পাপ থেকে মুক্তির উপায়? আজ। দশহারার দিন। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে গঙ্গাস্নান করলে দশ রকম পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রয়েছে এমন কথা। কিন্তু পাপ ধোয়ার মতো জল কই নদীর বুকে? লিখেছেন সুপ্রতিম কর্মকার।
আজ দশহারা। গঙ্গার (Ganges) জন্মদিন। এই ভারতকে যে-নদী চিনতে শেখায়।
নদীরও জন্মদিন হয়? হয় তো। পৌরাণিক গল্প আর বিশ্বাস– এই দুই মিলে হাতে-হাত ধরে গড়ে তোলে নদীর জন্মদিনের কাহিনি। অনেকটা পথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার জন্য ক্লান্ত ছিলেন ভগবান বিষ্ণু। ব্রহ্মা তখন তঁার কমণ্ডলুর জল দিয়ে পা ধুইয়ে দিলেন ভগবান বিষ্ণুর। সেই জল থেকেই জন্ম নেয় গঙ্গা। এই বিশ্বাস বৈষ্ণবদের। পৌরাণিক কাহিনি বলছে অন্য কথা। কমণ্ডলুর জল থেকে নয়, আস্ত এক নারী মূর্তিতে পরিণত হয় ব্রহ্মার কমণ্ডলু। অপরূপা সুন্দরী সেই নারীর নাম হয় গঙ্গা।
আরও একটি লোককাহিনি প্রচলিত রয়েছে উত্তর ভারতে। সেখানে বলা হচ্ছে, ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর– তিন দেবতা স্বর্গের কোন এক বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। আর সেখানেই গিয়ে হাজির নারদ। একটু ইনিয়েবিনিয়ে কথাবার্তা বলা শুরু করেন নারদ মুনি। যেমন স্বভাব তঁার। হঠাৎ করেই নারদের মুখ ফসকে বেরিয়ে এল সেই মোক্ষম কথা– ‘ইদানীং মহেশ্বর খুব ভাল গান গাইছেন’। এই কথা শুনেই বিষ্ণু অনুরোধ করলেন গান শোনাতে। শুরু হল গান। এতটাই ভাল মহেশ্বর গাইলেন যে, তঁার গান শুনে বিষ্ণু দ্রবীভূত হয়ে গেলেন। পাশেই যেহেতু বসে ছিলেন ব্রহ্মা, নিজের কমণ্ডলুর মধ্যে কিছুটা অংশ গলিত বিষ্ণুকে ধরে নিলেন। বিষ্ণুর এই দ্রবীভূত অংশ ‘গঙ্গা’ নামে পরিচিত হয়।
[আরও পড়ুন: গার্ডেনরিচ কাণ্ডে ৮৮ দিনের মাথায় চার্জশিট পেশ, অভিযুক্ত প্রোমোটার-সহ ৬ জন]
আর পূর্বভারতে পাওয়া যায় আর-এক লোককাহিনি। সেখানে গঙ্গা, যমুনা, আর সরস্বতী তিনজনেই বিষ্ণুর স্ত্রী। তিন সতীনের কারও সঙ্গে কারও সদ্ভাব নেই। একদিন ছোট্ট এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেধে গেল তুমুল অশান্তি। গঙ্গা রেগে গিয়ে সরস্বতীকে অভিশাপ দিলেন, ‘সরস্বতী তুই নদী হয়ে যা।’ এই কথা শুনে সরস্বতীও রেগে গিয়ে গঙ্গাকে দিয়ে দিলেন অভিশাপ এই বলে, ‘গঙ্গা, তুইও নদী হয়ে পাতালে চলে যা।’ দু’জন দু’জনের অভিশাপে নদী হয়ে বইতে শুরু করল মর্তে। প্রতিদিনের ঘর গেরস্থালির নিত্যদিনের জীবনের সঙ্গে সাযুজ্যেই গড়ে ওঠে নদীদের জন্মর কাহিনি। এই দেশে গঙ্গা তাই ‘পর’ নয়। দূরের নদী নয়। সে আমাদের ‘আপন’।
