নির্বাচন আসন্ন। ভোট এলেই সাধারণ পরিষেবা শুধু নয়, অত্যাবশ্যক পরিষেবাতেও ব্যাঘাত ঘটে। এবার কী কী বিধিনিষেধের কবলে পড়বে রাষ্ট্র? লিখছেন নীল সরকার।
আবার একটা সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। ভারতের সংবিধান (Constitution) নাগরিকের অধিকারকেন্দ্রিক। নির্বাচনে (Election) আমজনতা শাসক ঠিক করে। ভারতীয় নাগরিকের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক ক্ষমতার নিদর্শন এই ভোট। সেই নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন সংস্থা নির্বাচন কমিশনের। ভারতে সেই সুকুমার সেনের আমল থেকে বিগত সাত দশক ধরে নির্বাচন হয়েছে নিয়মিত। নির্বাচন ঘোষণা হলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র কমিশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই পর্যন্ত কম-বেশি সকলের জানা। এবার কী কী বিধিনিষেধের কবলে পড়বে সেই রাষ্ট্রযন্ত্র! এবং নাগরিকের কী কী পরিষেবাই বা হবে ব্যাহত?
প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটের দাবি ১৯৪৬ সালে দেশভাগের আগে কংগ্রেস করেছিল। কিন্তু ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন খারিজ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছরের মাথায় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের সূচনা হয়। তখনও নাগরিকত্ব প্রমাণের একগাদা নথি ছিল না। নির্বাচকের তালিকায় নাম থাকলেই হত। বড় সীমাবদ্ধতা পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় নাম থাকা। বাসস্থান-নির্ভর সেই তালিকায় একমাত্র নিজের নির্দিষ্ট বুথেই ভোটদান সম্ভব। এই পরিযায়ী যুগে যা ভোটারদের জীবিকা-নির্বাহের ক্ষেত্রে এক বড় সংকট। কেরল থেকে হোটেলের রঁাধুনি কোচবিহার ফিরলে হোটেল মালিক কেন ক্ষতি সহ্য করবে? ফলে বিপন্ন হয় কর্মক্ষেত্র। তবে কোন ভরসায় নাগরিক এতটা পথ পার করে ভোট দিতে আসবে? ভাবনাচিন্তা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এটা এই সাধারণ নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জ।
[আরও পডুন: আরএসএস নেতা খুনে পপুলার ফ্রন্টের ১৫ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দিল কেরলের আদালত]
নির্বাচন এলে প্রচার, ডিজিটাল মাধ্যম-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের বাজার খুলে যায়। প্রচারের জন্য খরচ নির্দিষ্ট ধার্য হলেও সব আইনের মতো এই আইনেরও হাজারো ফঁাক আছে। যার জন্য টাকার বিনিয়োগও বেড়ে যায়। অধিক খরচের অপরাধে জেতা আসন খোয়া গিয়েছে এমন বদনাম অবধি শোনা যায়নি। এছাড়া দেশের কিছু অংশে শুধু ভোট হয় না। ভোট করানো হয়। সেই ভোট করাতে বৈচিত্রের অভাব নেই। তার জন্য গুচ্ছের কোম্পানি আছে। তারা খরচ করলেই প্রার্থীর হয়ে প্রচারের ঝড় তুলে দেবে। সেখানে নাগরিকের মতামত ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজটা চরম পেশাদারিত্বের সঙ্গে করা হয়। সেই খরচ কোন খাতে দেখানো হয়, আম-নাগরিকের অজানা। হেলিকপ্টার, শতাধিক গাড়ির সারি, বা দৈত্যাকার পর্দায় সভার প্রচার এখন মামুলি। উন্নত দেশে একসময় দেখে চমকিত হতাম। এখন নির্বাচনী প্রচারে তাদের সঙ্গে আমরা টক্কর দিতে পারি। বাতাসে ভাসে বিনিয়োগের টাকা কোন গৌরী সেনের? এমন নির্বোধ প্রশ্ন কেউ তোলার সাহস দেখায় না। তবে নিন্দুকের কাছে শোনা, নির্বাচনের পরে নাকি বাজার চড়চড়িয়ে বাড়ে। সেই বিনিয়োগে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের প্রাপ্তির কথা শোনা যায়।
