একচ্ছত্র ক্ষমতায় যারা-ই এসেছে, দক্ষিণ অথবা বাম নির্বিশেষে, তারা-ই কি নিজেদের শাসনক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য একটি চির-অনুগত জনপিণ্ড বানানোর উদ্যোগ নেয়নি? এই ‘জনপিণ্ড’-ই সংঘ। যে কোনও সংঘাদর্শই তাই সন্দেহযোগ্য। লিখছেন অর্ণব সাহা।
প্রায় দেড় দশক পরে নিজের হারিয়ে যাওয়া কৈশোর আর প্রথম যৌবনকে ফিরে দেখতে বহু কাল আগে ছেড়ে আসা বাড়িটিতে অল্প সময়ের জন্য এসেছে মৈনাক। কুমারেশদা ছিল তার কম বয়সের ‘আইডল’, বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী, জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল ১৯৭৭ সালে। কুমারেশদার বউ যূথিকা বউদিই ছিল তার সেই সময়ের সঙ্গিনী। আজ, এক জরাজীর্ণ, বদলে-যাওয়া বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা হয় কুমারেশদার ভাই পলাশের। পলাশ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করে, গলায় রুদ্রাক্ষ। সে নাকি কোষ্ঠী বানায়, সেটুকুই তার রোজগার।
–তুমিও পার্টি করো?
–দাদার পার্টি নয়, পলাশ গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে...। অবাক হবেন না হাবুদা। আমরা হিন্দুরা অনেক দিন মার খেয়েছি। কোনও পার্টি আমাদের জন্য কিছু করেনি।
মৈনাক কথা বলে না। কুমারেশদা, কুমারেশদার ভাই পুলু... সে যেন অঙ্কটাকে মেলাতে পারে না।
পলাশের কাছ থেকে কুমারেশদার কাছ থেকে বিস্তারিত শোনে মৈনাক। বছর চারেক আগে খুন হন কুমারেশদা। এখনও আততায়ীদের হদিশ মেলেনি। ‘ক্ষমতার লড়াইতে দাদা খুন হয়েছে, কে আর খুনী ধরবে বলুন?’
রবিশংকর বলের গল্প ‘আততায়ীরা’। আমাদের জীবন এবং তার চারিপাশ যে বহু ক্ষেত্রেই যুক্তির সীমা অতিক্রম করে অযুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে, তা এই গল্পে স্পষ্ট হয়। আর এই অযুক্তির দাপট অসহনীয় হয়ে ওঠে, যখন তা নিয়ন্ত্রিত হয় অনিয়ন্ত্রিত ‘ক্ষমতা’-র দ্বারা। কোনও ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, ব্যক্তি, প্রশাসন কখনওই চায় না যুক্তির আধিপত্য কায়েম হোক। বরং তারা চায়, ‘অযুক্তি’-কে পূর্ণাঙ্গ ‘যুক্তি’-র মোড়কে হাজির করে মানুষের মগজকে চিরকালের জন্য নিয়ন্ত্রণ করতে। ড্যান অ্যারিয়েলি তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘মিসবিলিফ: হোয়াট মেকস র্যাশনাল পিপল বিলিভ ইন ইর্যাশনাল থিংস’ বইয়ে দেখিয়েছেন, অযুক্তি বা অন্ধ বিশ্বাস কাজ করে একটি ফানেলের মতো করে, অজস্র তথ্য ফানেলের বড় হাঁ-মুখ দিয়ে ঢোকে, অথচ মানুষ তাকে গ্রহণ করে ফানেলের সরু মুখটির মতো, নিজের অন্ধ বিশ্বাস, ভুল যুক্তির সাপেক্ষে। ‘ক্ষমতা’ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। ভারতে কোভিড-কালে থালাবাসন বাজানো, গোমূত্র পান, ভাবিজি পঁাপড় ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস গড়ে ওঠাকে এই পদ্ধতিতে ফেলা যায়।
[আরও পড়ুন: CCTV ফুটেজ বাজেয়াপ্তর পর এবার স্বাতীর পোশাক পাঠানো হল ফরেনসিক তদন্তে]
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ ‘ভাইরাল’ হয়েছে। গ্রেটার নয়ডার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় “গালগোটিয়া’জ ইউনিভার্সিটি”-র একদল ছাত্রছাত্রী দিল্লির জাতীয় কংগ্রেস দফতরে বিক্ষোভ দেখাতে যায়। এই ছাত্রছাত্রীরা দেশের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের সমর্থক। অথচ, টিভি ক্যামেরার সামনে এরা পরিষ্কার বলতেই পারল না আদৌ কেন তারা বিক্ষোভ দেখাতে এসেছে। যাদের বিরুদ্ধে এরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, তাদের কোন কোন কাজ অপছন্দের– সেই সম্পর্কেও এদের কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। এরা দেশপ্রেমের স্বঘোষিত ঠিকাদার, অথচ কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী ইস্তাহার সম্পর্কে এরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। টিভি ক্যামেরার সামনে দৃশ্যতই বিব্রত এরা হিন্দুত্ব শিবিরের জনপ্রিয় লব্জ ‘আরবান নকশাল’ কথাটির উচ্চারণ করল ‘আরবান ম্যাক্সওয়েল’। নিজেদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে ঠিক কী লেখা আছে, তা-ও এদের অজানা।