গৃহী জীবনে কতরকম আকথা-কুকথা বলতে হয়। কত অনর্থ ঘটে যায় আচারে ও আচরণে। আর তাতেই নাকি পাপ হয়। পাপ থেকে মুক্তির উপায়? দশহারার দিন গঙ্গার স্নান। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে গঙ্গাস্নান করলে দশরকম পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রয়েছে এমন কথা। এই দশরকম পাপের আবার তিনটি প্রকারভেদ রয়েছে। একটি হল শারীরিক পাপ, তা আবার তিন ধরনের। দ্বিতীয় মানসিক পাপ। এটিও তিন ধরনেপ। তৃতীয় হল বাক্যগত পাপ। এটি চার ধরনের। নিষিদ্ধ হিংসা, পরস্ত্রীগমন, চুরি, কঠোর বাণী, অন্যের ধন আত্মসাৎ করার মানসিকতা, কারও খারাপ করার কথা ভাবা, অপ্রয়োজনীয় কথায় বিবাদ, মিথ্যা বলা, সমালোচনা করা, অন্যের অনিষ্ট করা– সব মিলে মোট দশ রকমের পাপ হরণ করে গঙ্গা।
[আরও পড়ুন: স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে নাটকীয় জয় অস্ট্রেলিয়ার, সুপার এইটে চলে গেল ইংল্যান্ড]
পুরাণ বলছে– শিবের জটা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হ্লাদিনী, পাবনী, নলিনী, সুচক্ষু, সীতা, সিন্ধু ও ভাগীরথী– এই ধারাগুলি ‘এক’ হয়ে গঙ্গা নাম নিয়ে পৃথিবীর বুকে বইতে শুরু করে। তারপর পৃথিবীতে আসার পর বিমর্ষ হয়ে পড়েন। মনখারাপের কথা শুনে ভগবান বিষ্ণু যান গঙ্গার কাছে। গঙ্গাকে জিজ্ঞেস করেন, তঁার মনখারাপের কারণ। ভগবানকে কাছে পেয়ে গঙ্গা কঁাদতে থাকেন। তারপর তিনি জানান, গঙ্গায় স্নান করে সবার পাপ হরণ হয়। আর সেই পাপ বহন করতে হয় তঁাকে। এত পাপের ভার তিনি আর বইতে পারছেন না। ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। শুনে ভগবান বিষ্ণু গঙ্গাকে আশ্বস্ত করেন। বলেন, ‘দশহারার দিন পৃথিবীর একজন সৎ ও ধার্মিক মানুষ যদি তঁার বুকে স্নান করেন, তাহলেই গঙ্গার সব পাপ মুক্ত হবে। গঙ্গার জলে কোনও দিন পাপ স্পর্শ করতে পারবে না। আর যত দিন চন্দ্র সূর্য পৃথিবী থাকবে, তত দিন পৃথিবীর কোনও না কোনও সাধু মানুষ গঙ্গার বুকে স্নান করবেনই।’ এখনও লোকবিশ্বাস– ভগবান বিষ্ণু মানবরূপ ধরে দশহারার দিন গঙ্গায় স্নান করে যান।
দশহারা একসময় নবদ্বীপে ছিল রমরমার দিন। দিনে দশবার পুজো করা হত গঙ্গাকে। সেন রাজাদের শাসনকালে গঙ্গাপুজোর জন্য দেওয়া হত পারিতোষিক। গঙ্গার মূর্তি গড়ে ভোর থেকে শুরু হয়ে যেত গঙ্গার ঘাটে গঙ্গা পুজো। সারি-সারি নৌকো এসে ভিড়ত নদীর ঘাটে। নৌকোর গায়ে দেওয়া হত পিটুলির ছোপ। পরানো হত মালা। নদীর ঘাটে বসত মেলা। পুজোর পর প্রসাদ পেত ভক্তরা। এলাহি দিন কাটত মাঝি-মাল্লাদের। এখন জলের অভাবে গঙ্গার অস্তিত্ব সংকটে, নাব্যতা হারাচ্ছে সে। দশহারার মাহাত্ম্য কি পারবে গঙ্গাকে আবারও ঝলমলে করে তুলতে?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক নদী বিশেষজ্ঞ