছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে। এই কাজ তঁাকে এনে দেয় ‘জাতীয় পুরস্কার’, আর রিমাকে সর্বভারতীয় পরিচয়। এরকম অসংখ্য নবীন শিল্পীকে জুবিন তুলে এনেছিলেন প্রচারের আলোয়। আর, নিজের বলিউড ছাড়ার কারণ হিসাবে বলতেন, ‘রাজা কখনও নিজের রাজত্ব ছেড়ে যায় না।’
জাদুকাঠি ৩
অসমে যতবার বন্যা বা কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে, জুবিন তঁার দাতব্য সংস্থা ‘কলাগুরু আর্টিস্ট ফাউন্ডেশন’ নিয়ে পৌঁছে যেতেন পরিত্রাণে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করতেন ত্রাণের অর্থ সংগ্রহে। দুর্যোগ-কবলিত এলাকায় স্কুলগুলোর সাহায্যে অর্থ দিতেন, বই বিতরণ করতেন। অহমিয়া যুবক-যুবতীদের খেলাধুলার উন্নতির জন্য ফুটবল প্রতিযোগিতায় আয়োজন করেছেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অলিম্পিয়ান বক্সার শিবম থাপা, দৌড়বিদ হিমা দাসকে বেড়ে ওঠার সময় সাহায্য করেছেন। জুবিন ও তঁার স্ত্রী গরিমা সইকিয়া গর্গের কোনও সন্তান ছিল না। তঁারা ১৫টি গরিব ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ পড়াশোনা ও বিয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেককেই জুবিন রক্ষা করেছিলেন অত্যাচারী পরিবার ও আত্মীয়দের থেকে, আইনের লড়াইয়ে জিতে নিয়েছিলেন তাদের দায়িত্ব নেওয়ার অধিকার। জুবিনের পশুপ্রেমও অসাধারণ। নিজের চারটি কুকুর ছাড়াও অসংখ্য
অসহায় অসুস্থ জীবজন্তুকে উদ্ধার করেছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। কাজিরাঙার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জড়িয়ে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে।
এত কাজ করেছেন জুবিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে, সাধারণের একজন হয়ে। নিজের ‘সেলিব্রিটি’ ইমেজকে ভেঙে যখনই সময়-সুযোগ পেয়েছেন রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা ফুটপাতের গরিবগুরবো মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন, তাদের মতো করে তাদের সময় কাটিয়েছেন, তাদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেছেন, অর্থে-সামর্থে্য পাশে দঁাড়িয়েছেন। সাধারণ অসমবাসীরা তাদের ‘ভূমিপুত্র’-কে কাছে পেয়েছে তাদের মতো করে, তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হিসাবে।
জাদুকাঠি ৪
অসমের স্থানীয় ইস্যু ও জাতিসত্তা রক্ষার জন্য জুবিন বারবার প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন তদানীন্তন কংগ্রেসি ও বর্তমান বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। জুবিনের অনেক গান ও কিছু চলচ্চিত্র অহমিয়া সংস্কৃতি ও রাজনীতির কণ্ঠ ও প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল। ‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’-এর (সিএএ) বিরুদ্ধে জুবিন গর্গ ছিলেন অসমের প্রতিবাদের, ধর্মনিরপেক্ষতার সবচেয়ে বড় মুখ। উগ্রপন্থী সংগঠন ‘ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম’-এর (আলফা) বিরোধিতা করেছিলেন প্রকাশ্যে, নির্ভয়ে। তাদের ফরমান, বিহুতে শুধু অহমিয়া গান গাইতে হবে, তা না মেনে গেয়েছিলেন বাংলা, হিন্দি গান। বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতির আকাশকে বেঁধে রাখা যায় না।’