প্রচারে কিছু নাগরিক বিরক্ত, মাইকের আওয়াজে কান ফাটে, হৃৎকম্প হওয়া বিচিত্র নয়। শোনা কথা, রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা নাকি পাতি জনতার নেই! তার থেকেও বড় প্রশ্ন কানে এল– কে দেবে প্রতিকার? এবার আমজনতাকে থানা, পঞ্চায়েত, পুরসভা, ব্লক বা হাসপাতালে যেতেই হয়। নির্বাচন কমিশন আমজনতার উপর রাজনৈতিক দলের প্রভাব ঠেকাতে নতুন ‘প্রকল্প’ ঘোষণা করতে নিষেধ করে। যুক্তিসংগত কারণ আছে। ফলে যেখানে রাস্তা আশু সারানো দরকার, তার কাজে হাত পড়বে না। কম করে তিন-চার মাস সেই কাজ বন্ধ থাকবে। চালু কাজেও গড়িমসির নমুনা কম নেই। সকলেই তখন দলের কাজে। ফলে শ্রমিকের সংখ্যায় টান পড়ে। নির্বাচন কমিশন শাসকের দায়িত্ব নিলেও তাকে নির্ভর করতে হয় চলমান প্রশাসনের উপর। রাতারাতি শাসক বদলে গেলে প্রশাসনের অভিমুখ বদলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কান পাতলেই শোনা যায়।
[আরও পড়ুন: বাজেট অধিবেশনেই CAA লাগুর পরিকল্পনা! কোন পথে হাঁটছে কেন্দ্র?]
এখানে প্রধান বিষয় ‘উদ্দেশ্য’। নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য থাকে কীভাবে নির্বিঘ্নে নির্বাচন সম্পন্ন করবে ও সর্বাধিক নির্বাচককে ভোটকেন্দ্রে হাজির করাতে পারবে। নাগরিকের চাহিদা এবং নাগরিক পরিষেবা যেন বাধা না পায়। কিন্তু সেই বিষয়ে কার কাছে জানাবে? ধরুন, শহরের পাইপ ভেঙে জল জনপদে চলে আসছে। সরবরাহ বন্ধ। জানালে বলবে নির্বাচন পরশু। লোক নেই। ওটা পার হতে দিন। নাগরিকের চলবে কীভাবে? বাড়ির গরু মৃতপ্রায়। পশুচিকিৎসক নির্বাচন করাতে গিয়েছেন। কে বঁাচাবে? নির্বাচন কমিশন এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পরিষেবা কখনওই বন্ধ করতে বলে না। কিন্তু সকলে যদি নির্বাচনে জড়িয়ে পড়ে, তবে পরিষেবা আমজনতাকে কে দেবে? হিংসা কাণ্ড ঘটে গেলে তো সব দফারফা!
কিছু গাড়ি নির্বাচনের কাজে তুলে নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। কিছু গাড়ির মালিক পুলিশের কাছে যেচে সিজার লিস্ট করাবে, নাহলে গাড়ি বের করবে না। ফলে গণ পরিবহণে চাপ পড়ে। ঘোর মফস্সলে ফেরি অবধি বিঘ্নিত হওয়ার কথা আকছার শোনা যায়। সাধারণ পরিষেবা শুধু নয়, অত্যাবশ্যক পরিষেবাতেও টান পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গণ পরিবহণের অভাবে অসুস্থকে যদি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া না যায়, তবে সুরাহা কী? এই পরিস্থিতি প্রচার তুঙ্গে উঠলেও হয়। বড় মাপের নেতা এলে সেদিন সেই জনপদে সব ধরনের পরিষেবা প্রভাবিত হয়। নির্বাচনের দিন নূ্যনতম পরিষেবা মফস্সলে পাওয়া দুষ্কর। গণতান্ত্রিক অধিকার যেমন নিশ্চিত করা জরুরি, তেমনই প্রয়োজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করাও। সেই বিষয়ে নির্বাচন কমিশন শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরে নজর রাখা আবশ্যক। আদতে সবকিছুই তো নাগরিকের মঙ্গলের জন্য।