কেউ-কেউ ক্যামেরার সামনেই পিঠটান দিল, কেউ বলল– বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই নাকি তারা এই অভিযানে যোগ দিয়েছে। তাদের নাকি বলা হয়েছিল, এই মিছিলে অংশ নিলে যথেষ্ট ভাল নম্বর পাইয়ে দেওয়া হবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এই জমানায় গৈরিকীকরণের শিকার এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গত শতকের তিনের দশকের নাৎসি জমানার মতোই নিজস্ব মগজহীন, অনুগত ফ্যাসিস্ট যুববাহিনী তৈরির প্রক্রিয়াও খুঁজে পেলেন কেউ-কেউ।
এই ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেশের একাধিক প্রথম সারির খবরকাগজ ও সাময়িকপত্রে বিশাল বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষের প্রমাণস্বরূপ ‘ন্যাক’ মূল্যায়নে নিজেদের যথেষ্ট এগিয়ে থাকার কথা জানিয়ে দেয়।
[আরও পড়ুন: তাজমহলের পাশে মসজিদের ভিতর থেকে উদ্ধার যুবতীর অর্ধনগ্ন দেহ, ছড়াল তীব্র চাঞ্চল্য]
আধুনিক যুগে পৃথিবীর দেশে-দেশে একচ্ছত্র ক্ষমতায় যারা-ই এসেছে, দক্ষিণ অথবা বাম নির্বিশেষে, তারা-ই কি নিজেদের শাসনক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য একটি চির-অনুগত জনপিণ্ড বানানোর উদ্যোগ নেয়নি? হিটলারের আমলে তৃতীয় রাইখের উত্থানের পর এক সুশৃঙ্খল নাৎসি যুবাবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল, যারা এমনকী, নিজেদের বাবা-মায়ের মনোভাবও জানিয়ে দিত সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রকে। তারা ছিল হিটলারি একনায়কতন্ত্রের পূর্ণ সমর্থক। ইতালিতে মুসোলিনির জমানাতেও অবিকল একইরকম সামরিক স্কুল খোলা হয়েছিল যুব সম্প্রদায়ের জন্য। কিন্তু এ-কথা আমরা বহু ক্ষেত্রেই ভুলে যাই, অথবা স্বীকার করি না, রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বা চিন বিপ্লবের পর নয়া লাল চিনেও অবিকল একইরকম ছঁাচে-ঢালা সমাজ ও একটাই রাষ্ট্রিক আদর্শে দীক্ষিত অনুগত, মগজহীন যুবাবাহিনী গড়ে তোলা হয়। সোভিয়েত রাশিয়ায় এই যুব সম্প্রদায়ের নাম ছিল ‘কম্সোমল’।
আর লাল চিনে একনায়কতন্ত্রের সর্বোচ্চ কাঠামোয় হৃতমর্যাদা উদ্ধারের জন্য মাও সে তুংয়ের নিজস্ব অনুগামীদের উৎসাহে ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর নামে কালাপাহাড়ি তাণ্ডবের জন্ম দেওয়া হয়। তার প্রত্যক্ষ অনুকরণে আমাদের বাংলায় যে অতিবামপন্থী নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়, সেখানে অন্তর্বস্তু যতই মহৎ ও বৈপ্লবিক হোক, সূচনার পরপরই নেতৃত্বের ভ্রান্তনির্দেশে তা দ্রুত অধঃপতিত হয় এবং আমূল পরিবর্তনের নামে উনিশ শতকের বাঙালি মনীষীদের মূর্তি-ভাঙা, স্কুল বিল্ডিং ও লাইব্রেরি পোড়ানোর মতো নির্বোধ একবগ্গা ধ্বংসাত্মক কাজকর্মের দিকে এগয়। অস্বীকার করার জায়গা নেই, নকশালবাড়ি আন্দোলনের ফলেই ভারতীয় গ্রামসমাজ, উনিশ শতকীয় ‘নবজাগরণ’ ও ঔপনিবেশিক শাসনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সম্ভব হয়েছিল। বিশেষত, পরবর্তী ইতিহাস, অর্থনীতি ও সমাজবিদ্যা-চর্চায় এই আন্দোলনের অভিঘাত হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। জন্ম নিয়েছিল ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা’-র মতো যুগান্তকারী তাত্ত্বিক প্রস্থান, অথচ মূল আন্দোলন যে অচিরেই কানাগলির রাজনীতিতে পর্যবসিত হয়েছিল, এবং এক তুঘলকি কাজকারবারের দিকে তা ঠেলে দিয়েছিল যুবসম্প্রদায়ের একাংশকে, সে-ও আমাদের সামাজিক ইতিহাসের অংশ কিন্তু।