জুবিন কখনও কোনও রাজনৈতিক নেতাকে ব্যক্তিগত কুৎসা বা আক্রমণ করেননি, কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি, অথচ তাদের রাজনীতির সমালোচনা করেছিলেন নির্ভয়ে, নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে। যার ফলেই অসমের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা-সহ সমগ্র বিজেপি নেতৃত্ব, কংগ্রেস, এমনকী, আলফা পর্যন্ত তঁার মৃত্যুতে আন্তরিকভাবে শোকাহত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলনেতা ও তঁাদের সমর্থকরা দলে-দলে জুবিনের অন্ত্যেষ্টিযাত্রায় যোগ দিয়েছে।
জাদুকাঠি ৫
জুবিনের ধর্ম সম্পর্কিত মত ছিল স্পষ্ট, কুণ্ঠাহীন। বারবার বলেছেন, প্রকাশ্যেই– ‘আমার কোনও ধর্ম নেই, আমার কোনও জাতি নেই, আমার কোনও ভগবান নেই, আমি মুক্ত, আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা।’ ব্রাহ্মণত্ব বিসর্জনের প্রমাণস্বরূপ নিজের পইতেহীন শরীর দেখিয়েছেন অবলীলায়। অথচ কোনও ধর্মমতকে আক্রমণ করেননি। সমাজসেবা-ই যে বড় ধর্ম, সেটাই বারবার বলেছেন, নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন। ধর্মীয় মেরুকরণের বিপক্ষে ছিলেন সারা জীবন। পাশাপাশি অনেক জিকির গান গেয়েছেন অসমের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য, অহমিয়া গসপেল গেয়েছেন খ্রিস্টানদের জন্য, আর হিন্দুদের জন্য গেয়েছেন অসংখ্য ভক্তিগীতি। তঁার সব ধর্মীয় গীতির মাধ্যমে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান জনজাতির সব ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে শান্তির প্রলেপ দিয়েছেন।
তাই তো তাঁর মৃত্যুর পর ইসলামিক নিয়ম ভেঙে মসজিদে মুসলমান ছাত্ররা গান গেয়েছে, ইমামরা তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে কোরান পাঠ করেছে, ডিব্রুগড়-সহ অসমের অনেক চার্চে তঁার স্মরণসভায় দলে-দলে খ্রিস্টানরা ভিড় করেছে। মৃত্যুর পর শেষ ইচ্ছামতো তঁার দেহাবশেষ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদে। কাঞ্চনজঙ্ঘার সন্তান জুবিন মিশেছেন অসমের সবচেয়ে বড় নদীর জলে, পলিতে, পাথরে। অসমের লক্ষ-লক্ষ জনতা তাদের সব বিভেদ ভুলে জুবিনের শেষ ইচ্ছামতো গেয়েছেন তঁার প্রিয় গান ‘মায়াবিনী রাতির’।
মুম্বইতে রাজেশ খান্না বা লতা মঙ্গেশকরের শেষযাত্রায় অল্প সংখ্যক মানুষের ভিড় জুবিনের ভাল লাগেনি। তিনি বলেছিলেন, ‘জুবিন গর্গের মৃত্যুতে পুরো অসম সাত দিন কঁাদবে।’ অসমবাসী তঁার কথা রেখেছে। তাঁর অন্ত্যেষ্টি যাত্রা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অন্তে্যষ্টি যাত্রা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ড’-এ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ বন্ধ রেখেছে তাদের দোকান, বাজার, আনন্দের অনুষ্ঠান। চোখের জল ফেলেছে হৃদয়বেদনায়।
এই ঘটনা আমাদের দেখাল অদ্ভুত আশার আলো। ধর্ম, জাত, ভাষা, রাজনীতিতে বিভক্ত রাজ্যগুলিকে বা দেশকে এক করা যায় যদি আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে এরকম জাদুকাঠিঋদ্ধ জীবন নির্মাণ করতে পারি। সেই আলোকিত জীবন দিয়ে আমরা ভালবাসার বাঁধনে এক করতে পারি চারপাশের মানুষকে। খুব কঠিন কি?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ প্যাশন টেকনোলজি
goutam.saha@nift.ac.in