নাৎসি জার্মানিতে ‘ইউজেনিক্স’ নামে অপবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বিকাশ ঘটেছিল খোদ ফ্যুয়েরারের অনুপ্রেরণায়। এই মতাদর্শ অনুযায়ী, নর্ডিক আর্যদের রক্ত একমাত্র ছিল খঁাটি জার্মানদের শরীরে। তাই জার্মান জাতিই নাকি ছিল পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র আধিপত্যের অধিকারী। তাই যারা ‘অ-জার্মান’ অর্থাৎ ইহুদি, কৃষ্ণাঙ্গ বা জিপসি, তাদের বলপূর্বক খতম করা-ই ছিল খঁাটি জার্মান জাতি তৈরির পথ। এই মতাদর্শের নাম দেওয়া হয় ‘রেসিয়াল হাইজিন’। হিটলার ‘মাইন ক্যাম্ফ’ বইয়ে এই নিকৃষ্টদের নির্মূলীকরণকেই ‘নাৎসি ফাইনাল সলিউশন’ হিসাবে ঘোষণা করেন। নাৎসি প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবল্সের নেতৃত্বে জার্মান বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবীদের এক বিশেষ টিম এই কাজটি সম্পাদনায় উঠেপড়ে লাগে। নাৎসি উত্থানের আগেই অবশ্য ইউজিন ফিশার, এডউইন বাউর ও ফ্রিটজ লেঞ্জ– এই তিন জার্মান বিজ্ঞানীর লেখা ‘আউটলাইন অফ হিউম্যান জেনেটিক অ্যান্ড রেসিয়াল হাইজিন’ বইটি বেরয়।
[আরও পড়ুন: রাজস্থানে কিশোরীকে গণধর্ষণের পর ইটভাটার চুল্লিতে পুড়িয়ে হত্যা! মৃত্যুদণ্ড দুই সাজাপ্রাপ্তকে]
১৯২৩ সালে ভারতে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের জনক বিনায়ক দামোদর সাভারকরের লেখা ‘হিন্দুত্ব: হু ইজ আ হিন্দু’ ও ১৯৩৯ সালে সদাশিব গোলওয়ালকরের লেখা ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ বইয়েও ভারতকে খঁাটি হিন্দুদের ‘পিতৃভূমি’ ও ‘পূণ্যভূমি’ হিসাবে বিবেচনা করার কথা বলা হয়। উপরন্তু, দ্বিতীয় বইটিতে হিন্দু রাষ্ট্রের ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ রূপে চিহ্নিত করা হয় ‘বহিরাগত’ মুসলমান, ক্রিশ্চান এবং ‘কমিউনিস্ট’-দের। নাৎসি ইউজেনিক্সের সঙ্গে ছত্রে-ছত্রে মিল নয় কি?
কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ নয়। ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব ও ঠিক তার পরবর্তী তিন বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের ভিতরেই সদ্যগঠিত বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে গড়ে তোলা হয় গুপ্ত পুলিশবাহিনী ‘চেকা’ ও আরও পরে ‘এনকেভিডি’। ১৯১৮-র গ্রীষ্মে লেনিন স্পষ্ট নির্দেশ দেন পুরনো শাসক শ্রেণি, বৃহৎ চাষি বা ‘কুলাক’, যাজক আর শ্বেত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্মম গণহত্যা চালাতে হবে। তাদের দলে দলে পাঠানো হবে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’। ট্রটস্কিকে চিঠিতে লিখছেন সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য ‘জ্যাকোবিয়ান পন্থা’ নিতে। লাল ফৌজের মধ্যে যে বিপুল ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’ ছিল, তার ফলে গ্রামে-শহরে ইহুদিদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়া হতে থাকে। ‘অন দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য কোয়েশ্চেন অফ দ্য ডিক্টেটরশিপ’ প্রবন্ধে লেনিন বলছেন, বিপ্লবী একনায়কতন্ত্র আইনের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে না, অনিয়ন্ত্রিত বলপ্রয়োগই তার একমাত্র পথ। ১৯৭৫-এ ক্ষমতায় আসার পরে কম্বোডিয়ার ‘খমের রুজ’ শিক্ষিত মধ্যবিত্তবিহীন ‘লাল কম্বোডিয়া’ বানানোর লক্ষ্যে কুড়ি লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। সোভিয়েত রাশিয়ায় নিহতের সংখ্যা ছিল কয়েক কোটি। নাৎসি জার্মানি যদি নিরঙ্কুশ ক্ষমতাপ্রয়োগের উদ্দেশ্যে ‘অপবিজ্ঞান’-এর আশ্রয় নেয়, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের গণহত্যা তবে কী ছিল– যুক্তিবাদী বিজ্ঞান?
শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন– ‘সত্য থেকে সঙ্ঘ হতে পারে/ সঙ্ঘ তবু পাবে না সত্যকে’। গুটিকতক মানুষের হাতে-তৈরি ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যবাচক সমষ্টি থেকে আরম্ভ করে লক্ষ-লক্ষ মানুষের ভিতর ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ চালানো দানবিক রাষ্ট্র– কেউই কি আদৌ সত্যের সাধনা করে?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজ
arnabrai07@gmail.com